এ লেখা যখন লিখছি, তখন পাকিস্তান প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে হারিয়েছে ভারতকে। ১৫ বছরে ৬ বিশ্বকাপে যে ঘটনা ঘটাতে পারেনি কেউ, সেটাই করে দেখিয়েছেন বাবর আজমরা। শুধু টি-টোয়েন্টি নয়, ওয়ানডে বিশ্বকাপেও যেটা কেউ করে দেখাতে পারেননি, সেটাই দেখিয়েছেন নতুন যুগের পাকিস্তানি খেলোয়াড়েরা। ১০ উইকেটে জিতে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। তোমরা যত দিনে এই লেখা হাতে পাবে, তত দিনে হয়তো শেষ চারে কারা খেলছে, তা–ও জানা শেষ। সেই সঙ্গে বিশ্বকাপের অর্ধেক রোমাঞ্চও। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সপ্তম আসরে এসে ফিরে দেখা যাক গত ছয় বিশ্বকাপের সেরা ঘটনাগুলোকে, যা এখনো দাগ কেটে আছে প্রত্যেক সমর্থকের মনে।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অভিষেক—২০০৭ বিশ্বকাপ
কথায় আছে, সকালের সূর্যটা দেখেই বলে দেওয়া যায় বাকি দিনটা কেমন যাবে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সূচনাটাও সবাইকে টি-টোয়েন্টির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্পষ্ট একটা ধারণা দিয়েছিল। ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট্ট সংস্করণের সূচনা হয়েছিল বিশ্বকাপ শুরুর বছর দুয়েক আগে। হাসিতামাশা করে শুরু হওয়া এই বিশ্বকাপ এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই বিশ্বকাপ আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছিল আইসিসি। তাতে অবশ্য ক্রিকেটবোদ্ধাদের সমালোচনা আর প্রশ্নবাণ থামানো যায়নি। কেউ কেউ রব তুলেছিল, ক্রিকেট ঐতিহ্য এই শেষ হলো বলে। কেউ আবার প্রশ্ন তুলেছিল এর উত্তেজনা নিয়ে। ক্রিকেটের এই ছোট সংস্করণ কি পারবে আগের মতো আনন্দে ভাসাতে?
সব প্রশ্নের বোঝা মাথায় নিয়ে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর দক্ষিণ আফ্রিকা। আর প্রথম বলটির মুখোমুখি হয়েছিলেন ‘দ্য ইউনিভার্স বস’ ক্রিস গেইল। শন পোলকের প্রথম বলে চার মেরে বুঝিয়ে দিলেন, টি-টোয়েন্টির ক্রিকেটে আর যা-ই হোক, বিনোদনের অভাব হবে না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ২০৫ রানের মধ্যে ১১৭-ই ছিল ক্রিস গেইলের। তাই বলে ভেবো না ওপ্রান্তে দমে গিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। দুই ওভার হাতে রেখেই সে রান পার করে ফেলেছিল তারা। হার্শেল গিবস করেছিলেন অপরাজিত ৯০! দুই দল ক্রিকেট–দুনিয়াকে নতুন এক উত্তেজনা উপহার দিয়েছিল সেদিন।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়ে সব প্রশ্ন-সমালোচনা, এক ম্যাচে ঢেকে দিয়েছিলেন ক্রিস গেইল আর হার্শেল গিবস মিলে। ক্রিকেটের নতুন সংস্করণে যে পরতে পরতে উত্তেজনা, সেটাই প্রমাণ করেছেন দুজনে। ক্রিকেট–বিশ্বও বুঝতে পেরেছিল, টি-টোয়েন্টি আসছে বিশ্ব শাসন করতে।
ভারত-পাকিস্তান বোল-আউট—২০০৭ বিশ্বকাপ
ক্রিকেটে তো পেনাল্টি শুটআউট দেখেছ? ক্রিকেটে দেখা মিলেছিল পেনাল্টি শুটআউটের। তা–ও সেটা ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে। ২০০৭ টি-২০ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের খেলায় এ দৃশ্য দেখেছিল ক্রিকেট–বিশ্ব।
ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই অন্য রকম উত্তেজনা। সেই সঙ্গে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। আয়োজকেরা চাইছিলেন নতুন কিছু চেষ্টা করতে। তাই ম্যাচে পয়েন্ট ভাগাভাগির কোনো সুযোগ ছিল না। ম্যাচ টাই বা ড্র হয়ে ফুটবলে যেমন নেওয়া হয় পেনাল্টি, তেমনি ক্রিকেটে নিয়ে আসা হয় বোল-আউট। নিয়মটা বেশ সোজা, ফুটবলে পেনাল্টি নেওয়ার মতোই। দুই দলের পাঁচজন বোলার এসে সরাসরি বল করবেন, থাকবেন না কোনো ব্যাটসম্যান। স্টাম্পে লাগাতে পারলেই পয়েন্ট। আন্তর্জাতিক কোনো আসরে প্রথমবারের মতো সেটি দেখার সুযোগ হয় এই বিশ্বকাপেই। প্রথম ২০ ওভার শেষে দুই দলেরই ইনিংস থামে ১৪১ রানে। ফলে ম্যাচ গড়ায় বোল-আউটে। প্রথমে বল করতে আসে ভারত। অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি আনেন বীরেন্দর শেবাগ, হরভজন সিং ও রবিন উথাপ্পাকে। আর পাকিস্তানের অধিনায়ক শোয়েব মালিক ইয়াসির আরাফাত, উমর গুল আর শহীদ আফ্রিদিকে। ভারতের তিনজনই বল স্টাম্পে হিট করলেও পাকিস্তানের কেউ ছোঁয়াতেও পারেননি। ফলে সরাসরি জিতে যায় ভারত। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দ্বিতীয় ও শেষবারের মতো বোল-আউটের সাক্ষী হয়ে থাকে ২০০৭ বিশ্বকাপ টি-টোয়েন্টি। পরের বছর থেকেই ম্যাচ টাই হলে চালু করা হয় ‘সুপার ওভার’।
যুবরাজের ছয় ছক্কা—২০০৭ বিশ্বকাপ
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে যদি কেউ একটা ঘটনা দিয়ে চেনাতে চায়, তবে এ ঘটনাই সবার আগে আসবে। এক ওভারে যে তাণ্ডব চালিয়েছিলেন যুবরাজ, তার জন্য এখন পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পোস্টার বয় হয়ে আছেন তিনি।
ঘটনার সূচনা ১৮তম ওভারের শেষ বলে। অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের শেষ বলে হুক করে ১ রান নিয়েছিলেন যুবরাজ। তখনই ফ্লিনটফ এগিয়ে এসে স্লেজিং করা শুরু করেন যুবরাজকে। তাঁদের কথা–কাটাকাটি এমন পর্যায়ে যায় যে আম্পায়ারকে এসে হস্তক্ষেপ করতে হয়। এরপরই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন যুবরাজ। ইংল্যান্ড বোলিংয়ে আনে ১৯ বছর বয়সী তরুণ তারকা স্টুয়ার্ট ব্রডকে। ১৯তম ওভারে তাঁর ওপর দিয়েই স্টিমরোলার চালালেন যুবরাজ। ছয় বলে ছয় ছক্কা! এর আগেও বিশ্বকাপে ছয় ছক্কা হাঁকানোর রেকর্ড আছে হার্শেল গিবসের, কিন্তু যুবরাজ সিং সেদিন সবাইকে ছাড়িয়ে যান। ইংল্যান্ডের মতো প্রতিপক্ষ, ডেথ ওভার; কোনোটিই তাঁকে ছুঁতে পারেনি। লক্ষ্য ছিল একটাই, বল সীমানার বাইরে পাঠানো। কাউ কর্নার, ব্যাকওয়ার্ড, স্কয়ার লেগ, এক্সট্রা কাভার, ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট, মিড উইকেট আর শেষটা লং অন। উইকেটের চারদিকে মেরেছেন স্টুয়ার্ট ব্রডকে। আর নিজেকে তুলেছেন বিশ্ব ক্রিকেটের অনন্য এক উচ্চতায়। এতটাই উঁচুতে যে ক্রিকেট ইতিহাসে একটা ঘটনা মনে রাখতে হলে দর্শকদের মনে প্রথমেই আসে এই একটি ঘটনার কথা।
উইকেট, উইকেট, উইকেট, উইকেট, ডট, উইকেট—২০১০ বিশ্বকাপ
১৯ ওভারে ১৯১, হাতে ৫ উইকেট। অস্ট্রেলিয়া তখন নিজেদের ইনিংসকে আরও উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার চিন্তায় মত্ত। ৩ ওভারে ২৩ রান দেওয়া আমিরই শেষ ওভারে রান আটকানোর জন্য অধিনায়ক শহীদ আফ্রিদির একমাত্র ভরসা। ম্যাচ শেষে স্কোর? অস্ট্রেলিয়া ১৯১, অলআউট। এক ওভারে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটিং লাইনআপের ওপর দিয়ে তাণ্ডব চালিয়ে গেছেন আমির।
এই আমির তখনো স্পট ফিক্সিংয়ে জড়াননি। তরুণ তারকা হিসেবে তাঁর নামডাক চারদিকে। প্রথম তিন ওভারে ২৩ রান দেওয়া আমির ছিলেন অধিনায়ক শহীদ আফ্রিদির অটোমেটিক চয়েস। আর সেই ওভারের জন্যই যেন সবটা জমিয়ে রেখেছিলেন আমির। উইকেটে ছিলেন ব্র্যাড হ্যাডিন আর মাইকেল হাসি। প্রথম বলে মোহাম্মদ সামির হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন হ্যাডিন। পরের বলে সরাসরি বোল্ড আউট মিচেল জনসন। তৃতীয় আর চতুর্থ বলে স্ট্রাইক চেঞ্জ করার জন্য উইকেটকিপারের হাতে বল রেখেই দৌড় দেন ব্যাটসম্যান। ফলাফল দুই বলেই কামরান আকমলের রানআউট। যথাক্রমে পরপর দুই বলে প্যাভিলিয়নে ফেরান মাইকেল হাসি আর স্টিভেন স্মিথকে। পঞ্চম বলে নিজেকে ক্রিজে আবিষ্কার করেন শন টেইট। অথচ এক ওভার আগেও তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, কীভাবে প্রথম ওভারে পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপ ধসিয়ে দেওয়া যায়, তা নিয়ে। ৫ বল কোনোমতে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেও পরের বলে তাঁর উইকেটটাও তুলে নেন আমির।
এক ওভারে ৫ উইকেট নিয়ে ইতিহাসে নাম লিখে নেন আমির। এক ওভারে প্রথমবারের মতো এত উইকেটের পতন দেখে বিশ্ব।
ব্রাফেটনামা—২০১৬ বিশ্বকাপ
‘কার্লোস ব্রাফেট, কার্লোস ব্রাফেট, রিমেম্বার দ্য নেম। কার্লোস ব্রাফেট।’ বল তখনো শূন্যে ভাসছে। ইয়ান বিশপ কমেন্ট্রি বক্স থেকে নিজের হৃৎপিণ্ডের প্রতিটি শিরা-উপশিরা দিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছেন। পাশে থাকা নাসের হুসাইনের মুখ দিয়ে টুঁ শব্দটিও বের হচ্ছে না।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্মৃতি রোমন্থন করতে গেলে মনে পড়বেই বিশপের সেই কণ্ঠ। গত বিশ্বকাপের ফাইনাল নিজের মতো করে রাঙিয়ে নিয়েছিলেন এক কার্লোস ব্রাফেট। ইডেন গার্ডেনসে ১৫৬ রানের টার্গেটে সেদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজের অবস্থা ছিল শোচনীয়। এক মারলন স্যামুয়েলস বাদে কেউ রান করতেই পারেননি। পুরো ম্যাচে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল ইংল্যান্ডের। কিন্তু কথায় আছে, ‘ওস্তাদের মার শেষ রাতে’। কার্লোস ব্রাফেট সেটাই প্রমাণ করে দেখালেন। শেষ ওভারে দরকার ছিল ১৯ রান। অধিনায়ক ড্যারেন সামি পাশে বসে থাকা ক্রিস গেইলকে বোঝাচ্ছিলেন, প্রথম বলে ছয় হলেই ম্যাচ আমাদের হাতে। বাকি পাঁচ বলে দুই ছয় এমনিতেই আসবে। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও সেটাই করে দেখিয়েছিলেন ব্রাফেট। ফাইনালে, শেষ ওভারের চাপ মাথায় নিয়ে বেন স্টোকসকে পরপর চারবার সীমানার বাইরে আছড়ে ফেলেন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হাতে তুলে দেন তাদের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শিরোপা।
চার বছর পর এবারও কি ঘটবে এমন কিছু, যা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে ভক্তদের মধ্যে?