ফমুর্লা রেসিংয়ের মাহফুজুর
জলের মাছকে ডাঙায় তুললে যে দশা হয়, ছেলেটারও ঠিক সে রকম কিছুই হয়েছিল। বাবার ইচ্ছা ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়াবেন। ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সে বাবার বানানো মসজিদ-মাদ্রাসার দেখাশোনা করবে। ফলে দুরন্ত সেই কিশোরের আকাশছোঁয়া স্বপ্নের ডানা কেটে দিয়ে জোর করে পাঠিয়ে দেওয়া হলো মাদ্রাসায়। কী আর করা, মাদ্রাসার চার দেয়াল আর সেখানকার কড়া নিয়মকানুনে বন্দী হয়ে গেল বংশালের সেই দুরন্ত কিশোর। তবু তার স্বপ্ন দেখা থেমে থাকেনি। গতির যুদ্ধ ফমুর্লা রেসিংয়ের নেশা মনে ধরা ছেলেটি রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে খেলনা গাড়ি চালায় গভীর রাতে। দেয়ালে সাজানো থাকে গাড়ির পোস্টার। শিক্ষকদের বুঝতে দেবে না বলে বাইরে থেকে ছিটকিনি এঁটে মেঝেতে শুরু করত খেলনা গাড়ি নিয়ে দাপাদাপি। এসব জানার পর তাকে কঠিন শাস্তি দিয়েছেন শিক্ষকেরা। তার পরও তাকে আটকে রাখা যায়নি। এখন ছেলেটি সত্যিকারের গাড়ি নিয়ে রেসে নামে গতির যুদ্ধে। বাংলাদেশের প্রথম ফমুর্লা রেসার মাহফুজুর রহমানের (তুষার) জীবনদর্শনের পুরোটা জুড়ে একটাই কথা: ‘কার ইজ মাই লাইফ, রেসিং ইজ মাই ব্লাড।’
২০০৩ সালে বাবা গাড়ি কিনলেন— নিশান ডুয়েল। পার্কিংয়ে রাখা গাড়ি দেখে আসতে বললেন মাহফুজুরকে। চাবিটা নিয়ে গাড়ির ভেতরে ঢুকে মনে হলো, ‘এ এক আজব দুনিয়া!’ চাবি ঢুকিয়ে স্টার্ট দিলেন। গাড়ির ভাইব্রেশানে ভয় পেয়ে গেলেন। সেদিনের মতো শেষ। আবার ফিরে গেলেন হোস্টেলের বন্দিজীবনে। তিন মাস পর একবার করে ছুটিতে বাড়ি এসে গাড়িটা দূর থেকে দেখতেন। কীভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন ড্রাইভার, পাশে বসে সচেতনভাবে খেয়াল করতেন। চাবি চাইলে ড্রাইভার বলতেন, ‘স্যারের নিষেধ আছে।’
আচমকা একদিন সুযোগ মিলল। ঘটনাটা রোজার ঈদের। পুবাইলে নানার বাড়িতে গেলেন মাহফুজুররা সবাই। ড্রাইভার কাদামাটির ওপর গাড়ি রেখে কোথায় যেন চলে গেছেন। বাবা রেগে আগুন। সবাই মিলে গাড়ি ঠেলা শুরু করলেন। একপর্যায়ে মাহফুজুর বললেন, ‘এভাবে হবে না, স্টার্ট দিতে হবে গাড়ি।’ এরপর সাহস করে স্টার্ট দিয়ে হালকা গতিতে গাড়ি সরিয়ে ভালো জায়গায় নিয়ে আসেন মাহফুজুর। এতটাই রোমাঞ্চিত ছিলেন তিনি, যেন ওই দিনই ছিল তাঁর ঈদ। এরপর সুযোগ খঁুজতেন কবে বাবা বলবেন, গাড়ি চালাও। একদিন বাবাই ড্রাইভারকে বললেন, ‘ওকে তুমি গাড়ি চালানো শিখিয়ে দাও। আবার কবে না কবে বিপদে পড়ি, বলা তো যায় না।’ পরে একটা খোলা মাঠে গিয়ে গাড়ি চালানো শিখলেন মাহফুজুর।
তত দিনে দাখিল শেষ করেছেন। এরপর ভর্তি হলেন ঢাকা পলিটেকনিকে। গাড়ির যুদ্ধে নামবেন বলেই পড়াশোনা করলেন অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। এরই মধ্যে মাহফুজুর খোঁজ পেয়েছেন ওয়ার্ল্ড সাইবার গেমসের। সেখানে কম্পিউটারে রেস খেলতে গিয়ে প্রথম রাউন্ডেই বাদ। সেটা দেখে বন্ধুদের সেকি হাসাহাসি! মাহফুজুর তখন বন্ধুদের বলেছিলেন, ‘তোরা কম্পিউটারে গেমস খেলবি, আমি খেলব আসল রেস।’
কিন্তু চাইলেই তো আর সব সম্ভব নয়। রেসিং কার লাগে, প্রয়োজন অনুশীলনের জন্য ২.২ কিলোমিটারের রেসিং ট্র্যাক। ঢাকায় যেখানে সাইক্লিস্টদের জন্য একটা ভেলোড্রাম পর্যন্ত নেই, সেখানে ফর্মুলা রেসিংয়ের ট্র্যাক তো কষ্টকল্পনা। এরপর খোঁজ পেলেন ফ্যান্টাসি কিংডমে গোকার্ট এক্সট্রিম রেসিং চ্যাম্পিয়নশিপের। সেখানে প্রথমবার ১১ জনের মধ্যে হলেন রানারআপ। পরের বছর ৩০০ জনের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন।
ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে খোঁজ পেলেন ভারতের ১৫তম জেকে টায়ার রেসিং চ্যাম্পিয়নশিপ টুর্নামেন্টের। সেখানকার আয়োজকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। কিন্তু যে পরিমাণ খরচ লাগবে খেলতে, সেটা দিতে রাজি হলেন না মাহফুজুরের বাবা। বুকের কষ্ট চেপে ভাবেন, ‘একজন ক্রিকেটার চাইলেই মাঠে নামতে পারছেন, কিন্তু আমি পারছি না। আমার রোড নেই, গাড়ি নেই। তাই বলে থেমে থাকব না।’ স্পনসরের জন্য বড় বড় কোম্পানিগুলোর দরজায় ঘুরেছেন। অবশেষে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে এসেছে শাহ সিমেন্ট।
ফমুর্লা রেসে আসতে হলে প্রথমে শিখতে হবে এক্সট্রিম রেসিং গোকার্ট। যেটা বাংলাদেশে শুধু আশুলিয়ার ফ্যান্টাসি কিংডমে আছে। নিজেকে টেকনিক্যালি ফিট করতে হবে। এরপর যোগাযোগ করতে হবে ভারতের ফেডারেশন মোটর স্পোর্টস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে। ফর্মুলা ফোরে সিঙ্গেল সিট ওপেন হুইল ক্লাসের কারের জন্য সুপার স্পিডের মারুতি স্টিম এমপিএফআই ১৩০০ সিসির গাড়ি লাগে, যার সর্বোচ্চ গতি ২০০ কিলোমিটার। রেসিংয়ের পোশাক, হেলমেট ঢাকায় পাওয়া যায় না। অস্ট্রেলিয়া ও ভারত থেকে আনতে হয়। মাহফুজুরের কথা, ‘শখে নয়, স্বপ্ন নিয়ে এই খেলায় আসতে হবে। তাহলেই ভালো করা সম্ভব।’
মাহফুজুরকে দিয়ে শুরু। হয়তো একদিন ফমুর্লা রেসে আসবে এ দেশের হাজারো তরুণ।