প্রথমবারের মতো যখন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলতে নেমেছিলেন নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররা; তখন কেই–বা জানতেন ক্রিকেটের সবচেয়ে জমজমাট মহারণগুলোর কয়েকটি গড়ে উঠবে এই টি-টোয়েন্টিকে ঘিরে? বোধ হয় কেউ–ই না। জানবেনই–বা কীভাবে? তখন পর্যন্ত তো টি-টোয়েন্টি শুধু ইংলিশ ক্রিকেট বোর্ডের একটি মার্কেটিং স্টান্ট হিসেবে পরিচিত।
যে কারণে ২০০৪ সালের সেই ম্যাচটিকে দুই দলের কোনো ক্রিকেটারই সেভাবে গুরুত্ব দেননি। বরং হাসিঠাট্টার মধ্য দিয়েই খেলেছে দুই দল। দুই দলের জার্সিই ছিল তাঁদের আশির দশকের জার্সির আদলে বানানো। নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটাররা তো আশির দশকের স্টাইল নকল করতে নকল চুল-দাড়ি পরেই মাঠে নেমেছিলেন। ম্যাচটি এতটাই অগুরুত্বপূর্ণ ছিল যে ম্যাচের শেষের দিকে গ্লেন ম্যাগ্রা মজা করে ট্রেভর চ্যাপেলের বিখ্যাত আন্ডারআর্ম বলের দৃশ্যটি নকল করে বল করেন। জবাবে সেই ম্যাচের আম্পায়ার বিলি বাউডেনও মজা করে ম্যাগ্রাকে একটি লাল কার্ড দেখান। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ম্যাচটি বড় ব্যবধানে জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া।
প্রায় ১৬ বছর ও ১ হাজার ১০০টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির পর এখন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর একটি। টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্টরা বিশ্বে ক্রিকেটারদের মধে৵ এখন সবচেয়ে বেশি দামে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোতে খেলেন। প্রায় পাঁচ বছর পর সেই টি-টোয়েন্টির বৈশ্বিক মহারণ নতুন করে শুরু হয়েছে। চলো, দেখে নেওয়া যাক টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে ব্যাটে-বলে সেরা কারা।
সবচেয়ে বেশি রান: মুকুট এখনো মাহেলা জয়াবর্ধনের
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রান এখন পর্যন্ত মাহেলা জয়াবর্ধনের। ২০০৭ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত পাঁচটি বিশ্বকাপ খেলেছেন শ্রীলঙ্কান এই কিংবদন্তি। সেই পাঁচটি বিশ্বকাপে ৩১ ইনিংস খেলে করেছেন ১০১৬ রান। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে ১০০০ রানের বেশি করা একমাত্র ব্যাটসম্যানও এখন পর্যন্ত তিনি।
জয়াবর্ধনের পরেই আছেন ক্রিস গেইল। এ বিশ্বকাপের শুরুতে খুব একটা ফর্মে নেই তিনি। তবুও গেইলের অপেক্ষা মাত্র ৯৭ রানের। এই বিশ্বকাপে মাত্র ৯৭ রান করতে পারলেই জয়াবর্ধনেকে সরিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রান করা ব্যাটসম্যানের মুকুটটি হয়ে যাবে গেইলের। মারকুটে এই ব্যাটসম্যান এখন পর্যন্ত ছয়টি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে উইন্ডিজের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাতে ২৬ ইনিংস খেলে করেছেন ৯২০ রান।
গেইলের পরে সর্বোচ্চ রানের এই তালিকায় আছেন তিলকরত্নে দিলশান, বিরাট কোহলি, এবি ডি ভিলিয়ার্স, সাকিব আল হাসানরা। দিলশান এবং ডি ভিলিয়ার্স অবসর নিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহক হওয়ার দৌড়ে এখনো এগিয়ে আছেন কোহলি ও সাকিব।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কোহলির রানের রেকর্ড চমক জাগাতে বাধ্য। মাত্র তিনটি বিশ্বকাপ খেলে ১৬ ইনিংসেই তিনি করেছেন ৭৭৭ রান। গড় ৮৬.৩৩। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ৭০০ রানের বেশি করেছেন—এমন অন্য ৫ ব্যাটসম্যানের সঙ্গে তাঁর গড় রানের পার্থক্য কমপক্ষে ৪৬ কিংবা তার চেয়ে বেশি। আপাতদৃষ্টে বলা যেতে পারে, সবকিছু ঠিক থাকলে হয়তো আরও কমপক্ষে দুটি বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পাবেন কোহলি। আরও দুটি বিশ্বকাপ খেলতে পারলে কোহলির রানের ঘোড়া শেষ পর্যন্ত যেখানে গিয়ে থামবে, সেটি অন্য যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্য ঈর্ষাজাগানিয়া হওয়ার কথা।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহকের তালিকায় ৬ নম্বরে আছেন আমাদের সাকিব আল হাসান। ৬টি বিশ্বকাপ খেলে ২৮ ইনিংসে ৬৭৫ রান করেছেন তিনি। বিশ্বকাপে সাকিব বরাবরই দারুণ ফর্মে থাকেন। এবারও বেশ ভালো ফর্মেই শুরু করেছেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ফর্ম ধরে রাখতে পারলে নিজের মোট রানের সংখ্যা আরও অনেক বাড়িয়ে নিতে পারবেন তিনি।
সবচেয়ে বেশি ছয়: ক্রিস গেইল ছাড়া আর কে?
টি-টোয়েন্টি যে আসলে চার-ছক্কার খেলা কিংবা আরও সুর্নিদিষ্টভাবে ছক্কার খেলা, সেটি প্রথমবার বিশ্বকে জানিয়েছিলেন যুবরাজ সিং। ২০০৭ সালে আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম পর্বে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে স্টুয়ার্ট ব্রডের করা ছয়টি ছয়ের সেই ওভার তো এখনো কেউ ভুলতে পারেননি। সেবারই প্রথম টি-টোয়েন্টির আসল আমেজটা যেন টের পান ক্রিকেট–ভক্তরা।
এরপর থেকেই টি-টোয়েন্টিতে ম্যাচে ছক্কা মারাকেন্দ্রিক প্রতিটি রেকর্ডের সিংহাসনই যেন দখল করে নিয়েছেন ক্রিস গেইল। টি-টোয়েন্টি মানেই গেইলের রেকর্ডের ছড়াছড়ি। ব্যাপারটা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে টি-টোয়েন্টিতে ছয়সংক্রান্ত যেকোনো রেকর্ডের মালিক যে গেইলই হবেন, সেটি না দেখেই বলে দেওয়া যায়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ ছক্কা মারার রেকর্ডটিও তাঁর। অন্য কোনো ব্যাটসম্যান তাঁর ধারেকাছেও নেই। ৬টি বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ৬০টি ছক্কা মেরেছেন গেইল।
এই তালিকায় দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান যুবরাজ সিং। ৩১ ইনিংস খেলে তিনি ছক্কা মেরেছেন ৩৩টি। তিন ইনিংস কম খেলে গেইল ছয় মেরেছেন প্রায় দ্বিগুণ! গেইলের এই রেকর্ড যে আরও অনেক দিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে, তা এখনই বলে দেওয়া যায়।
এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মারার রেকর্ডটিও তাঁর। ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরিতে ১১টি ছয় মেরেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২০০৭ সালে আরেকটি সেঞ্চুরিতে মেরেছিলেন ১০টি ছক্কা। এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ছক্কা মারার তালিকায় এর পরে আছেন যুবরাজ সিং। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরি করার সেই ইনিংসে তিনি মেরেছিলেন সাতটি ছক্কা।
সর্বোচ্চ উইকেট: সাকিব আল হাসানের জয়জয়কার
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বোলিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ সব রেকর্ডই নিজের করে নেওয়ার দৌড়ে আছেন সাকিব আল হাসান। এই বিশ্বকাপ শুরুর আগে শহীদ আফ্রিদি ছিলেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়া বোলার। ৬টি বিশ্বকাপে ৩৪ ম্যাচ খেলে আফ্রিদি নিয়েছেন ৩৯ উইকেট। এই বিশ্বকাপে মাত্র ৪ ম্যাচ খেলে ১১ উইকেট নিয়ে ফেলেছেন সাকিব। তাতে ছাড়িয়ে গেছেন আফ্রিদিকেও। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ২৯ ম্যাচ খেলে ৪১ উইকেট নিয়েছেন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার।
সাকিবের এই রেকর্ড যে শিগগিরই হুমকির মুখে পড়ছে না, তা এখনই বলে দেওয়া যায়। এখনো খেলছেন, এমন ক্রিকেটারদের কেউ–ই যে তাঁর ধারেকাছে নেই। আফগানিস্তানের মোহাম্মদ নবী ৪টি বিশ্বকাপ খেলে ১৭ উইকেট নিয়েছেন। মাত্র ৭ ম্যাচ খেলে ১৫ উইকেট নিয়েছেন কাটার মাস্টার মুস্তাফিজুর রহমান। সাকিবকে ছুঁতে তাঁদের দুজনেরই এখনো যোজন যোজন পথ পাড়ি দিতে হবে।
ফলে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড আরও অনেক দিন সাকিব আল হাসানেরই থাকছে। এই বিশ্বকাপের শুরুতেও আছেন দুর্দান্ত ফর্মে। তাই অন্যদের সঙ্গে নিজের ব্যবধানটা যে তিনি আরও অনেক দূর বাড়িয়ে নেবেন, সেটি বলাই বাহুল্য।
এই বিশ্বকাপে সাকিবের সামনে আছে আরও একটি রেকর্ড ছোঁয়ার হাতছানি। এখন পর্যন্ত একটি বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড শ্রীলঙ্কার অজন্তা মেন্ডিসের। ২০১২ বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচে ১৫টি উইকেট নিয়েছেন তিনি। এই লেখাটির সময়ে ২০২১ বিশ্বকাপে ৪ ম্যাচে ১১ উইকেট শিকার করে ফেলেছেন সাকিব। তাঁর সামনে বাকি আছে কমপক্ষে আরও চারটি ম্যাচ। তুমি যখন এই লেখা পড়ছ, তখন হয়তো সাকিব একটি বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ডও নিজের করে ফেলেছেন!