নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকার এম্ভেজে গ্রামে। ম্যান্ডেলার বাবার নাম গাডলা হেনরি এমফাকানিসিওয়া (১৮৮০-১৯৩০)। তিনি ছিলেন থেম্বু গোত্রের প্রধান। এই গোত্র খোসা ভাষায় কথা বলে। ম্যান্ডেলার মা নোসেকেনি ফ্যানি ছিলেন তাঁর স্বামীর তৃতীয় স্ত্রী ।
নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই। তখন ম্যান্ডেলাকে সবাই চিনতেন তাঁর গোত্র নামেই, রোহিলালা।
পিতৃবিয়োগের পর, জঙ্গিনাতাবা ডালিন্ডিয়েবো নামে উচ্চপদস্থ থেম্বু রিজেন্ট দত্তক নেন ম্যান্ডেলাকে। উদ্দেশ্য, থেম্বু ট্রাইবের পরের নেতা হিসেবে ম্যান্ডেলাকে গড়ে পিঠে নেওয়া।
নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৩৯ সালে ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তখনকার আফ্রিকান শিক্ষার্থীদের জন্য একমাত্র পশ্চিমা উচ্চশিক্ষার বন্দোবস্ত সেখানেই ছিল। সেখানেই দেখা হয় বন্ধু এবং ভবিষ্যতের বাণিজ্য সহযোগী (১৯১৭-১৯৯৩) অলিভার টেম্বোর সঙ্গে। দুজনকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি ভঙ্গের অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় ।
নেলসন ম্যান্ডেলা যখন খবর পান বাড়িতে তাঁর বিয়ের তোড়জোড় চলছে, তখন পালিয়ে নাইটগার্ডের চাকরি নেন। পরে আইনের পড়াশোনা শেষ করে, আইনজীবী হিসেবে জীবন শুরু করেন। এরই মধ্যে আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি, যোগ দেন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে।
নেলসন ম্যান্ডেলা ধীরে ধীরে এএনসি (আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস)এর সাথে শক্তভাবে জড়িয়ে পড়েন। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আরও জোরদার করতে শুরু করেন ১৯৫২ সাল থেকে। এই সময়ে বন্ধু অলিভারের সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আইন পরামর্শ কেন্দ্র খোলেন। উদ্দেশ্য ছিল, বর্ণবাদী আইনের শিকার ব্যক্তিদের স্বল্পমূল্যে আইনি সহায়তা দেওয়া। আর ১৯৫৫ সাল থেকে স্বাধীনতার ইশতেহার নিয়ে লোকজনকে বর্ণবাদী আইনের বিরুদ্ধে উজ্জীবিত করতে থাকেন ম্যান্ডেলা।
নেলসন ম্যান্ডেলা সহ আরও ১৫৫ জন আন্দোলনকারীকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ডিসেম্বর ৫, ১৯৫৬তে গ্রেফতার করা হয়। যদিও ১৯৬১ সালে সকলে ছাড়া পেয়ে যান, ততদিনে অন্তর্কলহে দুই দলে ভাগ হয়ে গেছে ম্যান্ডেলার দল। নতুন একটি দল তৈরি হয় ১৯৫৯ সালে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে দুই দলকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বর্ণবাদী সরকার। ম্যান্ডেলা বুঝতে পারেন, এবার ঘোড়ার চাল দেবার পালা।
নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৬১ সালে স্পিয়ার অফ দ্য নেশন নামে এএনসির নতুন একটি সশস্ত্র অংশের নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করেন। এই সময় তিনি বেআইনিভাবে দেশের বাইরে ভ্রমণ করেন। ইথিওপিয়ায় আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী নেতাদের এক সম্মেলনে অংশ নেয়। আলজেরিয়ার পৌঁছে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ও শেষ করেন।
নেলসন ম্যান্ডেলা দেশে ফেরার কিছু পরেই ১৯৬২ সালের পাঁচ আগস্ট, বেআইনিভাবে দেশ ছাড়া ও ১৯৬১ এর শ্রমিক অসন্তোষ উস্কে দেবার অভিযোগে গ্রেফতার হন।
ম্যান্ডেলার বিরুদ্ধে আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং তাঁর ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ষড়যন্ত্রেরর অভিযোগ আনা হয়। প্রমাণ ও হয়, অল্পের জন্য ফাঁসির দড়ি থেকে রেহাই পান তাঁরা। ম্যান্ডেলা ও তাঁর সঙ্গীদের রিভোনিয়া ট্রায়ালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়
নেলসন ম্যান্ডেলা জেলে ছিলেন ২৭ বছর। তাঁর ১৮ বছর কেটেছে রবেন জেলে। কেপ টাউনের একটু দূরে কুষ্ঠ রোগীদের কলোনি ছিল সেটা একসময়। শুধু স্ত্রী উইনি ম্যান্ডেলাকে দেখার অনুমতি ছিল তাঁর। তাও ছমাসে একবার। এর মাঝেই লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের স্নাতক ডিগ্রি পেয়ে যান। নিজের আত্মজীবনী লং ওয়াক টু ফ্রিডম এর ছদ্মবেশে রাজনৈতিক ইশতেহারও বাইরে পাঠান তিনি। ১৯৮২ সালে ম্যান্ডেলাকে মূল ভূখণ্ডের পলসমুর জেলে নিয়ে আসা হয়।
পরের বছর দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এফ ডব্লু ডি ক্লার্ক এএনসির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। তিনি নিজের দলের রক্ষণশীল অংশের সাথে গাঁটছড়া ভেঙ্গে, এক বর্ণবাদবিহীন আফ্রিকার স্বপ্ন দেখান জাতিকে। ফেব্রুয়ারি ১১, ১৯৯০ সালে তাঁর নির্দেশে জেল থেকে ছাড়া পান ম্যান্ডেলা।
নেলসন ম্যান্ডেলা ও ডি ক্লার্ক বর্ণবাদবিহীন আফ্রিকার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের বিভিন্ন অংশের সাথে জোর আলোচনা শুরু করেন। এই আলোচনার জেরেই দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বিদায় নেয় বর্ণবাদী সব আইন ও প্রথা। তাঁদের অবদানের জন্য যৌথভাবে দ্য ক্লার্ক এবং নেলসন ম্যান্ডেলাকে ভূষিত করা হয় নোবেল শান্তি পুরষ্কারে। সময় ছিল ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর।
তার পরের বছরই ভোটকেন্দ্রে দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের ঢল নামে। নেলসন ম্যান্ডেলাকে তাঁরা তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নেন। নেলসন ম্যান্ডেলা ১০ মে ১৯৯৪ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন । তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় নতুন সংবিধান আসে। কেন্দ্রীয় সরকার, আইনের শাসন, গণতন্ত্র ছিল এই সংবিধানের মূল কথা। একই সাথে ছিল, দুর্বলের ওপর অত্যাচার করা যাবেনা, চামড়ার রঙ সাদা বা কালো যাই হোক না কেন।
নেলসন ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্সি ছাড়ার পরেও মানবাধিকার বিষয়ে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। ২০০২ সালে তিনি এইডস সচেতনতা বৃদ্ধিতে মনোযোগী হন। কারণ এই রোগের করাল গ্রাসেই তিনি হারিয়েছিলেন নিজের সন্তান মাকগাথোকে। এই রোগ সম্পর্কে অজ্ঞতা আর কুসংস্কার কারো কাজে আসবেনা, বরঞ্চ সচেতনতাই পারে বিপদের হাত থেকে বাঁচাবে।
ম্যান্ডেলার দেহে ২০০১ সালে প্রস্টেট ক্যান্সার সহ আরো রোগ ধরা পড়ে। তাঁর সম্মানে ২০০৯ সালে ১৮ জুলাই কে ‘নেলসন ম্যান্ডেলা ইন্টারন্যাশনাল ডে’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, শান্তি এবং মানবাধিকারে প্রচুর অবদান রাখায় এই সম্মান। নেলসন ম্যান্ডেলা ৫ ডিসেম্বরের ২০১৩ ফিরে ফিরে আসা ফুসফুসের সংক্রমণে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন