যে ৮টা উপায়ে তুমিও হুমায়ূন আহমেদ হতে পারবে
তুমি কি হুমায়ূন আহমেদের মতো সফল হতে চাও? হতে চাও দেশের মানুষের প্রিয়তম সাহিত্যিক? হতে চাও জনপ্রিয় টিভি নাটক রচয়িতা, নির্মাতা, চলচ্চিত্র পরিচালক?
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৮০-এর দশকে জনপ্রিয়তম কথাসাহিত্যিকের জায়গা দখল করেন বাংলাদেশে, তখন তাঁর বয়স ৩২-৩৩ বছর। তিনি মারা যান ২০১২ সালে, তখন তাঁর বয়স মাত্র ৬৪। মৃত্যুর পরও কেটে গেল ১৩ বছর, আজও হুমায়ূন আহমেদই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক।
তুমি যদি হুমায়ূন আহমেদের মতো জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হতে চাও বা তাঁর মতো সাফল্য যদি তোমার জীবনে অর্জন করতে চাও, কী করতে হবে তোমাকে? চলো দেখি, হুমায়ূন আহমেদের জীবন থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি।
১. ছোটবেলা থেকেই লিখতে শুরু করা
হুমায়ূন আহমেদের বাড়িতেই ছিল সাহিত্যিক পরিবেশ। হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশিত হতো তাঁর বাড়িতে। তিনি নিজে সেই পত্রিকায় লিখতেন, ছবি আঁকতেন। কাজেই তোমরা যে যা-ই হতে চাও না কেন, তা শুরু করতে হবে ছোটবেলাতেই।
২. প্রচুর পড়া
হুমায়ূন আহমেদ ‘আমার ছেলেবেলা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘আমার বাবা অন্যদের চেয়ে আলাদা কিছু না। তা ছাড়া বাবার সঙ্গে আমাদের কিছু দূরত্বও ছিল। ছেলেমেয়েদের প্রতি আদরের বাড়াবাড়ি তার চরিত্রে ছিল না। নিজে খুব ব্যস্তও থাকতেন। সারাদিন অফিস করে বিকেলে বই পড়তে যেতেন কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে। ফিরতে ফিরতে রাত নটা। দিনের পর দিন কাটত, তাঁর সঙ্গে আমাদের কথা হত না। এই কারণে মনে মনে চাইতাম তার যেন কোনো-একটা অসুখ হয়। বাবার অসুখ খুবই মজার ব্যাপার। অসুখ হলে তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের চারপাশে বসিয়ে উঁচুগলায় কবিতা আবৃত্তি করতেন। এতে নাকি তার অসুখের আরাম হতো।
এই অসুখের সময়ই তিনি একবার ঘোষণা করলেন, “সঞ্চয়িতা” থেকে যে একটা কবিতা মুখস্থ করে তাকে শোনাতে পারবে সে এক আনা পয়সা পাবে। দুটো মুখস্থ করলে দুআনা।
আমি বিপুল উৎসাহে কবিতা মুখস্থ করতে শুরু করলাম। এর মধ্যে কোনো কাব্যপ্রীতি কাজ করেনি। আর্থিক ব্যাপারটাই ছিল একমাত্র প্রেরণা। যথাসময়ে একটা কবিতা মুখস্থ হয়ে গেল। নাম ‘এবার ফিরাও মোরে’। দীর্ঘ কবিতা। এই দীর্ঘ কবিতাটা মুখস্থ করার পেছনের কারণ হল, এটা বাবার খুব প্রিয় কবিতা। তাঁদের সময় নাকি বি.এ. ক্লাসে পাঠ্য ছিল।
বাবা আমার কবিতা আবৃত্তি শুনলেন।
কোনো ভুল না করে এই দীর্ঘ কবিতাটি বলতে পারায় তিনি আনন্দে অভিভূত হলেন। এক আনার বদলে আমি চার আনা পয়সা পেলাম। সাহিত্যবিষয়ক কর্মকাণ্ড থেকে ওটাই ছিল আমার প্রথম রোজগার।’
কী বুঝলে? আমি সব সময় তোমাদের বলি, কবিতা মুখস্থ রাখতে হয়। প্রচুর পড়ো। কবিতাও পড়বে। আর কবিতা মুখস্থ করে ফেলবে।
হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন: নানার বাড়ি থেকে দাদার বাড়িতে এলে শুরুতে খানিকটা দমবন্ধ দমবন্ধ লাগত। তবে দাদার বাড়িরও আলাদা মজা ছিল। বাড়ির বাংলাঘরে দুটি কাঠের আলমিরায় ছিল অসংখ্য বই। আসলে এই দুটি আলমিরা নিয়েই একটা পাবলিক লাইব্রেরি। আজিমুদ্দিন আহমেদ পাবলিক লাইব্রেরি। আজিমুদ্দিন আহমেদ আমার দাদার নাম। তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর নামে বাবা এই লাইব্রেরি করেন। লাইব্রেরির চাঁদা মাসে এক আনা। এই লাইব্রেরি থেকে কেউ কোনোদিন বই নিয়েছে বলে আমার জানা নেই। আমরা দাদার বাড়িতে উপস্থিত হলেই শুধু চাবি খুলে বই বের করা হত। চাবি চলে আসত আমার হাতে। দাদার বাড়িতে পুকুরপাড়ে বটগাছের মতো বিশাল এক কামরাঙা গাছ ছিল। সেই কামরাঙা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বই পড়ার আনন্দের কোনো তুলনা হয় না।
তাহলে দেখতে পাচ্ছ, হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় ছিল বইপড়া। তিনি লিখেছেন, বইপড়ার আনন্দের কোনো তুলনা হয় না। এটা আমাদের জীবনেও অনুসরণ করতে হবে।
৩. পড়াশোনা নিয়ে চাপ অনুভব না করা
তোমাদের অনেকের জীবনেই হয়তো আছে বাবা-মায়ের প্রত্যাশার চাপ, শাসনের চাপ, শিক্ষকদের কঠোর শাসন। এটা কিন্তু না থাকলেই ভালো। পড়াশোনা করতে হবে, কিন্তু তা হতে হবে আনন্দের সঙ্গে।
হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন: আমার শৈশবকে অসাধারণ আনন্দময় সময় বলা যায়। আমার ছিল পূর্ণ স্বাধীনতা। আজকালকার মায়েরা সন্তান চোখের আড়াল হলেই চোখ কপালে তুলে হৈচৈ শুরু করে দেন। আমাদের সময় অবস্থা ভিন্ন ছিল। শিশুদের খোঁজ পড়ত শুধু খাওয়ানোর সময়। তাদের পড়াশোনা নিয়েও বাবা-মাদের খুব দুশ্চিন্তা ছিল না। একটি শিশুশিক্ষা এবং ধারাপাতের চটি একটা বই এবং স্লেট-পেনসিল কিনে দিলেই বাবা-মারা মনে করতেন অনেক করা হল। বাকি পড়াশোনা ধীরেসুস্থে হবে, এমন তাড়া কিসের?
ক্লাস ওয়ান টুর পরীক্ষাগুলিতে ফার্স্ট হতে হবে এমন কোন কথা নেই। পাশ করে পরের ধাপে উঠতে পারলেই হল। না পারলেও ক্ষতি নেই, পরের বার উঠবে। স্কুলতো পালিয়ে যাচ্ছে না। পুরো ব্যাপারটায় এক ধরনের ঢিলেঢালা ভাব।
৪. পরীক্ষায় ভালো করা
হুমায়ূন আহমেদ ভালো ছাত্র ছিলেন। মাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি ১৯৬৫ সালে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তিনি পিএইচডি করেন পলিমার কেমিস্ট্রিতে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন।
কাজেই তোমরা কিন্তু তোমাদের পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো করার ব্রত ছাড়বে না।
৫. চোখকানও খোলা রাখা
শাকুর মজিদ নামে আমাদের বন্ধু-লেখক-নাট্যকার স্থপতি হুমায়ূন আহমেদের প্রথম সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে হুমায়ূন আহমেদ বলেন: নতুন লেখকদের জন্য আমার একটাই কথা—পড়তে হবে, প্রচুর পড়তে হবে—সব লেখকের লেখা পড়তে হবে। তাতে ভাষার ওপর দখল আসবে—কোন লেখক কিভাবে চরিত্রগুলো নিয়ে ‘ট্রিট’ করছেন, সেটাও পরিষ্কার হবে। আবার চোখকানও খোলা রাখা দরকার। যেমন কোন পেশার লোক কিভাবে কথা বলে, কিভাবে হাঁটে-চলে এসবও দেখতে হবে। তা ছাড়া কবিতা পড়া থাকলে বোধ হয় ভাষার প্রতি দখলটা তাড়াতাড়ি আসে।
৬. মৌলিকত্ব
হুমায়ূন আহমেদ কাউকে নকল করেননি। তিনি তাঁর নিজের মতো করে লিখেছেন। তাঁর বাক্যগঠনরীতি একেবারে তাঁর মতো। নকল করে বড় লেখক হওয়া যায় না। নিজের মতো করে লিখতে হয়। এটা আমরা হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে শিখি।
হুমায়ূন আহমেদ নাটকও লিখেছেন নিজের মতো করে। আর কারও অনুকরণ বা অনুসরণ করে নয়।
আজকাল অনেকেই হুমায়ূন আহেমেদের মতো করে লেখার চেষ্টা করেন। এঁরা যদি অবিলম্বে নিজেদের মতো করে লিখতে শুরু না করেন, কেউই বড় সাহিত্যিক হিসেবে গণ্য হবেন না।
৭. একাগ্রতা
লেখার সময় লেখা ছাড়া বাকি সবকিছু ভুলে যাওয়া। হুমায়ূন আহমেদ যখন লিখতেন, তখন আশপাশের সবকিছু এবং সবাইকে ভুলে যেতেন। শিল্পী মাসুক হেলাল হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখির মুহূর্তগুলো নিয়ে লিখেছেন: হুমায়ূন ভাই লিখতে বসলে একটা ঘোরের মধ্যে থাকতেন। চায়ের কাপে ঘন ঘন চুমুক দিতেন। লিখে চলতেন ছোট ছোট অক্ষরে। বিড়বিড় করে কথা বলতেন। হঠাৎই আবার লেখা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেন। লুঙ্গিটা কোমরের কাছে বাঁ হাত দিয়ে ধরে রেখে ঘরময় হাঁটতেন। তখনো যেন ঘোরের মধ্যেই রয়েছেন। কেউ এ সময় কথা বললে তিনি একটু তোতলা হয়ে যেতেন। কথা বলতেন দ্রুতলয়ে।
তীব্র মনোযোগ ছাড়া কোনো কাজে সিদ্ধি আসে না। যেমন ক্রিকেটার যখন ব্যাট করেন, তাঁকে প্রচণ্ড মনোনিবেশ করতে হয়। লেখালেখির কাজটাও তা-ই, তোমাকে মনোযোগী হতে হবে।
৮. প্রতিভা
লেখালেখির ব্যাপারে জন্মগত প্রতিভার ব্যাপারটাকে অনেকেই অস্বীকার করেন। যেমন প্রতিভা বিষয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘আমি বলব, না, এ রকম হঠাৎ কোনো লেখকই গজান না। রাতারাতি লেখকে পরিণত হওয়ার ম্যাজিকে আমি বিশ্বাস করি না। অনেক কাল আগে থেকেই তার প্রস্তুতি চলে।’
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণের কথাটা বাজে। আত্মজ্ঞানের অভাব আর রহস্যাবরণের লোভ ও নিরাপত্তার জন্য প্রতিভাবানরা কথাটা মেনে নেন। মাথা নিচু করে এই মূল সত্যটিকে মেনে নিতে হবে যে, কবিতা লেখাও কাজ, ছবি আঁকাও কাজ, গান করাও কাজ, চাকা ঘোরানোও কাজ, তাঁত চালানোও কাজ এবং কাজের দক্ষতা শুধু কাজেরই দক্ষতা।… প্রতিভা এই দক্ষতা অর্জনের বিশেষ ক্ষমতা। আর কিছু নয়।’
এইখানে মানিকের ব্যাখ্যার সঙ্গে আমরা মিল পাচ্ছি সম্প্রতি নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ‘দ্য জিনিয়াস ইন অল অব আস’ বইটির লেখক ডেভিড শেংকের কথার। তিনি বলছেন, ‘জিন, জিনিয়াস, আইকিউ—এই সব কথা ভুলে যান। সবারই আছে প্রতিভা এবং সে প্রতিভা মানুষের জিনে আছে সুপ্রচুর। শুধু সেই জিনটা শাণিত করে তুলতে হবে। আপনি যদি চেষ্টা করেন, আপনিও শচীন টেন্ডুলকারের মতো ব্যাটসম্যান হতে পারবেন। তবে আপনাকে শচীন টেন্ডুলকারের মতো করে চেষ্টা করতে হবে, চর্চা করতে হবে, লক্ষ্য ঠিক রেখে এগোতে হবে।’
কথাটার মধ্যে অতিসরলীকরণ আছে। সব ব্যাটসম্যানই চেষ্টা করেন, কিন্তু সবাই টেন্ডুলকার কিংবা ব্রায়ান লারা হন না। কিন্তু চেষ্টা যে করতে হয়, সেটা আমরা জানি।
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ২২-২৩ বছর বয়সের দিকে ‘নন্দিত নরকে’ ও ‘শঙ্খনীল কারাগার’ লিখেছেন। জন্মগত প্রতিভা ছাড়া আর কোনো কিছু দিয়ে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারা যায় না। আমি শুধু বলব, হুমায়ূন আহমেদ হওয়ার চেষ্টা করে লাভ নেই। তুমি কার মতো হতে চাও?
তুমি আয়নার সামনে দাঁড়াও। যাকে দেখছ, তুমি তার মতো হও। মানে, তুমি তোমার মতো হও।