ক্যারিয়ারের মাঝপথে এসে নোভাক জোকোভিচ একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, তাঁর টেনিস ক্যারিয়ারে একটা জিনিসের বড্ড অভাব—পাঁড় ভক্তের। সমসাময়িক ফেদেরার-নাদালকে নিয়ে তাঁর কোনো আক্ষেপ নেই। কিন্তু মাঠে নামলেই যে নিরঙ্কুশ সমর্থন, মাঠজুড়ে চিৎকার-চেঁচামেচি, প্রিয় খেলোয়াড়কে ঘিরে আলাদা উত্তেজনা; এর কোনোটাই নোভাকের কপালে সেভাবে জোটেনি কখনো। জুটবে কীভাবে, দর্শকের পছন্দের তারকা হয়ে উঠতে পারেননি তিনি কখনো। ফেদেরারের মতো মাঠে ধ্রুপদি নৃত্য করতে পারতেন না, পারতেন না নাদালের মতো পুরো মাঠ দৌড়ে একেকটা পয়েন্ট বের করে আনতে। টেনিসে ‘ব্যাড বয়’ কথাটার খুব একটা প্রচলন নেই বললেই চলে। একজন ম্যাকেনরো আর হালের নিক কিরিয়স ছাড়া সবাই অন কোর্টে একই রকম শান্তশিষ্ট। কিন্তু জোকোভিচ একটু অন্য ছাঁচে গড়া। তাঁর খেলার ধরনে না আছে রস, না আছে কষ। বরং নিষ্ঠুরের মতো একের পর এক রিটার্ন করতে থাকেন, প্রতিপক্ষ বিরক্ত হয়ে যখন একটা বাজে শট খেলে, তখনই তাঁর জেগে ওঠার সময়। ফলাফলে তাঁর জীবনে কখনো জোটেনি ভক্তের অপার ভালোবাসা। মাঠে দুয়ো শুনেছেন, গালমন্দও শুনতে হয়েছে শুধু বিরক্তিকর খেলা খেলতে খেলতে। সার্বিয়ার সেই ছেলে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে আজ বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ গ্র্যান্ড স্লামধারী।
জোকোভিচের জন্য এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। বেলগ্রেডের রাস্তায় জোকোভিচ আর তাঁর দাদা-দাদির ম্যুরাল আঁকা একটা বাড়ি আছে। সাদা দরজার বাড়িটা এখন দেখলে হয়তো সুন্দর লাগবে, লোহার রেলিং ধরে স্বপ্ন দেখবে অনেকে। কিন্তু ১১ বছরের জোকোভিচের জন্য তেমনটা ছিল না। বেলগ্রেডের রাস্তায় সে বছর ছেলেরা খেলতে নামেনি, নেমেছিল ‘ন্যাটো’। মাথা উঁচু করে চলত শহরের মানুষ, কখন নেমে আসে বিভীষিকা। সাইরেনের শব্দ শুনলেই বাড়ির ভেতর গিয়ে লুকাত সবাই। সদ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে তৈরি হওয়া সার্বিয়ায় যে চলছে আমেরিকান আগ্রাসন। সকাল-বিকেল এই সাইরেনের শব্দে মুখর জোকোভিচ উদ্যাপন করেছেন নিজের ১২তম জন্মদিন। সার্বিয়ার সেই রাস্তায় কোনো বৃদ্ধ লোককে জিজ্ঞেস করলে এখনো তারুণ্যে উচ্ছল জোকোভিচকে নিয়ে গল্প শুনতে পাবে।
জোকোভিচ বেড়ে উঠেছেন সেই বোমা-বারুদের গন্ধে। সে জন্যই হয়তো অন্য খেলোয়াড়দের মতো গড়ে ওঠেননি তিনি। ফেদেরারের মতো বিশাল বিশাল কোর্টে খেলার সুযোগ হয়নি ছোটবেলা থেকে। রাফায়েল নাদালের চাচা তো ছিলেন বিখ্যাত টেনিস খেলোয়াড়। কিন্তু জোকোভিচ বেড়ে উঠেছেন রাস্তায় রাস্তায়। দুই ভাইয়ের সঙ্গে খেলতেন টেনিস। একদিন তাঁর পারিবারিক ফুডকোর্টে খেতে এসেছিলেন ইয়েলেনা জেনসিস। ইয়েলেনা ছিলেন তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার অন্যতম টেনিস তারকা ও কোচ। যাঁকে দেখে তাঁর মুখ দিয়ে একটাই কথা বের হয়েছিল, ‘মনিকা সেলেসের পরে এ রকম খেলা আমি কাউকে খেলতে দেখিনি।’
সার্বিয়ায় বোম্বিং সহসাই থামেনি, কিন্তু এমন একজন খেলোয়াড়কে হারিয়ে যেতে দেখতে পারেননি ইয়েলেনা। তাই নিজের পকেটের টাকা খরচ করে জোকোভিচকে নিয়ে আসেন জার্মানিতে। টেনিসের প্রতি মুগ্ধতা আর ভালোবাসা দেখে জার্মানিতে নিজের বন্ধু নিকোলা পিলিচের একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন নোভাককে। সার্বিয়ার নরকসম যন্ত্রণা থেকে বের হয়ে জোকোভিচ অবশেষে দেখতে পেলেন সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন। সেখান থেকেই যুদ্ধ করেছেন। তাই বলে ভুলে যাননি নিজের শিকড়কে। অনেকেই চেষ্টা করেছেন তাঁকে জার্মান করতে, কিন্তু সার্বিয়ান হিসেবেই সবচেয়ে বেশি গর্ব বোধ করেন তিনি।
জোকোভিচ এসেছিলেন এমন সময়ে, যখন টেনিসে দুই রাজার রাজত্ব। ফেদেরারের রাজত্বে দেয়াল গড়েছিলেন নাদাল। আর সেখানে তৃতীয় ব্যক্তির মতো ঢুকে পড়েছিলেন জোকোভিচ। তাঁর খেলায় না আছে প্রাণ, না আছে সৌন্দর্য। রসকষহীন একেকটা ম্যাচ খেলে যান, প্রতিপক্ষ বিরক্ত হয়, দর্শকেরা বিরক্ত হন। কিন্তু ম্যাচ শেষে জয়টা ঠিকই পকেটে পুরে নিয়ে যান। মাঠে মাঝেমধ্যেই রগচটা হয়ে যান, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাঠেই র৵াকেট স্ম্যাশ করেন। টেনিসে যেটাকে কখনোই ভালো চোখে দেখে হয় না। ২০০৭ ইউএস ওপেনেই ফেদেরারকে লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, টিকতে পারেননি। কিন্তু পরের অস্ট্রেলিয়ান ওপেন দিয়েই গ্র্যান্ড স্লামে যাত্রা শুরু তাঁর। তখন কে ভেবেছিল ফেদেরার-নাদাল রাজত্বে এসে হানা দেবেন এক সার্বিয়ান। সেদিন থেকে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন হয়ে উঠেছে জোকোভিচের সবচেয়ে পছন্দের শিরোপা। গত ১৩ বছরে ৯ বারই নোভাকের হাত রাঙিয়েছে ‘দ্য হ্যাপি স্লাম’।
সার্বিয়ায় বোম্বিং সহসাই থামেনি, কিন্তু এমন একজন খেলোয়াড়কে হারিয়ে যেতে দেখতে পারেননি ইয়েলেনা। তাই নিজের পকেটের টাকা খরচ করে জোকোভিচকে নিয়ে আসেন জার্মানিতে।
রাফায়েল নাদাল ক্লে কোর্টের অবিসংবাদিত রাজা। ফেদেরার গ্রাস কোর্টের। জোকোভিচ কোর্টে পা দেওয়ার আগেই তাঁরা দখল নিয়ে ফেলেছেন টেনিসের প্রাচীন দুই রাজত্বের। দুজনের লড়াই ছিল হার্ড কোর্ট কার দখলে যায়, এ নিয়ে। সেখানে এসে বাদ সেধেছিলেন জোকোভিচ। এই যুগে টেনিসের সবচেয়ে প্রচলিত কোর্ট হলো হার্ড কোর্ট। সবদিক দিয়েই হার্ড কোর্ট লাভজনক, মানুষজন ঝুঁকবে না কেন? জোকোভিচের পথ ‘এলাম দেখলাম জয় করলাম’ টাইপ ছিল না। এসেছেন, পরিশ্রম করেছেন। নাদাল-ফেদেরারের কাছে পাত্তাও পাননি অনেক দিন। ধুঁকে ধুঁকে শিখেছেন, কীভাবে জিততে হয়। গুটি গুটি পায়ে হেঁটে আজ তিনি তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৮টি গ্র্যান্ড স্লামের মালিক।
টানা তৃতীয়বার অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জেতা জোকোভিচ কখনোই হারেননি বছরের প্রথম গ্র্যান্ড স্লামের ফাইনালে। অথচ এবারই হারের খুব কাছাকাছি এসে পড়েছিলেন। তৃতীয় রাউন্ডে চোট পেয়ে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন তাঁর সমর্থকদের। ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। একজন টেনিস তারকার জন্য সামান্য ব্যথা পাওয়াই হতে পারে কাল, হাতছাড়া হতে পারে শিরোপা। অথচ ফাইনালে এসে দেখা গেল, এগুলো কিছুই নয়। তরুণ দানিল মেদভেদেভও ফাইনালে এসেছিলেন টানা ২০ ম্যাচ জিতেই। কিন্তু জোকোভিচের ‘পাওয়ার টেনিসে’র কাছে পাত্তাই পাননি রাশিয়ার উঠতি তারকা।
মিনিট। ৭-৫, ৬-২, ৬-২ গেমে সরাসরি সেটে হারিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, বুড়ো হতে পারেন, কিন্তু খেলার ধার বিন্দুমাত্র কমেনি। শেষ মুহূর্তে এসে মেজাজ জোকোভিচের মতো হারিয়েছিলেন রুশ দানিল। কিন্তু অন কোর্টে দর্শকদের দুয়ো যেভাবে সাহায্য করে জোকোভিচকে, তেমনটা ব্যবহার করতে পারেননি দানিল।
দানিল মেদভেদেভ রানারআপ ট্রফি হাতে নিয়ে ছোট্ট একটা গল্প বললেন। বেশ কয়েক বছর আগের গল্প, যেবার তাঁর সঙ্গে জোকোভিচের প্রথম দেখা। গল্পের শেষটা করলেন এক আবেগঘন লাইন দিয়ে, ‘আমি সেদিনের বিশ্বের ৬০০ নম্বর খেলোয়াড় থেকে আজ ৪ নম্বরে উঠে এসেছি। তুমি সেদিনও যে রকম বন্ধুসুলভ ছিলে, আজও তেমনই আছ।’
এমনই এক চরিত্র নোভাক জোকোভিচ। ‘জোকার’ ডাকনামটাও অন কোর্ট আর অফ কোর্টের অদ্ভুত চরিত্র থেকেই। মাঠে আনন্দ, আমোদ, ফুর্তিতে মশগুল নোভাক অফ কোর্টেও একই রকম। টেনিসের টিপিক্যাল ‘গুড বয়’ চরিত্র নন তিনি। ডিসি কমিকসের ‘জোকার’ চরিত্রকে ধারণ করেন মনেপ্রাণে।
এর আগে মেলবোর্ন পার্কে কখনোই হারেননি জোকোভিচ। ৯ বার ফাইনালে উঠে ৯ বারই জয় তুলে নিয়ে গেছেন। সব মিলিয়ে ১৮ গ্র্যান্ড স্লাম নিয়ে এখন শিরোপা তালিকার তৃতীয়তে ‘জোকার’। পাঁড় নাদাল-ফেদেরারভক্তও চিন্তায়, তাঁদের ছাড়িয়ে যান কি না? কিন্তু জোকোভিচ সেদিনই জিতে গেছেন, যেদিন সার্বিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল থেকে এসে প্রথম শিরোপা তুলে ধরেছিলেন টেনিসের বিশাল মঞ্চে। আরও একবার চোটগ্রস্ত হয়ে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জয় সেটাই যেন নতুন করে বুঝিয়ে দিল।