টেবিলে রাখা বিশাল আকারের কেক। কলসিন্দুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের মেয়েদের ড্রেসিংরুমের সেই কেকের পাশে জড়ো হয়েছেন সদ্য সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশ নারী দলের আট ফুটবলার মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তার, শামসুন্নাহার সিনিয়র, তহুরা খাতুন, মার্জিয়া খাতুন, শামসুন্নাহার জুনিয়র, শিউলি আজিম ও সাজেদা খাতুন। স্কুলের খুদে ফুটবলাররাও কেকের পাশে ভিড় জমিয়েছে। উপলক্ষ—কিশোর আলোর নবম জন্মবার্ষিকী।
সারা দেশের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত সানজিদারা গত বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন থেকে এক দফা সংবর্ধনা পেয়েছেন। শুক্রবার সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ, হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও। গতকাল কলসিন্দুর স্কুল ও গামারীতলা ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এই মেয়েদের আরেকবার সংবর্ধনা দেওয়া হলো।
স্কুলমাঠের ওই সংবর্ধনার ফাঁকে দুপুরে ‘কিশোর আলো’র জন্মদিনের জন্য কেক কাটেন ফুটবলাররা। কিশোর আলোর সম্পাদক আনিসুল হককে ঘিরে রীতিমতো উৎসব লেগে যায় তখন। ‘আমার পৃথিবী অনেক বড়’—বিশাল সাইজের কেকে লেখা এ স্লোগান ছিল ফুটবলারদের মুখে। ‘শুভ জন্মদিন কিশোর আলো’ বলে কেক কাটার সময় হাততালি দিলেন সবাই।
কলসিন্দুরের মেয়েদের সঙ্গে প্রথম আলোর সম্পর্কটা আগে থেকেই। ২০১৫ সালে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কলসিন্দুরের মেয়েদের সংবর্ধনা দিয়েছিল প্রথম আলো। এ ছাড়া বাংলাদেশের মেয়েরা বয়সভিত্তিক এএফসি কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর প্রথম আলো জাতীয় দলের খেলোয়াড়সহ কলসিন্দুর গ্রামের মোট ২৫ জনকে বৃত্তি দিয়েছিল।
গতকালের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একসময়ের সহকারী শিক্ষক মফিজ উদ্দিন, কলসিন্দুর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মালা রানী সরকার, কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী। স্থানীয় গামারীতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন খান ও ধোবাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা টিপু সুলতানও ছিলেন অনুষ্ঠানে।
কলসিন্দুর গ্রামে ঢুকতেই দেখা গেল বিভিন্ন জায়গায় সানজিদা, মারিয়াদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বানানো একাধিক তোরণ। শুধু মারিয়া মান্দার বাড়ি মন্দিরগোনা যাওয়ার পথেই তিনটি দৃষ্টিনন্দন তোরণ। মারিয়াদের জন্য হাতে লেখা প্ল্যাকার্ডে লেগেছে ভালোবাসার ছোঁয়া।
ছয় বছর আগে ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত এই গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে ফুটবলারদের কল্যাণেই। ফুটবলারদের চাওয়ার কারণে কলসিন্দুর স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণ হয়েছে। কিন্তু কলসিন্দুর গ্রামের রাস্তাঘাট এখনো খানাখন্দে ভরা। মন্দিরগোনা গ্রামের বড় দুঃখ নেতাই নদ। ভরা বর্ষায় এই নদের পানি দুকূল ছাপিয়ে ভাসিয়ে দেয় গ্রাম, ভাঙনের মুখে পড়ে গ্রামবাসী। বর্ষায় মন্দিরগোনা থেকে উপজেলা শহরে আসার একমাত্র রাস্তাটিও বন্ধ হয়ে যায়। যে কারণে অনেক সময় গর্ভবতী নারী ও অসুস্থ রোগীরা চিকিৎসার প্রয়োজনে শহরে যেতে পারেন না।
জাতীয় দলের উইঙ্গার সানজিদা আক্তার বলছিলেন, ‘মারিয়ার বাড়িতে যাওয়ার পথে যে নদটা আছে, সেখানে আমরা একটা সেতু নির্মাণের দাবি জানাচ্ছি। ছোটবেলা থেকেই আমরা এই নদ পার হয়ে গুচ্ছগ্রাম খেলার মাঠে অনুশীলন করি। স্কুলের নতুন যে ফুটবলাররা উঠে আসছে, তাদেরও ওই মাঠে গিয়ে অনুশীলন করতে হয়। কিন্তু সেতু না থাকায় অনুশীলনে যেতে সমস্যা হয়।’
গতকাল দুপুরে ঘাটে গিয়ে দেখা গেল, নদের দুই পাড়ে আড়াআড়িভাবে বাঁধা একটা দড়ি। এই দড়ি টেনে নৌকায় নদ পার হচ্ছে স্থানীয় জনগণ। নদের পাড়েই বাড়ি জাতীয় দলের ডিফেন্ডার শিউলি আজিমের। নদে সেতু নির্মাণের পাশাপাশি ভাঙন রোধে ব্লক দেওয়ারও দাবি জানান তিনি, ‘আমাদের বাড়ির পাশে গির্জা ও মসজিদ আছে। একটা মাদ্রাসাও আছে। ভাঙনের কারণে হুমকির মুখে প্রতিষ্ঠানগুলো। ভরা বর্ষায় চাইলেও এই ঘাট দিয়ে কেউ পার হতে পারে না। এ জন্য আমরা নদের পাড়ে ব্লক দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি এতে যেন একটা সেতুও নির্মাণ করা হয়।’
কিশোর আলোর জন্মদিন কলসিন্দুর গ্রামে পালন করা হবে, এমন পরিকল্পনা ছিল কয়েক দিন আগে থেকেই। ঢাকা থেকে মেয়েদের জন্য আনা হয় বিভিন্ন উপহারসামগ্রী, কিশোর আলোর লোগো–সংবলিত টি-শার্ট, মগ ও ফুটবল। ঢাকা থেকে আসা কিশোর আলো টিমের সঙ্গে ময়মনসিংহ থেকে যোগ দেন ময়মনসিংহ বন্ধুসভার সহসভাপতি সাদিকুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান ও সদস্য হামিদুল হক। প্রথমেই কিশোর আলোর পক্ষ থেকে যাওয়া হয় সানজিদার বাড়িতে। আনিসুল হক সানজিদার মা–বাবার হাতে তুলে দেন উপহার।
বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়েই সারা দেশে আলো কাড়েন সানজিদারা। কিন্তু ছয় বছর ধরে কলসিন্দুর স্কুল অংশ নিচ্ছে না বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে। কিশোর আলোর জন্মদিনের কেক কাটার অনুষ্ঠানে আনিসুল হক বলেন, নতুন করে যেন ফুটবলের জোয়ার ফেরে কলসিন্দুর স্কুলে, সেই স্বপ্ন দেখছেন তিনিও, ‘আমরা সব সময় মেয়েদের ফুটবলের পাশে আছি। বঙ্গমাতা ফুটবল দিয়ে মেয়েরা আবারও মাঠে ফিরবে, সেই প্রত্যাশা আমারও।’