কয়েক সপ্তাহ আগে নাকি মানুষ বলছিল ও ফুরিয়ে গিয়েছে। সেটা ছিল ভাল্লুককে খোঁচা দেওয়ার মতো। এই সময়টাতেই ও সবচেয়ে ভালো খেলে।অ্যারন ফিঞ্চ
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ যারা দেখছে, এই ‘ও’টা কে, তা ধরতে তাদের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। ১০ মাস ধরে সবখানে কথা চলছে, ওয়ার্নার আর আগের ওয়ার্নার নেই। বয়সের ভার পড়েছে ব্যাটে, স্ট্রাইক রেটটাও কমে আসছে। খোদ অস্ট্রেলিয়ানরাই মনে মনে তাঁর বদলে একজনকে খুঁজছিলেন, কিন্তু পাচ্ছিলেন না। অথচ দুই সপ্তাহের মধ্যেই ব্যাট হাতে নিজেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁর বিকল্প শুধু তিনিই। ডেভিড ওয়ার্নার এই পৃথিবীতে একজনই।
ওয়ার্নারের বয়স ৩৫-এ পড়েছে বিশ্বকাপের মধ্যেই। অ্যাথলেটদের কথা চিন্তা করলে বয়সটা একটু বেশিই। এমন সময়ে অনেকে তো অবসর নেওয়ার কথাও ভাবতে শুরু করেন। দিন দিন যেভাবে খেলা এগিয়ে চলছে, তার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে ৩০-এ পা দিতে না দিতেই বিদায় বলতে হয় অনেক খেলোয়াড়কে। সে কথাটা ওয়ার্নারের ক্ষেত্রেও এসেছিল, এ বছরের শুরুর দিকে।
২০২১ সালটা খুব একটা ভালোভাবে শুরু হয়নি ওয়ার্নারের। চোট থেকে ফিরে নিজের স্বভাবজাত ফর্মটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। ভারতের বিপক্ষে টেস্টে ব্যর্থ, তারপর চোট। চোট থেকে ফিরে আইপিএলের চোখ রেখেছিলেন ওয়ার্নার। আইপিএলকে ওয়ার্নার যেভাবে দুই হাতে দিয়েছেন, ঠিক সেভাবে আইপিএল তা ফেরতও দিয়েছে।
এবারও ভারত এসেছিলেন হায়দরাবাদকে নিয়ে ভালো কিছু করার প্রত্যয়ে। অধিনায়ক যেহেতু তিনি, তাঁর ওপরই বেশি প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু আইপিএল ২০২১ হয়ে উঠল তাঁর জীবনের অন্যতম বাজে অধ্যায়।
আইপিএলের শুরু থেকেই মুখ থুবড়ে পড়ে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। প্রথম ছয় ম্যাচ থেকে তাদের সংগ্রহ ছিল মাত্র ২ পয়েন্ট। মৌসুমের প্রথমার্ধে এমন খেলা দেখে আর ঠিক থাকতে পারেনি হায়দরাবাদ কর্তৃপক্ষ। সপ্তম ম্যাচ শুরুর আগে দেখা গেল টিম লিস্ট হাতে টস করতে মাঠে নামছেন কেইন উইলিয়ামসন। তবে ওয়ার্নারের কী হলো? চোটে আক্রান্ত নাকি বাদ? উইলিয়ামসনই উত্তরটা দিলেন, টিম কম্বিনেশনের কারণে তাঁকে রেখেই দল সাজাতে হয়েছে তাঁদের। অথচ আগের ম্যাচেও পেয়েছেন পঞ্চাশ, ছয় ম্যাচে দল বলার মতো কিছু করতে না পারলেও ব্যাট হাতে ঠিকই কথা বলেছিলেন তিনি। ৬ ম্যাচে ১৯৩ রান করেও ‘টিম কম্বিনেশন’-এর দোহাই দিয়ে বাদ পড়েন ওয়ার্নার। সেদিন মাঠের বাইরে সাইডলাইনে বসে ওয়ার্নারের অশ্রুসজল চোখ কাঁদিয়েছিল সবাইকেই। এরপরই আইপিএলে আঘাত হানে কোভিড। আইপিএল থেমে যায় অনির্দিষ্টকালের জন্য।
আইপিএলের দ্বিতীয়ার্ধ বসে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। কেইনকে অধিনায়ক করেই দল সাজায় হায়দরাবাদ। আগের তিক্ত অভিজ্ঞতা ভুলে দলে ফেরেন ওয়ার্নার। প্রথম দুই ম্যাচে সংগ্রহ মাত্র ২। আবারও বাদ পড়েন একাদশ থেকে। সেটুকু কমবেশি সবাই-ই মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরে যা হয়েছে, তা হায়দরাবাদ ম্যানেজমেন্টের তামাশা বললেও কম হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় পর্বের চতুর্থ ম্যাচে ডেভিড ওয়ার্নারকে দেখা গেল না কোথাও। কোথায় তিনি, কোথায় তিনি, রব যখন সোশ্যাল মিডিয়ায়, তখন ওয়ার্নার নিজে থেকেই জানালেন, তিনি আর দলের সঙ্গে নেই। মৌসুমের মাঝপথে তাঁকে ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছে। আইপিএল জেতানো অধিনায়ককে ছাড়াই তোলা হয়েছে টিম ফটো।
সানরাইজার্স হায়দরাবাদের সমর্থকদের জন্যও বিষয়টা হজম করা বেশ কষ্টকর ছিল। কেনই–বা হবে না? আইপিএলে বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজিতে খেলতে বিভিন্ন দেশ থেকে খেলোয়াড় আসেন। কিন্তু কোনো খেলোয়াড়কে এভাবে নিজের সমর্থকদের সঙ্গে মিশে যেতে আগে কেউ কখনো দেখেনই। আইপিএল জিতে হায়দরাবাদী সমর্থকদের সঙ্গে নাচ। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভক্তদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ এমনকি টিকটক তৈরি করে সমর্থকদের মধ্যে সত্যিকারের অধিনায়ক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাই তো শেষ দিন পর্যন্ত সত্যিকারের অধিনায়ক হয়ে রইলেন তিনি। এত কিছুর পরও সানরাইজার্স হায়দরাবাদের শেষ ম্যাচে তাঁকে দেখা গেল পতাকা হাতে সমর্থকদের সঙ্গে। মন থেকে হায়দরাবাদকে ছাড়তে পারেননি তিনি।
অন্যদিকে সামনে বিশ্বকাপ, অস্ট্রেলিয়ার জন্য ওয়ার্নারের ফর্মে ফেরা বেশ জরুরি। তাদের ব্যাটিং লাইনআপে ভরসা করার মতো পাত্র যে তিনিই। বিশ্বকাপের দুই প্রস্তুতি ম্যাচে ডাগআউটে ফিরলেন ০ ও ১ রানে। বিশ্বকাপের মূল পর্বে প্রথম ম্যাচে ফিরলেন ১৪ করে। সবাই ভেবেই নিয়েছিল আইপিএলে হায়দরাবাদের এমন ব্যবহার প্রভাব ফেলেছে তাঁর খেলায়।
কিন্তু লোকটার নাম যে ডেভিড ওয়ার্নার, একেবারে অন্য ধাতুতে গড়া। যতবারই তাঁকে নিয়ে কথা উঠেছে, লোকজন বলেছে তাঁকে দিয়ে আর হচ্ছে না, এই তাঁর ক্যারিয়ার পড়ল বুঝি; ততবারই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কোনো ম্যাচ না খেলেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে স্যান্ড পেপার কাণ্ডে নিষিদ্ধ হওয়ার পর কেড়ে নেওয়া হয়েছিল সহ-অধিনায়কত্ব। দলে ফিরবেন কি ফিরবেন না দ্বিধাদ্বন্দ্ব যখন, তখনই ২০১৯ বিশ্বকাপ কাঁপিয়েছেন নিজের ব্যাটে। প্রতিবার ওয়ার্নারকে নিয়ে কথা উঠেছে, ওয়ার্নার নিন্দুকের মুখ বন্ধ করেছেন ব্যাট দিয়ে। এবার করবেন না, তা কি হয়?
ওয়ার্নার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নামলেন নিন্দুকের মুখ বন্ধ করতে। ৪২ বলে ৬৫। গত ১০ মাস তাঁকে নিয়ে যত কথা হচ্ছিল, সব বন্ধ করতে এটুকুই যথেষ্ট ছিল। ওয়ার্নার ওখানেই থামলেন না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে রানরেট বাড়ানোর ম্যাচে ৫৬ বলে অপরাজিত ৮৯। সেমিফাইনালে ৩০ বলে ৪৯ আর ফাইনালে ৩৮ বলে ৫৩। প্রতিটি ম্যাচে নিজেকেই নিজে ছাড়িয়ে গিয়েছেন, নতুন করে সবার সামনে তুলে ধরেছেন নিজেকে। পুরোনো আগ্রাসী সেই ওয়ার্নার, যাঁকে আর কেউ খুঁজেই পাবে না বলে ভেবে নিয়েছিল।
অস্ট্রেলিয়ার জন্যও ওয়ার্নারের ফর্মে ফেরাটা বেশ জরুরি ছিল। কারণ, তাদের ব্যাটিং লাইনআপটাই যে নির্ভর করে থাকে তাঁর ওপর। ওয়ানডে-টেস্টে সফল স্মিথ মিইয়ে যান টি-২০–তে। বিশ্বকাপের আগে মিচেল মার্শের ওপরেও ভরসা করতে পারতেন না কেউ। অস্ট্রেলিয়াকে ফেবারিটের তালিকা থেকেও বাদ দিয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু এক ওয়ার্নার ফর্মে ফিরলে কী হবে, সেটা জানা ছিল সবারই।
জানা ঘটনাই সবার সামনে নতুন করে উপস্থাপন করলেন ডেভিড ওয়ার্নার। কথায় আছে, ‘ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট’, তারই জ্বলন্ত প্রমাণ দেখালেন ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট আর বিশ্বকাপ শিরোপা হাতে নিয়ে। এক মাস আগেও যাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল পৃথিবীত সবচেয়ে দুঃখী মানুষ, সেই মানুষটাই নিজের জীবন ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়েছেন নিজের ব্যাটে চড়ে।