উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের খেলার আগে এমনিতেই উত্তেজনায় থাকেন ফুটবলপ্রেমীরা। সেই উত্তেজনার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয় একটা থিম সং বা আবহ সংগীত—দ্য চ্যাম্পিয়নস। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের এ থিম সং শুনলেই নড়েচড়ে বসেন ফুটবলপ্রেমীরা। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ইউরোপের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ এ টুর্নামেন্টের খেলার সূচনা হয় এ থিম সংয়ের মাধ্যমে।
প্রতিবছর ইউরোপের লিগ শুরুর এক মাস পর থেকেই শুরু হয় চ্যাম্পিয়নস লিগ। ইউরোপে থাকা দেশগুলোর সেরা দলগুলোকে নিয়ে অনুষ্ঠিত এ টুর্নামেন্টের আবেদনই আলাদা। মাঝেমধ্যে বহু পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর দেখা হয় এ টুর্নামেন্টে। যেমন ধরো রিয়াল মাদ্রিদ-বায়ার্ন মিউনিখ, চ্যাম্পিয়নস লিগে এতবার মুখোমুখি হয়েছে যে তাদের নাম হয়ে গেছে ‘ইউরোপিয়ান রাইভাল’। শুধু কী তাই? মাঝেমধ্যে দেখা যায়, আন্ডারডগ কোনো দল রথী-মহারথীদের হারিয়ে জায়গা করে নিয়েছে শেষ চারে। কখনো শিরোপাও ঘরে তুলে নেয় তারা।
কিন্তু আজকের গল্পটা কোনো দল কিংবা চ্যাম্পিয়নস লিগের নয়, বরং ‘দ্য চ্যাম্পিয়নস’ নিয়ে। চ্যাম্পিয়নস লিগের সংগীত নিয়ে। চ্যাম্পিয়নস লিগের সংগীত নিয়ে ভাবনা শুরু হয়েছিল ‘চ্যাম্পিয়নস লিগ’ নামকরণের পর থেকে। ১৯৫৬ সাল থেকে প্রতিবছর নিয়ম করে চলছে চ্যাম্পিয়নস লিগ। কিন্তু এর আগে এর নাম চ্যাম্পিয়নস লিগ ছিল না। বরং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এ টুর্নামেন্টের নাম ছিল ইউরোপিয়ান কাপ। অর্থাৎ ইউরোপের কাপ। কিন্তু ১৯৯১ সালে এসে উয়েফা, ইউরোপিয়ান ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা এসে নাক গলায়। তাদের মনে হয়, এ টুর্নামেন্টের যেমন অবস্থা চলছে, তেমনটা থাকলে জনপ্রিয়তা বাড়বে না। তাই নতুন করে এ টুর্নামেন্টের সূচনা করতে হবে। যে কারণে খোলনলচে বদলে ফেলা শুরু হলো। ফ্রেঞ্চ ফুটবলার গ্যাব্রিয়েল হ্যানোট ও ফ্রেঞ্চ সাংবাদিক জ্যাকস ফেরানের মূল পরিকল্পনা ছিল ইউরোপিয়ান কাপ। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সান্তিয়াগো বার্নাব্যু। তাঁদের পরিকল্পনায় মাঠে নামে ইউরোপিয়ান কাপ। অনেকেই সে সময় বিরোধিতা করেছিলেন, কিন্তু তা ধোপে টেকেনি।
১৯৯১ সালে এসে উয়েফা তাদের মার্কেটিং টিমের সঙ্গে এক হয়ে রিব্র্যান্ডিংয়ের প্রস্তাব দেয়। যে প্রস্তাবে বদলে যায় ইউরোপিয়ান কাপের শিরোপা, লোগো, এমনকি নামও। ইউরোপিয়ান কাপ এক মৌসুমের মধ্যে হয়ে যায় উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ। আর নতুন করে শুরু হওয়া চ্যাম্পিয়নস লিগে নতুন দর্শকও আনা প্রয়োজন। সে জন্যই শুরু হলো চ্যাম্পিয়নস লিগের অ্যান্থেম বা থিম মিউজিকের খোঁজ।
সে জন্য ডেকে আনা হয় ব্রিটিশ মিউজিক কম্পোজার টনি ব্রিটেনকে। টনির চোখেমুখে তখন রাজকীয় কিছু করার স্বপ্ন। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘চ্যাম্পিয়নস লিগ তখন নতুন করে শুরু হয়েছে, কিন্তু প্ল্যাটফর্ম আগে থেকেই ছিল। আর এর থিম সং করতে গেলে সে রকমই কিছু একটা দরকার ছিল। রাজকীয় একটা ছোঁয়া, শক্তিতে ভরপুর একটা থিম। আর সে জন্য একটা রেফারেন্সও প্রয়োজন।’ চ্যাম্পিয়নস লিগ থিমের রেফারেন্স হিসেবে তাই দাঁড় করানো হলো জর্জ ফ্রেডরিক হ্যান্ডেলের ‘জ্যাডক দ্য প্রিস্ট’ থিমকে। ১৭২৭ সালে কিং দ্বিতীয় জর্জকে রাজ্যাভিষেক করার সময় এ থিম পরিবেশন করা হয় প্রথম। এরপর থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে রাজ্যাভিষেক করতে হলেই এ থিম পরিবেশন করা হয়ে থাকে। শেষবার এ থিম ব্রিটিশ মহলে বেজেছিল রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের সময়, ২ জুন, ১৯৫৩ সালে।
জ্যাডক দ্য প্রিস্ট
সেই ‘জ্যাডক দ্য প্রিস্ট’কে সামনে রেখেই চ্যাম্পিয়নস লিগ অ্যান্থেম বানাতে শুরু করলেন টনি ব্রিটেন। শুরুর কিছুটা অংশ নিয়ে বাকি অংশ সাজালেন নিজের মতো করে। এরপর লন্ডনের রয়্যাল ফিলাহার্মোনিক অর্কেস্ট্রায় প্রথম রেকর্ড করা হলো সেই সুর। ‘একাডেমি অব সেন্ট মার্টিন ইন দ্য ফিল্ডস’–এর কোরাস দল প্রথম রেকর্ড করে সেই অবিস্মরণীয় সুর। শুধু তা–ই নয়, মোট তিন ভাষায় লেখা হয় এই লিরিক। উয়েফা–স্বীকৃত তিন ভাষা—ইংলিশ, জার্মান আর ফ্রেঞ্চ। সেই সঙ্গে সবচেয়ে আইকনিক লাইন ‘Die Meister! Die Besten! Les Grandes Équipes! The Champions!’
তিন মিনিটের থিম সংয়ে দুটি ছোট পঙ্ক্তি আর একটা কোরাস থাকে। এ ছাড়া দুই দল মাঠে প্রবেশের সময় আলাদা অ্যান্থেম বাজে, যেটাও মূল থিম সংয়ের অংশ। আর পুরো গান শোনা যায় শুধু ফাইনালে। ম্যাচ শুরুর আগে হওয়া কনসার্টে সেই দেশের ভাষায় পুরো গান শোনানো হয়।
বলা বাহুল্য, এ অ্যান্থেমের আরেকটি ভার্সনও রয়েছে। সেটির সুর করেছেন এই সময়ের বিখ্যাত মিউজিক কম্পোজার হ্যান্স জিমার। তাঁর এই সুর প্রথম শোনা গিয়েছিল ‘ইএ গেমস’–এর ভিডিও গেম ‘ফিফা ১৯’–এর ট্রেলারে। সে বছরই প্রথম ‘কোনামি’র ভিডিও গেম ‘প্রো ইভল্যুশন সকার’ বা ‘পেস’–এর কাছ থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগের স্বত্ব কিনে নেয় ইএ। এরপর থেকে ফিফা গেমসে চ্যাম্পিয়নস লিগের মূল অ্যান্থেমের ভিন্ন আয়োজন শোনা যায়। তবে সেটা শুধু ওই গেমের মধ্যেই।
আর সেই ১৯৯২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত টিভি পর্দায় প্রতিটি চ্যাম্পিয়নস লিগ ম্যাচের আগে বেজে ওঠে সেই সুর। যে সুর জানিয়ে দেয়, ইউরোপের রাজা ঠিক করতে এসেছি আমরা। পুরোনো রাজাকে সরিয়ে নতুন রাজার রাজ্যাভিষেক করতে প্রস্তুত ইউরোপ। নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে হয় মুকুট টিকিয়ে রাখো, নইলে বিসর্জন দাও নতুন কারও মাথায়।