গত দশকের মাঝামাঝি থেকে রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থন করছে, এমন কারও জন্য দলের প্রিয় খেলোয়াড়ের বিদায় নতুন কিছু নয়। এই দশকের সাত বছরে নিজেদের ইতিহাসের সেরা তিন তারকাকে বিদায় বলেছে রিয়াল। চোখের জলে, সাংবাদিকদের সামনে কান্নাভেজা চোখে রিয়ালকে বিদায় বলেছেন তাঁরা। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সে সুযোগটাও হয়নি। বিশ্বকাপের মাঝপথে কোনো কিছু ছাড়াই বিদায় নিয়েছেন তিনি। সার্জিও রামোস তা–ও ঘটা করে বিদায় নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তারপরও রামোসের বিদায়টা রিয়াল সমর্থকদের জন্য আগের দুই বিদায়ের থেকেও বেশি আবেগের।
ইকার ক্যাসিয়াস ছিলেন রিয়ালের ঘরের মানুষ, রিয়ালেই তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা, রিয়ালেই তাঁর সর্বকালের সেরা হয়ে ওঠা। সবকিছুই রিয়ালের জার্সিতে। তাঁর বিদায়টা হঠাৎ ছিল না। বরং আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। চোটের পর ফর্ম হারিয়েছিলেন, দলেও জায়গা হারিয়েছিলেন। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা তিনি থাকতে থাকতেও শুরু হয়েছিল। ক্যাসিয়াসও আপত্তি জানাননি, নিজে থেকেই সরে গিয়েছেন।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ব্যাপারটা আরও আলাদা। রোনালদো রিয়ালের ধারেকাছের কেউ ছিলেন না। রিয়ালে জিততেই তিনি এসেছিলেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে সব জিতে রিয়ালে এসেছিলেন নিজের ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ করতে। ব্যালন ডি’অর জিতে রিয়ালে এসেছিলেন রিয়ালকে সর্বসেরা করতে। বীরের বেশে বার্নাব্যুতে এসেছিলেন, ছেড়েছেন রাজা হয়ে। চ্যাম্পিয়নস লিগ, লা লিগা, ব্যালন ডি’অর; ক্লাব ক্যারিয়ারে একজন খেলোয়াড় যত কিছু জিততে পারেন, সবকিছুই জিতেছিলেন তিনি। সর্বজয়ী হওয়ার পর রোনালদোর বিদায়টা আকস্মিক ছিল, কিন্তু অবাক করার মতো নয়। রোনালদো আজীবন চ্যালেঞ্জের পেছনে ছুটেছেন। রিয়ালে সব জেতার পর নতুন চ্যালেঞ্জের খোঁজ করবেন, এমনটাই স্বাভাবিক ছিল। খুঁজে পেয়ে চলেও গিয়েছেন!
সার্জিও রামোস ওপরের কোনোটাই ছিলেন না। রিয়ালে যখন আসেন, তখন তিনি না ছিলেন রিয়ালের ঘরের কেউ, না ছিলেন কোনো চ্যাম্পিয়ন। তিনি এসেছিলেন রিয়ালের বিপক্ষে গোল করে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে রাউল, জিদান, ফিগো, রবার্তো কার্লোস, বেকহাম, ইকার ক্যাসিয়াসের মন জয় করে। সার্জিও রামোসের সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের ফাঁকি দিয়ে বল জালে জড়িয়েছিলেন রামোস। সেদিনই তাঁকে দেখে মনে ধরেছিল সবার। অল্প বয়সী সেই ছেলেটাই যখন সেভিয়া প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে বললেন, আমি সেভিয়ার অধিনায়ক হতে চাই; হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তাই রামোস রিয়ালে এসেছিলেন নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে।
রামোস তখনো জানতেন না রিয়ালে কীভাবে মানিয়ে নিতে হয়। মানিয়ে নেওয়া দূরে থাক, মাইক যে টেনে বড়-ছোট করা যায় প্রেজেন্টেশনের দিন, জানতেন না সেটাও। প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ এগিয়ে এসে ঠিক করে দিয়েছিলেন মাইক। কে জানত, সেদিনের সেই লম্বা চুলের ছোকড়া রিয়ালের প্রত্যেক সমর্থকের হৃদয়ে জায়গা করে নেবে?
সার্জিও রামোস রিয়ালের জার্সিতে প্রতিটা মুহূর্তে শিখেছেন। তিনি জানতেন, রিয়ালে তাঁকে জায়গা করে নিতে হবে পারফরম্যান্স দিয়ে। সে জন্য প্রতিটা মুহূর্তে মনোযোগী ছাত্রের মতন শিখেছেন। কখনো রাউল, কখনোবা ক্যাসিয়াসের কাছ থেকে। গ্যালাক্টিকোসের প্রথম স্প্যানিশ ইনক্লুশন ছিলেন তিনি। গ্যালাক্টিকোস ভেঙে গেছে, রামোস রয়ে গিয়েছিলেন স্প্যানিশ কোরের সঙ্গে। ২০০৯ সালে এসে যখন রাউল-গুতি বিদায় জানালেন রিয়ালকে, তখন সহ-অধিনায়কের দায়িত্বটা এসে পড়ল সার্জিও রামোসের ওপর। চার বছর হয়েছে রিয়ালের জার্সি গায়ে জড়িয়েছেন, এর মধ্যেই সহ–অধিনায়কের দায়িত্ব! রামোস ভয় পাননি, বরং সামলেছেন শক্ত হাতে। স্পেন জাতীয় দলে পুয়োলের কাছ থেকে শিখেছেন, কীভাবে লিডার হতে হয়, কীভাবে বিপদে মাথা ঠান্ডা রেখে দলকে জেতাতে হয়।
এর মধ্যেই হোসে মরিনহো এসে পুরোদুস্তুর পরিবর্তন করে দিলেন রামোসকে। রামোস-পেপেকে নিয়ে প্রচলন করলেন ‘ডার্টি ফুটবল’। দলের প্রয়োজনে প্রতিপক্ষের জীবন নিতেও প্রস্তুত যেন তাঁরা। ফুটবলটা শুধু মাঠের নয়, মনের খেলাও; সেটা শিখিয়ে গেলেন মরিনহো। শুকনা ভিতু সার্জিও রামোসকে যোদ্ধা হিসেবে তৈরি করানোর সূচনা সেখানেই।
কিন্তু কথায় আছে, বাস্তব অভিজ্ঞতার থেকে বড় অভিজ্ঞতা আর কিছুতেই নেই। রামোস সেই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন ১২-১৩ মৌসুমে। সেমিফাইনালে পেনাল্টি শুটআউটে গিয়ে হারতে হয়েছিল রিয়ালকে। পেনাল্টি মিস করেছিলেন সার্জিও রামোস। সেদিন ক্যাসিয়াসকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে কথা দিয়েছিলেন, আরেকটা চ্যাম্পিয়নস লিগ ক্যাসিয়াসের হাতে তুলে দেবেনই তিনি।
ভাগ্য সাহসীদের পক্ষে থাকে, রামোসও সেই সাহসীদের তালিকাতেই ছিলেন। এক বছর পরেও সে সুযোগটা এল রামোসের কাছে। সেমিফাইনালে নিজেদের মাঠে হুংকার দিয়েছিলেন বায়ার্নের খেলোয়াড়েরা, এখানে এলে দেখে নেব। তাদেরই মাটিতে গিয়ে রামোস দেখিয়েছেন, কীভাবে খেলতে হয়। ৪ মিনিটের ব্যবধানে ২ গোল করে বায়ার্নকে জানিয়ে দিলেন, এই রামোস আর আগের রামোস নেই, এই রামোস এসেছেন জিততে। রিয়ালকে জেতাতে।
পরের গল্পটা রামোসকে নিয়ে বলা সবচেয়ে পরিচিত গল্প। লিসবনে ৯০ মিনিট শেষ, রেফারি বাঁশি মুখে নিয়ে আছেন বাজাবেন বলে। রিয়ালের এক যুগ চ্যাম্পিয়নস লিগ না পাওয়ার অপেক্ষা আরও বাড়তে চলেছে। সবটা যখন সন্নিকটে, তখন আবির্ভূত হলেন সার্জিও রামোস। অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের ইনজুরি টাইমে গোল করে ‘৯২.৪৮’–কে স্মরণীয় করে ফেললেন রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের জন্য।
১৬ বছর পর রিয়াল মাদ্রিদকে বিদায় বললেন সার্জিও রামোস। বিদায়ের ক্ষণে পেছনে ফিরে সমর্থকেরা দেখলেন, সব অর্জনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছে রামোসের নাম। বাইরে থেকে দেখে কেউই বলতে পারবেন না এই লোকটা রিয়াল মাদ্রিদের একান্ত কেউ নন। রিয়ালের আর্মব্যান্ড হাতে নিয়ে তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা সার্জিও রামোস রিয়াল একাডেমির কেউ ছিলেন না। পথে চলতে চলতে নিজের সেরা বন্ধুকে হারিয়েছেন, অধিনায়কের আর্মব্যান্ড চড়েছে তাঁর হাতে। তিনি হয়ে উঠেছেন রিয়ালের কিংবদন্তি।
১০৯৯ দিন টানা চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী অধিনায়ক ছিলেন রামোস। রিয়ালে যখন এসেছিলেন, তখন সব শিরোপা হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনা। সে সময়ে একজন ‘আউটসাইডার’ থেকে রিয়াল ডিফেন্সের স্তম্ভ হয়েছেন তিনি। দিনে দিনে হয়েছেন দিগ্বিজয়ী, রিয়ালের জার্সিতে একজন ডিফেন্ডারের পক্ষে যা যা জেতা সম্ভব জিতেছেন সব, নিজের নামের পাশে রেখেছেন ১০১ গোল, যা ইনিয়েস্তা-জিদানও নিজেদের ক্লাবের হয়ে করতে পারেননি। যে জিদানের সঙ্গে মাঠে দৌড়েছেন, তাঁর কোচিংয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন।
সার্জিও রামোস মাত্র ১৯ বছর বয়সে যে স্বপ্ন নিয়ে রিয়ালে প্রবেশ করেছিলেন, ৩৫ বছর বয়সে সে স্বপ্ন পূরণ করে বেরিয়েছেন। এই গল্পটা সর্বজয়ী অধিনায়কের নয়, বরং ১৯ বছর বয়সী সেই ছোট্ট ছেলেটারও, যে কিনা সেভিয়া প্রেসিডেন্টের কাছে হাসির পাত্র হয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল, একদিন সমগ্র স্পেনের অধিনায়ক হবে সে। লক্ষ্যছোঁয়া সেই যুবকের গল্প এটি।
সময়ের সঙ্গে বদলায় রং। সার্জিও রামোসের গায়ে থাকা শুভ্র সাদা জার্সিটাও তেমনই নীল হয়ে গিয়েছে। মাদ্রিদ সমর্থকদের কাছে সেই নীলকে মনে হতে পারে বেদনার নীল। প্যারিস সেইন্ট-জার্মেইন বিনা পয়সাতেই ভিড়িয়েছে তাঁকে। ডান হাতায় চ্যাম্পিয়নস লিগের লোগো নেই, বাঁ হাতে আর্মব্যান্ড নেই; গায়ে সাদা জার্সিটাও নেই। রামোসের গায়ে ভিন্ন দলের জার্সি—ব্যাপারটা একটু অদ্ভুতই লাগে ফুটবল ভক্তদের কাছে। পিএসজির সার্জিও এক বদলে যাওয়া সার্জিও। চ্যালেঞ্জ নিতে স্পেন ছেড়ে ফ্রান্সে যাওয়া সার্জিও। আর সেই সার্জিও রামোসই এখন যে সবার কাছে ‘নিউ নরমাল’!