রবি ঠাকুর এক মহাসমুদ্র। যখন যেখানে মণি-মুক্তা পেয়েছেন, কুড়িয়ে এনে সেগুলোর সমাদর করেছেন। পাশ্চাত্য সাহিত্য কিংবা সংগীতের যেমন অনুরক্ত ছিলেন, এ দেশের বাউল ফকিরদের গানেরও সমঝদার ছিলেন। হাসন রাজা, লালন ফকিরদের গানের খাতা তিনি কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, অনুবাদ করে এ দেশের লোকগীতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্ববাসীকেও। তাঁর নিজের বহু গানে লোকসাহিত্যের নির্যাস আছে। আমাদের জাতীয় সংগীতের কথাই ধরো, এ গান শুনে আমাদের চোখ ভিজে আসে, বুক ভরে যায় গর্বে, কিন্তু এ গানের সুরকার কিন্তু কবিগুরু নন। তাহলে কে?
১৮৯০ থেকে ১৯০০ সাল। এই ১০ বছর টানা রবীন্দ্রনাথ কুষ্টিয়ার শিলাইদহে কাটিয়েছেন। এখানে বসে লেখা কবিতা ও গল্পগুলোই রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে মনে করা হয়। রবিঠাকুর তখন শিলাইদহের জমিদার। স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন কুঠিবাড়িতে। একদিন গভীর রাত। রবীন্দ্রনাথ জেগে আছেন। হয়তো লিখছিলেন, কিংবা ভাবনার জগতে ছিলেন নিমগ্ন। হঠাৎ কে যেন গান গেয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঝুলবারান্দায় আসেন। কুঠিবাড়ির সামনে চওড়া গেঁয়ো পথ। সেই পথে গান গেয়ে যাচ্ছে অচেনা শিল্পী। লোকটার হাতে লন্ঠন। দূর থেকে ম্লান আলোয় পুরো চেহারা বোঝা যায় না। গানটা ভারি ভালো লাগে রবি ঠাকুরের। যেমন কথা, তেমনি মিঠে সুর। গায়কিও চমৎকার। পরদিন রবীন্দ্রনাথ জানতে পারেন, রাতে যিনি গান গাইতে গাইতে এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি শিলাইদহ পোস্ট অফিসের ডাকহরকরা। অর্থাৎ রানার। রাতে ডাক নিয়ে ফেরার পথে উচ্চ স্বরে গান গাইতে ভালোবাসেন তিনি। লোকটার নাম গগন। গগন হরকরা।
রবি ঠাকুর একদিন ডেকে পাঠান গগনকে। দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ গগন। বয়সেও রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বেশ বড়। গান তিনি গান, তবে অন্যের লেখা গান নয়। নিজের লেখা, নিজেরই সুর। রবীন্দ্রনাথ আবার শোনেন সেই গান। বড় ভালো লাগে।
বেশ কয়েক বছর, এ দেশের রাজনীতি তখন উত্তাল। ব্রিটিশ সরকার শাসন আর শোষণের সুবিধার্থে বাংলাকে ভেঙে দুভাগ করতে চাইছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথসহ দেশের বহু মানুষ তখন এই বাংলা ভাগের বিপক্ষে অবস্থান নেয়, আন্দোলন করে। সেই আন্দলনের সময় রবীন্দ্রনাথ একটা গান লেখেন। সেটাই এখন আমাদের জাতীয় সংগীত। কিন্তু গানটা রবীন্দ্রনাথ লিখলেও, সুরটা তাঁর নিজের নয়, শিলাইদহের সেই ডাকহরকরা সেই রাতে যে গান গাইতে গাইতে ডাকের বস্তা বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই গানটার সুর বসিয়ে দিলেন আমার সোনার বাংলা গানের গায়ে। পেয়ে গেলাম মন নরম করে দেওয়া আমাদের জাতীয় সংগীতটা। আর গগন হরকরার সেই গানের কথা ছিল:
‘আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে…
হারায়ে সেই মানুষে, কার উদ্দেশে
আমি কার উদ্দেশে বেড়াই ঘুরে…’
যারা অবাক হচ্ছ, তারা কিন্তু ইউটিউবে সার্চ দিয়ে চট করে গানটা শুনে আসতে পারো।