ইউরোপ না লাতিন আমেরিকা—ফুটবলে ঠিক কারা এগিয়ে? আন্তর্জাতিক ফুটবল নিয়ে বন্ধুদের তর্কে প্রায়ই উঠে আসে এই কথা। পৃথিবীর দুই প্রান্তে পুরোপুরি দুই ভিন্ন ঘরানার ফুটবলের মধ্যে সেরা আসলে কারা?
এই প্রশ্নের উত্তর বের করার একমাত্র উপায় বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ বাদে ইউরোপ-দক্ষিণ আমেরিকার দলগুলোর মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। মাঝেমধ্যে দু-একটা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ হয় অবশ্য, কিন্তু সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয় কমই। তাহলে এই প্রশ্নের উত্তর কী? সমাধান খুঁজে বের করতেই প্রায় ২৯ বছর পুরোনো এক টুর্নামেন্টকে আবার উজ্জীবিত করেছে উয়েফা আর কনমেবল। ম্যাচটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘লা ফিনালিসিমা’। ২ জুন রাত ১২ টা ৪৫ মিনিটে সেই শিরোপার লড়াইয়ে মুখোমুখি হবে কোপা আমেরিকাজয়ী আর্জেন্টিনা আর ইউরোজয়ী ইতালি।
‘লা ফিনালিসিমা’র ইতিহাস অবশ্য আজকের নয়। আগেও দুবার মাঠে গড়িয়েছে এই টুর্নামেন্ট। তখন অবশ্য এই টুর্নামেন্টের নাম ছিল ‘আরতেমিও ফাচ্চি কাপ’। উয়েফার সাবেক সভাপতি ও ইতালিয়ান ফুটবল সংগঠক আরতেমিও ফাচ্চির নামানুসারে নাম দেওয়া হয়েছিল এই টুর্নামেন্টের। কথা ছিল এক আসর হবে ইউরোপে, পরেরটা দক্ষিণ আমেরিকায়।
সে অনুযায়ী ১৯৮৫ সালে প্রথমবারের মতো মাঠে গড়ায় ‘আরতেমিও ফাচ্চি কাপ’। সেবার ইউরোজয়ী স্বাগতিক ফ্রান্সের মুখোমুখি হয়েছিল কোপা আমেরিকাজয়ী উরুগুয়ে। তারকাখচিত ফ্রান্স দল হেসেখেলে জিতে নিয়েছিল সে ম্যাচ। ২-০ গোলের জয়ে গোলদাতা ছিলেন হোসে তুরে ও দমিনিক রকেতু।
৪ বছর পর ১৯৮৯ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ‘আরতেমিও ফাচ্চি কাপ’-এর দ্বিতীয় আসর। কিন্তু সেবারের ইউরো ও কোপাজয়ী দুই দল নেদারল্যান্ডস ও উরুগুয়ে নিজেদের মধ্যকার ম্যাচের সময়ই ঠিক করতে পারেনি। ফলে দ্বিতীয় আসর বসবে বসবে করেও আর বসেনি।
আট বছর পরে ১৯৯৩ সালে আবারও মাঠে গড়ায় ‘আরতেমিও ফাচ্চি কাপ’-এর দ্বিতীয় আসর। দক্ষিণ আমেরিকায় সেবার মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা ও ডেনমার্ক। তবে প্রথমবারের মতো এবারে অবশ্য ট্রফি হাতছাড়া করেনি লাতিন আমেরিকা। নির্ধারিত সময়ে ১-১ গোলে ম্যাচ শেষ হওয়ায় ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। আর সেখানে ফাইনালের গোলদাতা ক্যানেজিয়া পেনাল্টি মিস করলেও গোলরক্ষক গয়কোচিয়ার অসাধারণ পাফরম্যান্সের কাছে হার মানতে হয় ডেনমার্ককে। ‘আরতেমিও ফাচ্চি কাপ’-এর ব্যবধান নিয়ে আসেন ১-১এ। আর সেটাই ছিল খেলোয়াড় হিসেবে ডিয়েগো ম্যারাডোনার শেষ শিরোপা।
চার বছর পর ‘আরতেমিও ফাচ্চি কাপ’-এর তৃতীয় আসর বসার কথা থাকলেও বাদ সাধে ফিফা। বরং প্রতিটি মহাদেশের সেরা দলগুলোকে নিয়ে চালু করে নতুন টুর্নামেন্ট ‘কনফেডারেশনস কাপ’। ১৯৯৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কনফেডারেশনস কাপের ৮টি আসর অনুষ্ঠিত হওয়ার পর এই টুর্নামেন্টের রাশ টেনে ধরে ফিফা। ২০১৯ সালে টুর্নামেন্টটি বিলুপ্ত ঘোষণা করলে আবারও কথা ওঠে ‘আরতেমিও ফাচ্চি কাপ’-এর। আর সে অনুযায়ীই নতুন নামে ফিরিয়ে আনা হয়েছে ২৯ বছর পুরোনো এক টুর্নামেন্ট।
তবে টুর্নামেন্ট ২৯ বছর পুরোনো হলে কী হবে, এর উত্তেজনায় ভাটা পড়েনি বিন্দুমাত্র। ‘ইউরোপ না লাতিন আমেরিকা?’—এই প্রশ্নে নতুন করে মেতে ওঠার সুযোগ করে দিচ্ছে ‘লা ফিনালিসিমা’।
তবে এবারের দুই ফাইনালিস্ট মুখোমুখি হচ্ছে পুরোপুরি ভিন্ন দুই প্রস্তুতি নিয়ে। একদিকে ইতালি মাঠে নামবে নিজেদের সমর্থকদের একটু হাসিমুখের জন্য। ২০১৮ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ হয়নি তাদের। বুকে একটা চাপা কষ্ট ছিলই। সে কষ্টে প্রলেপ দিয়েছেন কোচ রবার্তো মানচিনি। তাঁর হাত ধরে নিজেদের পুরোপুরি বদলে ফেলেছিল ইতালি। জিতে নিয়েছিল ইউরো। কিন্তু এরপরও বিশ্বকাপে জায়গা করে নিতে পারেনি আজ্জুরিরা। উত্তর মেসিডোনিয়ার সঙ্গে হেরে বিশ্বকাপের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়েছে তাদের। বিশ্বকাপের আগের এই টুর্নামেন্ট তাদের সমর্থকদের একটু খুশি করার উপায়মাত্র।
অন্যদিকে আর্জেন্টিনা আছে তাদের সর্বকালের সেরা ফর্মে। টানা ৩২ ম্যাচ অপরাজিত, ২৯ বছর পর কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপার দেখা; লিওনেল স্কালোনির অধীনে নিজেদের অনেকটাই শাণিত করে নিয়েছে লিওনেল মেসির দল। সব মিলিয়ে ফর্মের তুঙ্গে তারা। তাই তাদের জন্য টুর্নামেন্টটা বিশ্বকাপের প্রস্তুতি। এমনিতে ইউরোপের দলগুলোর সঙ্গে খুব একটা খেলা হয় না তাদের। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপের আগে নিজেদের শাণিয়ে নেওয়ার সেরা সুযোগ এটাই। আর সেটা নিতেই উন্মুখ হয়ে আছে মেসি-দিবালারা।
আজ রাতেই ওয়েম্বলিতে উত্তর মিলবে শ্রেষ্ঠত্বের। মেসি-দি মারিয়া নাকি বোনুচ্চি-কিয়েল্লিনি; কাদের হাতে উঠবে নতুন মোড়কে পুরোনো এই শিরোপা?