ইংরেজিতে ‘পিকচার পারফেক্ট’ বলে একটা কথা আছে। এর তরজমা করলে দাঁড়ায়, বাঁধাই করে রাখা ছবির মতন নিখুঁত! ক্রিকেটে এর একটা সমার্থক শব্দ আছে, ‘পারফেক্ট ১০’, অর্থাৎ বল হাতে ১০ উইকেট, একাই প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে দেওয়া যাকে বলে। পারফেক্ট ১০ এতটাই কঠিন যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত মাত্র তিনজন ছুঁতে পেরেছেন সে রেকর্ড। আর নিজের জন্মভূমিতে তাঁদেরই একজন হলেন এজাজ প্যাটেল।
এজাজ প্যাটেলের ক্যারিয়ারটা বেশ বড় নয়। বয়সের কাঁটা ৩৩ ছুঁলেও তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার মাত্র ৩ বছরের। নিউজিল্যান্ড দলে স্পিনারদের জায়গা বড্ড কম। তাদের ক্রিকেটে যে হারে পেসার উঠে আসে, ঠিক সেভাবে জায়গা হয় না স্পিনারদের। এক ডেনিয়েল ভেট্টোরি ছাড়া নামকরা স্পিনার কিউইদের নেই বললেই চলে। সেখানে এজাজকে উঠে আসতে হয়েছে বলতে গেলে কাঠামোর বিপরীতে লড়াই করে, পেসারদের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে।
অথচ সেই এজাজই আন্তর্জাতিক মঞ্চে এসে ছাড়িয়ে গিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের সব তারকাকে। নিজের নাম লিখেছেন গিনেস বুকে। মাত্র ১১ টেস্ট খেলা এজাজ যদি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারকে ‘টা টা, বাই বাই’ও বলে দেন, তাতেও তাঁর গল্প করার মতন ইতিহাসের অভাব হবে না।
এজাজ প্যাটেলের অভিষেক হয়েছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে। অভিষেকেই ৫ উইকেট নিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানকে ৪ রানে হারানো ম্যাচে শেষ উইকেটটাও ছিল তাঁর। দেশের বাইরে যতই ভালো করেন না কেন, দেশের ভেতরে ঠিক সে সুযোগ হয় না এজাজের। এমনিতেই স্পিনারদের জন্য পিচে কিছু থাকে না, তার ওপরে তাঁর থেকে ইশ সোধির কার্যকারিতাও বেশি। তবে দেশের বাইরে তিনি ‘অটোমেটিক চয়েস’ হয়ে উঠছেন দিন দিন।
উপমহাদেশের মাটি বাঁহাতি স্লো স্পিনারদের জন্য স্বর্গ। শ্রীলঙ্কার মাটিতে ২ টেস্টে ৯ উইকেট। নিউজিল্যান্ডে ফিরে আবারও উইকেট–খরা। এজাজের জন্য ধরনটা বেশ বোধগম্য হয়ে যাচ্ছিল। বিদেশের মাটিতে বাঘ, দেশের মাটিতে বিড়াল। ইংল্যান্ডের মাটিতে ২২ বছর পর সিরিজ জয়েও প্রত্যক্ষ অবদান তাঁরই। কিন্তু ভারতে এসে যে এ কাণ্ড করে বসবেন, তা হয়তো ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি কেউ।
কানপুরে প্রথম ম্যাচে দুই ইনিংস মিলিয়ে নিয়েছিলেন ১০ উইকেট। বল হাতে ঠিকঠাক কাজটা শেষ করার পর প্রতিরোধ গড়েছিলেন ব্যাট হাতেও। রাচিন রবীন্দ্রের সঙ্গে শেষ উইকেট জুটিতে টিকে ছিলেন ১০ ওভার! একের পর এক টার্নে যেখানে পরাস্ত হয়েছেন নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা, সেখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এজাজ প্যাটেল। নিউজিল্যান্ডকে এনে দিয়েছেন ড্র।
দ্বিতীয় টেস্ট, মুম্বাই। মুম্বাইয়ের সঙ্গে এজাজের সম্পর্কটা আলাদা। এই আলো-বাতাসে তাঁর জন্ম, এই আলো-বাতাসে বেড়ে উঠেছেন, স্বপ্ন দেখেছেন ক্রিকেটার হওয়ার। ২৫ বছর পর সেই মাটিতেই ফিরেছেন তিনি নিউজিল্যান্ডের হয়ে। কে ভেবেছিল এই মুম্বাইয়েই ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাবেন এজাজ?
প্রথম দিনে খুশি ছিলেন চার উইকেট নিয়েই। নিজের বাবা-মায়ের সামনে এক ওভারে চেতেশ্বর পূজারা আর বিরাট কোহলিকে ফিরিয়ে বেশ উৎফুল্লই ছিলেন। ৬ উইকেট নেওয়া পর্যন্ত সবটা ঠিকঠাকই ছিল। একদিকে ‘ওয়াল’ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মায়াঙ্ক আগারওয়াল। দেড় শ করে আউট হওয়ার পরই রেকর্ড যেন হাতছানি দিয়ে ডাকা শুরু করল এজাজ প্যাটেলকে। অক্ষর প্যাটেলকে আউটটা দিতে চাননি আম্পায়ার। রিভিউ নিয়ে ঠিকই সঠিক সিদ্ধান্ত বের করে এনেছিল নিউজিল্যান্ড। রেকর্ড আর এজাজের মধ্যে পার্থক্য শুধু উইলিয়াম সামারসেটের এক ওভার। বড্ড সাবধানী এক ওভার করলেন তিনি। বল উইকেটের আশপাশেই যেতে দেননি।
১০৯ নম্বর ওভার, এজাজ প্যাটেলের ৪৮ নম্বর ওভার। দ্বিতীয় বলেই উড়িয়ে মেরে রাচিনের হাতে বন্দী জয়ন্ত যাদব। পঞ্চম বল, সিরাজও উড়িয়ে মারতে চাইলেন এজাজকে। আবারও রাচিনের হাতে বন্দী বল। সেই সঙ্গেই ইতিহাসে নাম লেখালেন এজাজ প্যাটেল।
ক্রিকেট ইতিহাসে ৮০ বছর লেগেছিল প্রথমবারের মতন ১০ উইকেট দেখতে। ১৯৫৬ সালে অ্যাশেজে ইংলিশ অফ স্পিনার জিম লেকার প্রথমবারের মতো নিয়েছিলেন ১০ উইকেট। এর প্রায় ৪০ বছর পর ১৯৯৯ সালে এসে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১০ উইকেট নিয়ে কীর্তি গড়েছিলেন অনিল কুম্বলে। তাঁদের দুজনের রেকর্ডই ছিল দ্বিতীয় ইনিংসে। আর তারও ২২ বছর পর এজাজ প্যাটেল রেকর্ড গড়লেন সেই ভারতের বিপক্ষেই।
প্রথম দুই ম্যাচকে এক সূত্রে বেঁধেছিলেন এক ইংলিশ ব্যবসায়ী রিচার্ড স্টোকস। ১৯৫৬ সালে বাবার সঙ্গে ১০ বছর বয়সী স্টোকস গিয়েছিলেন ওল্ড ট্রাফোর্ডে অ্যাশেজ দেখতে। তাঁর সামনেই ১০ উইকেটের রেকর্ড গড়েছিলেন জিম লেকার। এর ৪৩ বছর পর ব্যবসার কাজে ভারত এসেছিলেন রিচার্ড স্টোকস। কাজ শেষে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে একবার ঢুঁ দিয়ে যাবেন ভেবেছিলেন। সেখানে বসেই সাক্ষী হয়েছিলেন অনিল কুম্বলের ১০ উইকেটের! হয়েছিলেন মাঠে বসে জিম লেকার আর অনিল কুম্বলের ১০ উইকেট দেখা একমাত্র ব্যক্তি!
এবার অবশ্য সে চিন্তা নেই। ভারতের কোচ রাহুল দ্রাবিড় আর ম্যাচ রেফারি শ্রীশান্ত—দুজনেই ছিলেন সেই ম্যাচে কুম্বলের সতীর্থ। এজাজের রেকর্ডটা মাঠেই বসেই দেখেছেন তাঁরা।
প্রথম দিন শেষে একটা ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল টুইটারে। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের অনার্স বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছেন এজাজ প্যাটেল। সেখানে নাম লেখাতে দরকার ছিল মাত্র ১ উইকেট। এজাজ হয়তো সেদিন স্বপ্নেও ভাবেননি, শুধু এ তালিকায় নয়, তার নামটা লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। ইতিহাসের এ পাতায় নাম যে মাত্র তিনজনের। মাত্র ১১ টেস্ট খেলা এজাজের কাছে আজ অলীক স্বপ্নটাই সত্যি।
ক্রিকেটকে বলা হয় গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। ব্যাট-বলের খেলায় যত সময় গড়ায়, ততই রোমাঞ্চ চক্রাকারে বাড়ে। আর সেই ফরম্যাট যখন হয় ৫ দিনের টেস্ট ক্রিকেট, তখন তো আর কথাই নেই। তিন মাস ধরে ক্রিকেট বিশ্ব ছিল টি-টোয়েন্টি জ্বরে আক্রান্ত। প্রথমে আইপিএল, এরপর টি-২০ বিশ্বকাপ। ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাটকে পাশে পেয়ে আসল ক্রিকেটের স্বাদটাই ভুলতে বসেছিল বিশ্ব। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট মাঠে ফিরতেই বোঝা গেল, ব্যস্ত পৃথিবীতে এর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়তে পারে, কিন্তু বৈচিত্র্য সেই আগের মতোই। এখানে ইতিহাসে নাম লেখাতে ধৈর্য ধরে শুধু টিকে থাকতে হয়। এজাজ ইউনুস প্যাটেল সে প্রমাণই দিলেন।