‘মা, আজ আমার স্কুল ছুটি। তোমার সঙ্গে কাজে যাব।’
মা যতই বোঝানোর চেষ্টা করেন, ‘মাঠে ধান লাগানোর কাজ তোমার না।’ মেয়ে ততই মায়ের সঙ্গে যাওয়ার বায়না ধরে। মাকে অল্প সময়ের জন্য হলেও সুখী করার সে কী চেষ্টা মেয়ের!
মায়ের জন্য এমন ভালোবাসা বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক মারিয়া মান্দার। চার বছর ধরে নিয়মিত খেলছেন এএফসি ও সাফের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে। ময়মনসিংহের মন্দিরগোনা গ্রাম থেকে উঠে আসা এই মিডফিল্ডার হয়ে উঠেছেন বয়সভিত্তিক ও জাতীয় দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঢাকায় গত বছরের ডিসেম্বরে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টের ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ, মেয়েদের ফুটবল ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সাফের ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরেছিলেন অধিনায়ক মারিয়া। এরপর গত অক্টোবরে ভুটানে সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। এই দলেরও অধিনায়ক মারিয়া। গত সেপ্টেম্বরে ঢাকায় মেয়েদের এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বের প্রথম রাউন্ডে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ, মারিয়া সেখানেও আর্মব্যান্ড পরেই খেলেছেন। বাংলাদেশের মেয়েদের গত কয়েক বছরের আন্তর্জাতিক সাফল্যে ময়মনসিংহের এই কিশোরীর অবদান মোটেও কম নয়।
ছোটবেলা থেকেই মারিয়া মাঠে লড়াই করছেন প্রতিপক্ষের সঙ্গে। মাঠের বাইরেও লড়ছেন জীবনের সঙ্গে। যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তেন, তখন মারিয়ার বাবা মারা যান। বাবার চেহারা কেমন ছিল, একটুও মনে নেই। বাবার একটা ছবিও নেই যে দেখবেন মারিয়া। কখনো বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করলে মায়ের মুখটা সবার আগে মনে পড়ে মারিয়ার। বাবা বীরেন্দ্র মারাত যখন মারা যান, তখন ছোট ভাই দানিয়েল মান্দা ছিল মায়ের গর্ভে। সেই থেকে মারিয়াদের চার ভাইবোনকে নিয়ে মা এনতা মান্দার লড়াইটা শুরু। এখনো সেই একইভাবে লড়ে যাচ্ছেন মারিয়ার মা। মারিয়ার মা এনতা মান্দা ধানের মৌসুমে ধান লাগান, মৌসুম শেষে ধান কাটার কাজ করেন। এ জন্য দিনে ২০০ টাকা পারিশ্রমিক পান। এর বাইরে অন্যের বাড়িতে গিয়েও গৃহকর্মীর কাজ করেন। অনেক কষ্টে মারিয়ার বড় বোন হাসি মান্দাকে বিয়ে দিয়েছেন। মেজ বোন পাপিয়া মান্দাও মায়ের সঙ্গে কৃষিকাজ করেন। তবে ছোট ছেলে দানিয়েল মান্দাকে লেখাপড়া করাচ্ছেন মারিয়া। নিজের পড়াশোনাটাও চালিয়ে যাচ্ছেন কলসিন্দুর স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী।
অবশ্য এবার বোধ হয় মারিয়াদের দুঃখ কিছুটা হলেও ঘুচবে। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ বাছাইপর্বের প্রথম রাউন্ডে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুবাদে এই দলের সবাইকে গত অক্টোবরে ১০ লাখ করে টাকা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টাকা পেয়ে উচ্ছ্বসিত মারিয়া বলছিলেন, ‘মাকে আর অন্যের জমিতে কাজ করতে দেব না। এলাকায় নিজেদের কিছু জমি কিনব। একটা ভালো বাড়ি করতে চাই আমি।’
শুধু ১০ লাখ টাকা নয়, মায়ের জন্য দামি শাড়িও উপহার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। উচ্ছ্বসিত মারিয়ার কথা, ‘এগুলো তো শুধুই আমাদের সাফল্যের জন্য। যেহেতু আমরা ফুটবলে ভালো ফল করছি তাই তো আমাদের টাকা দিয়েছেন। আমরা অনেক খুশি। আমরা চেষ্টা করব ভবিষ্যতে আরও ভালো খেলতে। আমরা এভাবে বারবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে চাই।’
ফুটবল খেলার সুবাদে ময়মনসিংহের কলসিন্দুর এবং মারিয়াদের গ্রাম মন্দিরগোনায় বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। কিন্তু কলসিন্দুর স্কুলটা এখনো সরকারি হয়নি। প্রধানমন্ত্রীকে আদর করে নানু ডাকেন মারিয়া। ওই অনুষ্ঠানে অধিকার থেকেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে করেছিলেন আরেকটি আবদার। ওই দিন বলেছিলেন, ‘নানু, আমাদের স্কুলটা এখনো সরকারি হয়নি।’ এটা শুনে প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দেন, ‘সরকারি হয়ে যাবে স্কুল।’
মারিয়াদের এই অর্জন এক দিনে হয়নি। ছোটবেলায় যখন খেলতে যেতেন, মায়ের কাছে একজোড়া বুট জুতা কিনে দেওয়ার আবদার করেছিলেন একদিন। মারিয়ার মা এক জোড়া বুট কিনতে গিয়ে সেদিনের খাবারের চাল বেচে দিয়েছিলেন। এখন সে কথা মনে হলে ভীষণ কান্না পায় মারিয়ার। আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘এখন আমি চাইলে এক দোকান সাজিয়ে ফেলতে পারব বুট দিয়ে!’
ফুটবল মারিয়াকে অনেক বদলে দিয়েছে। আগে মানুষ মোটেও গুরুত্ব দিত না মারিয়াদের। যখন কলসিন্দুর স্কুলে মফিজ স্যারের কাছে ফুটবলের অনুশীলন করতেন, গ্রামের অন্যরা নানা সমালোচনা করত। বাজে কথা শুনতে হতো। মারিয়াদের গ্রামের নেতাই নদে সেতু ছিল না। নদী পার হতে নৌকা দরকার হতো। বিশেষ করে বেশি সমস্যা হতো মারিয়ার। খুব ভোরে খেলতে যেতে হতো তাকে। এখন ভালো খেলে বলে সবাই চেনে তাকে। মাঝি মারিয়ার জন্য নৌকা রেখে দেন।
মার্কেটে শপিংয়ে গেলেও তারকাদের মতো ভিড় লেগে যায় মারিয়াকে নিয়ে ছবি তুলতে। গর্বভরে সেই কথা বলছিলেন মারিয়া, ‘যখন কোথাও বেড়াতে যাই দূর থেকে ডেকে বলে, ওই যে মারিয়া যাচ্ছে। আমার সঙ্গে সেলফি তোলে। এটা অনেক ভালো লাগে। নিজেকে তারকা মনে হয়। তখন মনে হয়, মানুষ আমাকে এতটা ভালোবাসে, এ জন্যই আরও ভালো খেলতে হবে।’
মারিয়াকে ফুটবলার বানানোর পেছনে বড় অবদান মায়ের। যখন কলসিন্দুর স্কুলে মফিজ স্যারের কাছে মারিয়ারা ফুটবলের অনুশীলন করতেন গ্রামের অন্যরা নানা সমালোচনা করত। অনেক বাবা-মা পড়াশোনার ক্ষতি হওয়ার ভয়ে মেয়েদের খেলতে পাঠাতে চাইতেন না। কিন্তু মারিয়ার মা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কখনো যদি অনুশীলনে যেতে দেরি হতো, বকাবকি শুরু করে দিতেন তাঁর মা।
মতিঝিলের বাফুফে ভবনে বছরজুড়ে অনুশীলনে থাকেন মারিয়াসহ অন্য ফুটবলাররা। অনেক সময় ঈদ, পূজা, ক্রিস্টমাস ক্যাম্পেই কেটে যায়। এ জন্য মাঝে মাঝে একটু খারাপ লাগে মারিয়ার। কিন্তু সেসব ভুলে শুধু দেশের জন্য খেলতে পারার আনন্দটা মনের মধ্যে পুষে রাখেন, ‘আমাদের সামনে খেলা থাকলে এমনিতেই ছুটি দেন না স্যাররা। ভালো কিছু করতে হলে কষ্ট তো করতেই হবে। আমাদের লক্ষ্যই থাকে ভালো কিছু করা। গতবার ক্রিস্টমাসে ছুটি পাইনি। বাড়িতে যেতে পারব না ভেবে প্রথমে একটু মন খারাপ হতো। কিন্তু পরক্ষণই নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম, আমি তো দেশের প্রতিনিধিত্ব করছি। আমার জার্সিতে থাকে লাল–সবুজের পতাকা। আমার কাছে সবার আগে বাংলাদেশের পতাকা। দেশের জন্য কিছু করতে পারলেই নিজের কাছে ভালো লাগে। তখন মনে হয় উত্সব তো এ বছর না হলে আগামী বছরও পাব। কিন্তু এই খেলাটা তো পাওয়া যাবে না। সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে তাই অনুশীলনে মন দিই।’
বাংলাদেশের জার্সি পরার গর্বের কথা আনন্দের সঙ্গেই বলছিলেন মারিয়া, ‘চাইলেই অনেকে এটা পরতে পারেন না। যখন আমি এই লাল-সবুজ জার্সিটা পরি, ভীষণ গর্ব হয়। তখন শুধু একটা কথাই মনে হয়, আমি দেশের জন্য খেলতে এসেছি। আমার লক্ষ্য থাকে ভালো খেলা। যখন মাঠে নামি আর যখন জাতীয় সংগীত বাজতে শুরু করে, তখন আমার শরীরে অন্য রকম শিহরণ জাগে। অনুভূতিটা কেমন হয়, সেটা বলে বোঝাতে পারব না। তখন একটা কথাই মনে হয়, আমি দেশের জন্য খেলছি, যেটা নিয়ে আমি সারা জীবন গর্ব করতে পারব।’
ফুটবল মারিয়ার হৃদয়জুড়ে। মারিয়ার স্বপ্ন একটাই। সেই স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে মারিয়ার চোখেমুখে খেলা করে রোমাঞ্চ, ‘জাতীয় দলের পাশাপাশি আমি বিদেশি ক্লাবে খেলতে চাই। আমি স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের মেয়েরা একদিন বিশ্বকাপে খেলবে।’