দুবাইয়ের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মঞ্চে অ্যারন ফিঞ্চ যখন বিশ্বকাপের ট্রফিটা হাতে পেলেন, এর ঠিক এক মাস আগেও অস্ট্রেলিয়াকে বিশ্বকাপের হট ফেবারিট ভাবেননি কেউই! যদিও ঐতিহাসিকভাবে যেকোনো টুর্নামেন্টেই ফেবারিট হিসেবে থাকে অস্ট্রেলিয়া, কিন্তু এবারের আসরের শুরুতে তাদের ডার্ক-হর্স বললেই বরং ঠিক শোনাচ্ছিল। তাদের গল্পটা শেষের জন্য তোলা থাকুক। শুরু করা যাক প্রথমবার টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে আসা নামিবিয়া, পাপুয়া নিউগিনিদের নিয়ে।
দীর্ঘ বাছাইপর্ব প্রক্রিয়া পার হয়ে আইসিসির সহযোগী দেশগুলো সুযোগ পায় বিশ্বকাপের মূল মঞ্চে খেলার। নামিবিয়া কিংবা পাপুয়া নিউগিনির মতো র৵াঙ্কিংয়ের নিচের দিকে থাকা দলগুলোর জন্য এই যাত্রা আরও লম্বা। একেবারে আঞ্চলিক কোয়ালিফায়ার থেকে ধীরে ধীরে বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ার পার হয়ে অবশেষে দলগুলো অর্জন করেছিল এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের টিকিট। গ্রুপ পর্বে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় কোয়ালিফায়ার থেকে আসা আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ওমান, স্কটল্যান্ডের পাশাপাশি টি–টোয়েন্টি র৵াঙ্কিংয়ের নবম ও দশম দল যথাক্রমে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ।
গ্রুপ রাউন্ডের ফেবারিট হিসেবে শ্রীলঙ্কা উড়ন্ত সূচনা করলেও বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচেই হেরে যায় স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে। শেষ দুটি ম্যাচ জিতে সুপার টুয়েলভে পা রাখলেও তেমন সুবিধা করতে পারেনি টাইগাররা। এ পর্বে কোনো ম্যাচ না জেতার পাশাপাশি দুবার ১০০ রানের নিচে অলআউট হওয়ার লজ্জাও পেতে হয় বাংলাদেশকে। প্রায় ভুলে যাওয়ার মতো এক টুর্নামেন্ট গেলেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হিসেবে সাকিব আল হাসানের নাম মনে রাখবে ক্রিকেট বিশ্ব।
প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে আসা দেশগুলোর মধ্যে আনকোরা পাপুয়া নিউগিনি কোনো ম্যাচ জিততে না পারলেও চমক দেখায় নামিবিয়া। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ হারলেও আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচ জিতে তারা সুপার টুয়েলভ নিশ্চিত করে। প্রথমবার আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার মাত্র দুই বছরের মাথায় বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভে ভারত, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ডের মতো দলগুলোর সঙ্গে ম্যাচ খেলার যোগ্যতা অর্জন করা নিঃসন্দেহে বিরাট মাইলফলক। শুধু সেখানেই থেমে থাকেনি তারা। ক্যাপ্টেন ইরাসমাসের নেতৃত্বে খেলতে আসা দলটি সুপার টুয়েলভ রাউন্ডে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে একটি ম্যাচও জিতে নেয়। পুরো টুর্নামেন্টে দারুণ খেলে নামিবিয়ার হয়ে আলো ছড়িয়েছেন ডেভিড ভিসা, স্মিত, ট্রাম্পেলমেনরা।
ওদিকে বড় দলগুলোর বিশ্বকাপ শুরু হয় সুপার টুয়েলভ রাউন্ড থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের অতিরিক্ত গরম এবং নিচু উইকেটে ধরেই নেওয়া হয়েছিল বিপরীত কন্ডিশনে অভ্যস্ত নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এমনকি ইংল্যান্ডও বেশ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। সাম্প্রতিক টি-টোয়েন্টি পারফরম্যান্সের কারণে ইংল্যান্ডকে ফেবারিটের তালিকায় রাখলেও অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের নাম ওপরের দিকে ছিল না। বরং সেখানে ভারত ও পাকিস্তানকেই এগিয়ে রাখা হচ্ছিল। সুপার টুয়েলভ রাউন্ড শুরুর পর খানিকটা ভিন্ন চিত্র চোখে পড়ল। ইংল্যান্ড ও পাকিস্তান ফেবারিটের মতো খেললেও একেবারেই নিজেদের সুনামের বিচার করতে পারেনি ভারত।
বিরাট কোহলির যোদ্ধারা প্রথম ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের কাছে ১০ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে হারার পর, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গেও হেরে যায় ৮ উইকেটে। ভারতের বিদায় প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায় প্রথম দুই ম্যাচ শেষে। যদিও শেষ তিন ম্যাচ জিতে তারা বিভিন্ন সমীকরণে সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্ন দেখছিল, কিন্তু উইলিয়ামসনের নিউজিল্যান্ড সেই সুযোগ দেয়নি।
পাকিস্তান ও ইংল্যান্ডের দাপট ছিল চোখে পড়ার মতো। বোলিং-ব্যাটিং-ফিল্ডিং সব দিকেই একের পর এক বিপক্ষ দলকে ধরাশায়ী করে তারা পৌঁছে যায় সেমিফাইনালে। ইংল্যান্ডের হয়ে জস বাটলার যেমন ছিলেন অনন্য, পাকিস্তানের ওপেনিং জুটি রিজওয়ান-বাবর আজমও ছিলেন টুর্নামেন্ট সেরা।
ওদিকে একেবারেই পাদপ্রদীপের আড়ালে থাকা অস্ট্রেলিয়া অনেকটা নিভৃতে যেন নিজেদের কাজ করে গেছে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বড় পরাজয়ের পরও নিজেদের রানরেট মেরামত করে, একই পয়েন্ট পাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকাকে পেছনে ফেলে সেমিফাইনাল খেলে ক্যাঙারুরা। একেবারেই অফ ফর্মে থাকা ডেভিড ওয়ার্নার ব্যাট হাতে পথ দেখান অজিদের, বল হাতে হ্যাজলউড-স্টার্ক-কামিন্স-জাম্পাও ছিলেন সমান উজ্জ্বল। কন্ডিশন ও ফেবারিটের তকমাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দল হিসেবে তাঁরা জ্বলে উঠেছেন ঠিক সময়ে।
ঠিক একইভাবে সেমিফাইনালেও অপরাজিত পাকিস্তানের সঙ্গে প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচ জিতে নেয় তারা। ১৭৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৯২ রানে পাঁচ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ার বিদায় ধরে নিয়েছিল সবাই। ক্রিজে থাকা স্টয়নিস-ওয়েডের জুটি যেন তখন কেবল ব্যবধান কমাচ্ছিল! কিন্তু সব হিসাব–নিকাশ পাল্টে দেন ম্যাথু ওয়েড। ম্যাচের শেষ ১৮ বলে জেতার জন্য প্রয়োজন ৩৭ রান। পুরো টুর্নামেন্টে ভালো করা পাকিস্তানের পেসারদের যেন পাড়ার বোলার বানিয়ে পেটাতে লাগলেন। দুটো চার এবং চার ছক্কায় সাজানো মাত্র ১৭ বলে ৪১ রানের ইনিংস দিয়ে ওয়েড প্রায় অসম্ভব ম্যাচ জিতিয়ে ফাইনালে তোলেন অস্ট্রেলিয়াকে।
ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিপক্ষ প্রতিবেশী নিউজিল্যান্ড। কিউইরাও সেমিফাইনালে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা আরেক ফেবারিট ইংল্যান্ডকে থামিয়ে এসেছে। ক্রিকেট বিশ্ব তাই অপেক্ষায় ছিল আগুন ঝরানো এক ফাইনালের। কিন্তু শুরুতে সেমিফাইনাল জয়ের নায়ক ওপেনার ড্যারিল মিচেলের উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে ব্ল্যাকক্যাপরা। তবে সেই ধাক্কা সামলে নিয়ে ইনিংস মেরামত করেন উইলিয়ামসন। সাধারণত ধীরলয়ে ব্যাট করা উইলিয়ামসন সেদিন অজি পেসার মিচেল স্টার্ককে তুলোধুনো করে প্রায় ১৭৭ স্ট্রাইকরেটে ৪৮ বলে সংগ্রহ করেন ৮৫ রান। আর কাপ্তানের ব্যাটে চড়ে তাদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১৭২।
ইনিংস বিরতিতে নিউজিল্যান্ডকে আগাম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে দিচ্ছিল অনেকে। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপ যেন ক্রিকেটের অনিশ্চয়তার রং ফোটাবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। বোল্ট-সাউদিদের নিয়ে গড়া আসরের অন্যতম সেরা বোলিং লাইনআপকে যেন পাত্তাই দিলেন না ডেভিড ওয়ার্নার ও মিচেল মার্শ! স্রেফ হেসে-খেলে সাত বল হাতে রেখে ১৭৩ রানের লক্ষ্য ছুঁয়ে ফেলে তারা।
ক্রিকেট যে দলগত খেলা, সেটা যেন আবারও প্রতিষ্ঠিত হলো। প্রয়োজনের মুহূর্তে কখনো জাম্পা, কখনো মার্শ, কখনো ওয়েড সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন, সমানে সমান লড়াই করেছেন প্রতিপক্ষের সঙ্গে, পাশ থেকে তাঁদের শক্তি জুগিয়ে গেছেন ওয়ার্নার, হ্যাজলউড, ফিঞ্চ, স্টয়নিসরা। তারই ফলাফল হিসেবে মাত্র এক মাস আগেও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে সন্দিহান থাকা ক্রিকেট বিশ্ব সাক্ষী হলো তাদের বিশ্বকাপ জয়ের। রেকর্ড বুকে অ্যারন ফিঞ্চের নামও উঠল অজিদের প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক হিসেবে।