২০১৮ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের কথা, ইউরোপিয়ান অঞ্চলের প্লে-অফ ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল ইতালি-সুইডেন। ইউরোপের বড় সব দল ইতিমধ্যে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে জায়গা নিশ্চিত করেছে বিশ্বকাপে। শুধু চারবারের চ্যাম্পিয়ন ইতালিকেই দিতে হচ্ছে প্লে-অফের অগ্নিপরীক্ষা। ইতালি যেন তখন জৌলুশ হারানো এক ইতিহাসের নাম। প্লে-অফে সুইডেনের কাছে হেরে বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ হারাল তারা। কিংবদন্তি গোলকিপার জিয়ানলুইজি বুফন সেই কষ্ট সহ্য না করতে পেরে অবসরই নিলেন জাতীয় দল থেকে।
অনেকে ইতালির শেষ দেখেছিলেন সেখানেই। তাঁদের মতে, এককালের দাপুটে হাঙ্গেরি, সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো ইতালিরও ঠাঁই থাকবে কেবল ইতিহাসে। রবার্তো মানচিনিকে তাই বিশাল এক প্রত্যাশা মেটানোর ভার ঘাড়ে নিয়ে আজ্জুরিদের কোচ হতে হলো।
আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনির গল্পটাও কাছাকাছি। রাশিয়া বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে ফ্রান্সের কাছে হেরে বিদায় নিয়েছিল মেসির দল। একসময়ের প্রতাপশালী লাতিন আমেরিকার দলটির জন্য এমন বিদায় ভক্তদের আদালতে অপরাধের শামিল। ভঙ্গুর সেই দলের হাল ধরেছিলেন স্কালোনি। ১৯৯৩ সালের পর আর কোনো রকম ট্রফি না জেতা আর্জেন্টিনার ভক্তরা অসীম অপেক্ষার চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়েই চলেছেন! সর্বকালের সেরাদের একজন লিওনেল মেসি কি একবারের জন্যও দেশের জার্সি গায়ে ট্রফির আনন্দে মাতবেন না?
সদ্য শেষ হওয়া ইউরো ও কোপা আমেরিকার দুই চ্যাম্পিয়নের গল্প যেন উপন্যাসের মতো। হাজার বাধা অতিক্রম করে, পতনের শেষ সীমায় বারবার মুখ থুবড়ে পড়া থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে অবশেষে তারা জয়ী।
জুন-জুলাই মাস সাধারণ ফুটবল–ভক্তদের জন্য অন্য রকম আমেজের সময়। ক্লাব ফুটবলের রং তুলে পছন্দের সব প্রিয় তারকা জাতীয় দলের জার্সি গায়ে মাঠে নামেন। কখনো বাছাইপর্বের ম্যাচে, কখনো বিশ্বকাপ কিংবা মহাদেশীয় প্রতিযোগিতায়। চার বছর পর হওয়া বিশ্বকাপ–জ্বর যেমন প্রবল হয়, ইউরো–জ্বরও তেমনই! প্রায় এক মাসজুড়ে ফুটবলভক্তরা মন খুলে উপভোগ করলেন সুন্দর এবং টান টান উত্তেজনাময় খেলা।
৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ইতালির রোমে শুরু হওয়া এবারের ইউরো ছিল অন্যবারের চেয়ে আলাদা। নির্দিষ্ট কোনো স্বাগতিক দেশের বদলে ১১টি দেশ এবারের আয়োজক। কোভিডের মহামারি জয় করে বহুদিন পর দর্শকেরাও ফিরলেন মাঠে। ২০ দলের টুর্নামেন্ট যেন পূর্ণতা পেল এতে।
ইংল্যান্ড, স্পেন, বেলজিয়াম ফেবারিট হয়ে ইউরো শুরু করল। কিন্তু সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল গ্রুপ এফ, যেখানে রয়েছে ফ্রান্স, পর্তুগাল ও জার্মানির মতো তিন পরাশক্তি। এদের সঙ্গে ছোট দল হিসেবে থাকা হাঙ্গেরিও কম যায় না। ফ্রান্স আর জার্মানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়াই করে ড্র করেছে তারা।
চমক দেওয়ার সামর্থ্যে ইউরোপের ছোট দলগুলোর জুড়ি মেলা ভার। প্রথমবার ইউরো খেলতে আসা ফিনল্যান্ড যেমন নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমে জয় তুলে নিল ডেনমার্কের বিরুদ্ধে। তবে ওই ম্যাচের কথা দর্শকেরা মনে রাখবেন ক্রিশ্চিয়ান এরিকসনের জন্য। ম্যাচ চলাকালে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আক্রান্ত হয়ে মাঠের মধ্যেই পড়ে যান এরিকসন। দুঃসহ সেই সময়ে এরিকসনকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন দুই দলের খেলোয়াড়েরা, মাঠে উপস্থিত সমর্থক এবং স্ক্রিনের সামনে বসে থাকা অগণিত দর্শক। দুই দলের খেলোয়াড়, রেফারিসহ মেডিকেল কর্মীদের তাৎক্ষণিক বুদ্ধিদীপ্ততায় এরিকসনের হাসিমুখ আবার দেখা গেল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দেয়ালে দেয়ালে।
এ ঘটনা যেন ডেনিশদের মনোবলে অন্য এক মাত্রা জুড়ে দিল। প্রথম দুই ম্যাচ হেরে খাদের কিনারে চলে যাওয়া ডেনমার্ক সব সমীকরণ ভেঙে শেষ ম্যাচে দাপুটে জয় তুলে নিল। তারপর রূপকথার মতো উড়ে চলল তারা। একে একে রাউন্ড অব সিক্সটিন, কোয়ার্টার ফাইনালের বাধা পেরিয়ে সেমিফাইনালে মুখোমুখি হলো ইংল্যান্ডের। সমানে সমান লড়াই করেও বিতর্কিত এক পেনাল্টি তাদের জয়রথ থামায়। কিন্তু তাতে কি? আন্ডারডগ হিসেবে টুর্নামেন্ট শুরু করা ডেনিশরা দলের মূল তারকা এরিকসনকে ছাড়া এত দূর পাড়ি দেওয়ার পর এখন সবার চোখে সমীহের পাত্র।
একই রকম সমীহ জাগিয়েছে সুইজারল্যান্ড, চেক রিপাবলিকও। মধ্যম সারির দল হিসেবে খেলতে আসা সুইসরা দুর্দান্ত এক ম্যাচে হারিয়েছে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে। অন্যদিকে চেক রিপাবলিক যেন ছেলেখেলা করেছে আরেক পরাশক্তি নেদারল্যান্ডসকে নিয়ে। এই দুটি দল কোয়ার্টার ফাইনালেও খেলেছে চমক দেখানো ফুটবল। কেবল ভাগ্য সহায় ছিল না তাদের। চেক রিপাবলিককে একাই টেনে নেওয়া পাত্রিক শিককে দর্শকেরা বহুদিন মনে রাখবেন মাঝমাঠ থেকে তাঁর চমকে দেওয়া গোল করার জন্য।
টুর্নামেন্টের সবচেয়ে উত্তেজনাকর ম্যাচটি ছিল রাউন্ড অব সিক্সটিনে, স্পেন বনাম ক্রোয়েশিয়ার মধ্যে। সময়ের পরতে পরতে চমক দেখিয়েছে দুই দলই। তাই তো স্কোরলাইন ৫-৩, এটি ইউরোর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গোল হওয়া ম্যাচের একটি।
২০১৮-এর বিশ্বকাপ যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের কাছে ইংল্যান্ডের ফাইনালে ওঠা তেমন চমকপ্রদ না–ও লাগতে পারে। সেবার বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলা ইংলিশরা এবার নিজেদের ঘরের মাঠে ফাইনালে ওঠার পথে খেলেছে ফেবারিটের মতো। সে জন্য তাঁদের ঘিরে ভক্তদের প্রত্যাশার কমতি ছিল না। ‘ইটস কামিং হোম’ স্লোগানে পথঘাট, গ্যালারি সর্বত্র মুখর করেছিলেন সমর্থকেরা। তা নিয়ে অবশ্য কম বিদ্রূপ করেননি আরেক ফাইনালিস্ট ইতালির ভক্তরা, প্রতি উত্তরে তাঁরাও গেয়েছেন ‘ইটস কামিং রোম’।
ইতালি অবশ্য শুরু থেকেই সুন্দর ফুটবলের পসরা নিয়ে এগিয়েছে। কিন্তু মাত্র দুই বছর আগেও বিশ্বকাপে উঠতে ব্যর্থ হওয়া আজ্জুরিদের ফাইনালিস্ট হিসেবে ভাবেননি অনেক ফুটবলবোদ্ধাই। কোচ রবার্তো মানচিনির হাত ধরে বদলে যাওয়া দোননারুমা, ইনসিনিয়ে, বনুচ্চি, কিয়েলিনিরা যেন বুড়ো আঙুল দেখালেন তাঁদের। আন্ডারডগ হিসেবে টুর্নামেন্ট শুরুর পর আস্তে আস্তে গায়ে তুলে নিয়েছে ফেবারিটের তকমা। তারপর নকআউট রাউন্ডে একে একে টুর্নামেন্টের হট ফেবারিট বেলজিয়াম, স্পেন আর ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে শিরোপা জিতে নিল তারা। বছর দুয়েক আগেও বাতিলের খাতায় চলে যাওয়া দলটি হতে পারে যেকোনো মনোবল হারানো ব্যক্তির বাস্তব অনুপ্রেরণা।
দাপটের সঙ্গে হারানো ফুটবল–সাম্রাজ্য উদ্ধার করেছে ইতালি। আর যোদ্ধা হিসেবে স্ট্রাইকার ইমোবিল থেকে গোলকিপার দোননারুমা, মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কোচ রবার্তো মানচিনি—সবারই এতে সমান অবদান। কোয়ার্টার ফাইনালে রোমেলু লুকাকুর পেনাল্টি, সেমিফাইনাল ও ফাইনালের টাইব্রেকারে প্রতিপক্ষের মোট তিনটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে নায়কোচিত অবদান রেখেছেন দোননারুমা। তাই ১৯৯২ সালে কিংবদন্তি পিটার স্মাইকেলের পর গোলকিপার হিসেবে প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট জিতেছেন জিয়ানলুইজি দোননারুমা। ওদিকে মাত্র চার ম্যাচে ৫ গোল করে গোল্ডেন বুট জিতেছেন পর্তুগালের ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।
ইতালির ঐতিহাসিক পুনরুত্থানের আগে অবশ্য আরেকটি ঐতিহাসিক ফাইনালে হয়েছে, দক্ষিণ আমেরিকার মহাদেশীয় ফুটবল প্রতিযোগিতা কোপা আমেরিকায়। লাতিন আমেরিকার সৌন্দর্যময় ফুটবলের দূত হিসেবে পরিচিত ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয়েছিল সেই ফাইনালে। একদিকে সময়ের সেরা ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমার, অন্যদিকে সর্বকালের অন্যতম সেরা লিওনেল মেসি।
লিওনেল মেসি এর আগে আর্জেন্টিনার হয়ে চারটি ফাইনাল খেলেছেন। একবার বিশ্বকাপে, তিনবার কোপা আমেরিকায়; কিন্তু প্রতিবার মাথা নিচু করে মাঠ ছেড়েছেন। ক্লাব ফুটবলে প্রায় সবকিছুই জিতে ফেলা মেসির চেয়ে দুঃখী আন্তর্জাতিক ফুটবলে আর কেউ ছিলেন না। সেই দুঃখ ঘোচালেন লিওনেল স্কালোনি। কোচ হিসেবে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আর্জেন্টিনার ফুটবলে নিয়মিত উন্নতি হচ্ছে। ২০১৯–এর কোপা আমেরিকায় তাঁর অধীনে তৃতীয় হয়েছিল লস ব্লাংকোসরা।
এবারও টুর্নামেন্টের শুরু থেকে ফেবারিটের মতো খেলেছেন তাঁর শিষ্যরা। ডিফেন্স যেমন আঁটসাঁট, আক্রমণ তার চেয়েও ধারালো। ২৮ বছরের দুঃখ ঘোচাতে যেন প্রাণ পণ রেখে খেলেছেন মেসি-ডি মারিয়া-ওতামেন্দিরা। ওদিকে ব্রাজিল তুলনামূলক নির্ভারই ছিল। কোপা আমেরিকার সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন তারা, ট্রফিখরা থাকার বাড়তি কোনো চাপও নেই। কিন্তু অন্যবারের তুলনায় দুর্বল ব্রাজিলও প্রতিপক্ষের জন্য পরাশক্তি।
ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ভক্তদের উত্তেজনার পারদ চড়ানো সেই ফাইনালে আনহেল দি মারিয়ার নৈপুণ্যে ১-০ গোলে নেইমারদের হারিয়ে ইতিহাস লেখেন স্কালোনির শিষ্যরা। আকাশি-সাদা জার্সি গায়ে সতীর্থদের সঙ্গে ট্রফি উদ্যাপনের আনন্দে মাতেন লিওনেল মেসি। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় এবং সর্বোচ্চ গোলদাতাও তিনি।
সাধারণত বড় বড় টুর্নামেন্ট শেষ হলে একরাশ দুঃখ ঘিরে ধরে। মাসব্যাপী নিয়মিত খেলা দেখতে দেখতে দলগুলোর সঙ্গে তৈরি হয় এক আত্মিক বন্ধন। ফাইনালের পরদিন থেকে তাই ‘কী যেন নেই’ মনে হতে থাকে। এবার ইউরো ও কোপা আমেরিকার মতো বড় দুটি টুর্নামেন্ট একসঙ্গে শেষ হওয়ায়, ফুটবল–ভক্তদের বিরহ তাই আরও বেশি। ওদিকে রথী-মহারথীদের আবার জাতীয় দলের জার্সিতে দেখার জন্য করতে হবে দীর্ঘ প্রতীক্ষা। ২০২২–এর কাতার বিশ্বকাপের জ্বরে ভোগার আগপর্যন্ত ক্লাব ফুটবল এবং আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচই ভরসা।