জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তোমাদের যে পদযাত্রা, বিদ্যালয় তার কেন্দ্রবিন্দু। এসএসসি পরীক্ষা তোমার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। যদিও তোমরা এর আগে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছ। এবার দিতে যাচ্ছ মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (এসএসসি)। আমি এ পরীক্ষা নিয়ে কয়েকটি কথা বলতে চাই।
সমান গুরুত্ব দিতে হবে সব বিষয়ে
বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা, মানবিক—এই তিনটি গ্রুপের প্রতিটিরই আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। তাই পাঠ্যসূচির প্রতিটি বিষয় নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। হালকা ধারণা নিয়ে কোনো কিছুর উত্তর লিখলে প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জন ব্যাহত হতে পারে। তাই বারবার রিভিশন দিতে হবে এবং রিভিশন দেওয়ার সময় গুরুত্বপূর্ণ শব্দ বা লাইন আন্ডারলাইন করে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সব লাইন যাতে আন্ডারলাইন করা না হয়, তাহলে এই দাগানো গুরুত্বহীন।
সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে
জ্ঞানমূলক প্রশ্ন
যেকোনো সৃজনশীল প্রশ্নে প্রথমেই থাকবে জ্ঞানমূলক অংশ। এ প্রশ্নের উত্তর সরাসরি বইয়ে থাকে। এরপরও অনেক শিক্ষার্থী এ প্রশ্নের উত্তর দিতে ভুল করে। এ অংশের জন্য বরাদ্দ নম্বর ১। সংজ্ঞা বা কাকে বলে জাতীয় প্রশ্নের উত্তর বানিয়ে লিখলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুল হয়। বিষয়টি তোমাদের খুব করে খেয়াল করতে হবে।
অনুধাবনমূলক প্রশ্ন
এ প্রশ্নের জন্য বরাদ্দ নম্বর ২। এই নম্বরের মধ্যে জ্ঞানমূলক অংশের জন্য ১ ও অনুধাবনমূলক অংশের জন্য ১ বরাদ্দ থাকে। প্রশ্নটি পাঠ্যবইয়ের আলোকে হয়ে থাকে। সাধারণত কী বোঝায় জাতীয় প্রশ্ন থাকে এ অংশে। এ প্রশ্নের উত্তর লেখার সময় যথাযথ ও প্রাসঙ্গিক বাক্য ব্যবহার করা উচিত, অপ্রাসঙ্গিক বাক্য লিখে অহেতুক উত্তরটিকে টেনেটুনে মোটাসোটা করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ ব্যাপারে তোমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
প্রয়োগমূলক প্রশ্ন
একজন শিক্ষার্থী তার অর্জিত জ্ঞান কতটুকু বুঝতে পেরেছে, তা যাচাই করা হয় এ অংশে। এ অংশের জন্য প্রশ্নের মান ৩। এই নম্বরের মধ্যে জ্ঞান যাচাইয়ের জন্য ১, অনুধাবন যাচাইয়ের জন্য ১ ও প্রয়োগ অংশের জন্য ১ নম্বর বরাদ্দ থাকে। বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের বিষয়বস্তুর প্রয়োগ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় এ অংশে।
উচ্চতর দক্ষতা
এ অংশে কোনো বিষয়ের ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ চাওয়া হয়। যুক্তি উপস্থাপনে একজন শিক্ষার্থীর সিদ্ধান্তের সঠিকতা ও সক্ষমতা যাচাই করা হয়। শিক্ষার্থী কোনো সমস্যাকে কীভাবে বিচার–বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করে, তা যাচাই করা হয় এ অংশে।
বাংলা ১ম পত্র
এসএসসি পরীক্ষায় বাংলা প্রথম পত্র পুনর্বিন্যস্ত সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সৃজনশীল অংশে ক বিভাগে নির্ধারিত ১০টি গদ্য থেকে ৪টি, খ বিভাগে ১০টি কবিতা থেকে ৪টি এবং গ বিভাগে উপন্যাস ও নাটক থেকে ২টি করে মোট ১১টি সৃজনশীল প্রশ্ন থাকবে। তোমাকে ৪টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এ ছাড়া ৩০টি বহুনির্বাচনি প্রশ্ন থেকে তোমাকে ১৫টির উত্তর দিতে হবে।
সৃজনশীল পদ্ধতিতে যেকোনো গল্প–কবিতার একটি ভাব বা থিম-এর আলোকে একটি উদ্দীপক ও সংশ্লিষ্ট চারটি অংশ বা প্রশ্ন (জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা) মিলে একটি প্রশ্ন, এখানে একটি উদ্দীপকের উত্তর লেখা শুরু করলে তার চারটি প্রশ্নের উত্তরই ধারাবাহিকভাবে করবে। একটি উদ্দীপকের জ্ঞানের উত্তর আরেক উদ্দীপকের প্রয়োগের উত্তর—এক রকম করা ঠিক নয়।
ইংরেজি ১ম পত্র
ইংরেজি প্রথম পত্রের প্রশ্নের ধরন ও উত্তর লেখার কলাকৌশল নিয়ে দু–একটি কথা—
পার্ট-এ রিডিং টেস্ট, পার্ট-বি রাইটিং পার্ট আকারে প্রশ্ন সাজানো থাকবে। প্রথম অংশে (পার্ট-এ) ৩০ নম্বর থাকবে। এই অংশকে রিডিং টেস্ট বলা হয়। এ অংশে ৩টি জানা (পাঠ্যবই সম্পৃক্ত) প্যাসেজ থাকবে। এ অংশ থেকে ১, ২, ৩, ৪, ৫ ও ৬ নম্বর প্রশ্ন থাকবে।
ক. প্রথম জানা অনুচ্ছেদ (পাঠ্যবই সম্পৃক্ত): এ অনুচ্ছেদ থেকে ১ ও ২ নং প্রশ্ন থাকবে।
প্রশ্ন নম্বর–১–এ বহুনির্বাচনি ৫টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে এবং ২ নম্বর প্রশ্নের মাধ্যমে তোমাদের স্মৃতিশক্তি, অনুধাবন করার ক্ষমতা, সৃষ্টিশীলতা ইত্যাদি মূল্যায়ন করা হয়, প্রদত্ত প্যাসেজ থেকে সরাসরি বাক্য তুলে দিয়ে উত্তর লেখার চেষ্টা করবে না। ৩ নম্বর প্রশ্নে পাঠ্যবই সম্পৃক্ত অনুচ্ছেদের ওপর ভিত্তি করে ১০টি শূন্যস্থান থাকবে। উত্তরপত্রে ধারাবাহিকভাবে শুধু উত্তরগুলো লিখবে, প্রদত্ত প্যাসেজ প্যারাগ্রাফটির পুনর্লিখন করবে না। ৪ নম্বর প্রশ্নে ৪টি বাক্য তৈরি করতে হবে। বাক্যগুলো অর্থপূর্ণ হতে হবে। ৫ নম্বর প্রশ্নে ৬টি শূন্যস্থান থাকবে। সেগুলোকে যথাযথভাবে পূরণ করতে হবে। ৬ নম্বর প্রশ্নে সারমর্ম লেখার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে প্যাসেজের বাইরে কোনো বিষয়ে সারমর্মে যাতে যুক্ত না হয়। ডায়ালগ লেখার ক্ষেত্রে শুধু হাই, হ্যালো, ইয়েস, নো, থ্যাংক ইউ, থ্যাংকস ইত্যাদি ব্যবহারই ডায়ালগ নয়, বরং এগুলোর ব্যবহার বর্জন বা কম হওয়াই ভালো। ডায়ালগটি যেন বাস্তব জীবনের ডায়ালগের মতোই হয়, সেদিকে খেয়াল রাখবে।
ইংরেজি ২য় পত্র
ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে লেখার নিয়মকানুন নিয়ে সংক্ষেপে এখানে আলোচনা করা হলো। আশা করি, তোমাদের কাজে আসবে।
Gap filling activities without clues: শিক্ষার্থীদের Preposition ও article–এর ব্যবহারের দক্ষতা মূল্যায়নের জন্য এ অংশে ১০টি শূন্যস্থানসহ একটি অনুচ্ছেদ দেওয়া থাকবে। সঠিক Preposition ও article ব্যবহার করে শূন্যস্থান পূরণ করতে হবে। যেখানে কোনো article ব্যবহার হবে না, সেখানে zero article, অর্থাৎ x ব্যবহৃত হবে। এ অংশে কোনো clues থাকবে না। শুধু উত্তরগুলো a, b, c, d ...j আকারে লিখবে।
Right form of verbs: এ অংশে ১০টি শূন্যস্থান ও ১৯টি অনুচ্ছেদ থাকবে। শূন্যস্থান পূরণের জন্য বক্সে clue হিসেবে verb দেওয়া থাকবে। verb–এর Right form ব্যবহার করে শূন্যস্থানগুলো পূরণ করবে। Subject-verb-agreement, person, number tense–এর পরিবর্তন ছাড়াও voice–এর Negative form ব্যবহার করবে। এ রকম changing sentences, use of suffix and prefix, making tag questions, use of capitals and punctuation marks—এগুলোতে প্রশ্নপত্রের নির্দেশনা অনুসারে নির্ধারিত সময়ের ভেতরে সব কটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
Writing CV with cover letter: প্রশ্নপত্রের এ অংশে কিছু instruction দেওয়া থাকবে। সে অনুযায়ী উত্তরপত্রের বাঁ পাশের পৃষ্ঠায় cover letter ও ডান পাশের পৃষ্ঠায় cv লিখবে।
Writing formal letter: প্রদত্ত প্রশ্নের এ অংশে সাম্প্রতিক বিষয় বা ঘটনা অথবা কোনো সমস্যার ওপর ভিত্তি করে সমস্যার সমাধান চেয়ে একটি formal letter লিখতে হবে। তবে formal letter–এর পরিবর্তে Notice লিখতে বলা হতে পারে। এ অংশ তোমাদের জন্য নতুন, তাই এ অংশের জন্য ভালো প্রস্তুতি নেবে।
গণিত
তোমরা ইতিমধ্যেই জেনেছ, গণিত বিষয়ে এবার ২ ঘণ্টায় মোট ৫৫ নম্বরের উত্তর দিতে হবে। সৃজনশীল অংশে ১১টি (বীজগণিত ৩টি, জ্যামিতি ৩টি, ত্রিকোণমিতি ও পরিমিতি ৩টি এবং পরিসংখ্যান ২টি) প্রশ্নের মধ্যে যেকোনো ৪টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। প্রতিটি প্রশ্নের মান ১০ (২+৪+৪)। মোট নম্বর ৪০ এবং সময় ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। অপর দিকে বহুনির্বাচনি অংশে ৩০টি (বীজগণিত-৯/১০, জ্যামিতি–৮/৯টি এবং ত্রিকোণমিতি ও পরিমতি-৮/৯টি এবং পরিসংখ্যান-৩/৪টি) প্রশ্নের মধ্যে ১৫টির উত্তর দিতে হবে। প্রতিটি প্রশ্নের মান ১। মোট নম্বর ১৫ এবং সময় ২০ মিনিট।
বহুনির্বাচনি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আলাদা উত্তরপত্র দেওয়া হবে। উত্তরপত্রে রোল নম্বর, রেজিস্ট্রেশন নম্বর, বিষয় কোড স্পষ্ট করে লিখবে। উত্তরপত্র ভাঁজ করা ভাঙা যাবে না। একই প্রশ্নের উত্তরে একাধিক বৃত্ত ভরাট করা যাবে না। জ্যামিতিক চিত্র অবশ্যই শার্প করা পেনসিল দিয়ে পরিষ্কার করে আঁকবে। পরিসংখ্যানে গ্রাফ আঁকবে। গণিত পরীক্ষায় ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে হয়। তোমরা সাধারণ সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে পারো।
পদার্থবিজ্ঞান
পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে নির্ধারিত অধ্যায়গুলো থেকে বহুনির্বাচনি অংশে ২৫টি প্রশ্ন থাকবে। তোমাকে ১৫টির উত্তর দিতে হবে। কম সময়ে যাতে গাণিতিক সমস্যার সমাধান করা যায়, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।
সৃজনশীল অংশে ৮টি প্রশ্নের মধ্য থেকে ৩টির উত্তর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভালো জানা প্রশ্নের উত্তর আগে লেখা ভালো।
গাণিতিক সমস্যা সমাধানে সঠিক একক লিখতে হবে। অবশ্যই আন্তর্জাতিক পদ্ধতির একক ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে চিত্র আঁকা জরুরি। চিত্র অধিক সুন্দর হওয়ার চেয়ে শুদ্ধ হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। চিত্র আঁকতে যাতে বেশি সময় নষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখবে। রাশির একক লিখতে কোনো প্রতীক বড় হাতের, কোনোটা ছোট হাতের অক্ষর হয়, সেদিকে ভালো করে খেয়াল রাখতে হবে। লেখা শেষ করে খাতাটি একবার ভালো করে রিভিশন দেবে। ভুল থাকলে ঠিক করে নেবে।
জীববিজ্ঞান
জীববিজ্ঞানে প্রচুর চিত্র থাকে। অনেক সময় পরীক্ষায়ও চিত্রগুলো আঁকতে হয়। কম সময়ে চিত্রগুলো আঁকার জন্য বারবার অনুশীলন করতে হয়। মনে রাখবে, চিত্র অধিক সুন্দর হওয়ার চেয়ে অধিক শুদ্ধ হওয়া জরুরি। চিত্রের চিহ্নিতকরণ যেন সঠিক হয়, সেদিকে খেয়াল রাখবে। বহুনির্বাচনি অংশে ভালো নম্বরের জন্য সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ের সংশ্লিষ্ট সংজ্ঞাবিশিষ্ট উদাহরণ, চিত্রের বিভিন্ন অংশ ভালোভাবে পড়বে। সৃজনশীল অংশে জীবনপাঠ, জীবকোষ ও টিস্যু, জীবনীশক্তি, খাদ্য, পুষ্টি ও পরিপাক, জীবে পরিবহন, রেচন প্রক্রিয়া, জীবের প্রজনন, জীবের বংশগতি ও বিবর্তন অধ্যায়গুলো যত্নসহ পড়বে।
রসায়ন
যথারীতি অন্য বিষয়ের মতো রসায়নের পরীক্ষাটাও সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হবে। ১৫টি বহুনির্বাচনি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে তোমাদের। সৃজনশীল অংশে ৮টি প্রশ্ন থাকবে ৩টির উত্তর দিতে হবে। পদার্থের গঠন অধ্যায়ের ইলেকট্রন–প্রোটন, শক্তিস্তরে ইলেকট্রনের বিন্যাস ভালো করে দেখে নেবে। পর্যায় সারণি অধ্যায়ের শ্রেণি নির্ণয়, পর্যায় নির্ণয় ভালো করে পড়বে। খনিজ সম্পদ অধ্যায়ের প্রাকৃতিক গ্যাস, পলিমার, হাইড্রোকার্বন অ্যালডিহাইড ও অ্যালকোহলের ধর্ম ভালো করে পড়তে হবে। চতুর্থ অধ্যায়ে পারমাণবিক সংখ্যা, ইলেকট্রন বিন্যাস সঠিকভাবে জানা না থাকলে পর্যায়ে সারণিতে মৌলের অবস্থান নির্ণয় করা যাবে না। তাই এ দুটি বিষয় ভালো করে আয়ত্তে আনতে হবে। উত্তর লেখা শেষে অবশ্যই রিভিশন দেবে।
সবশেষে বলব, এসএসসি পরীক্ষা তোমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। এ পরীক্ষার শিক্ষা ও ভালো ফল তোমার আগামী পথ চলতে এবং উচ্চশিক্ষায় কাজে লাগবে। সব বিষয়েই ভালো ফল করতে হবে। শুধু পরীক্ষা পাসের জন্য নয়। প্রকৃত মানুষ হওয়াই যেন শিক্ষার মূল লক্ষ্য হয়। খুব ভারী ভারী কথা বলে ফেললাম। সহজ করে নাও। জীবন সহজ হয়ে যাবে। ভালো মানুষ হবে এবং ভালো ফল করবে। তোমাদের জন্য এ প্রত্যাশা ও শুভকামনা রইল।