বাংলাদেশের সমর্থকদের কাছে দিনটি হওয়ার কথা ছিল আনন্দের। প্রায় দুই বছর পর আবারও বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডকে হারানোর সুখস্মৃতি নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছে মাহমুদউল্লাহর দল। প্রতিপক্ষও স্কটল্যান্ড, ক্রিকেট দুনিয়ায় যাদের নাম শোনা যায় কালেভদ্রে। অথচ তারাই কিনা বিশ্বকাপে আটকে দিল বাংলাদেশকে। বিশাল বিশাল মহারথী নিয়ে বাংলাদেশ কিনা ম্যাচ হেরে গেল ‘ডেলিভারিম্যান’ ক্রিস গ্রিভসের কাছে।
ক্রিকেট দুনিয়ায় চমক শব্দটা নতুন কিছু নয়। খেলাধুলার ক্ষেত্রে বড় বড় দলও খেই হারিয়ে ফেলে চুনোপুঁটি দলের কাছে। খেলাটা যখন ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ভার্সন, তখন সেখানে এমন ঘটার সম্ভাবনাটাও অনেক বেশি। ছোট ফরম্যাট, একবার বড় দলকে চেপে ধরতে পারলেই উজ্জীবিত হয়ে ওঠে র্যাঙ্কিংয়ের নিচের দিকে থাকা দলগুলো। এরপর চাপটা শুধু ধরে রেখে নিজেদের খেলাটা ঠিকভাবে খেলতে পারলেই চলে। সেই সঙ্গে রয়েছে বড় দলের কিছুটা আত্মগরিমা। যে কারণে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ আস্তে আস্তে হারাতে শুরু করলেও খুব একটা পাত্তা দেয় না তারা। আর তার দাম চুকাতে হয় ম্যাচ হেরে।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এমন চমকে দেওয়া জড়িয়ে আছে শুরু থেকেই। চলো শুনি এমন কয়েকটি চমকে দেওয়া ম্যাচের গল্প।
জিম্বাবুয়ে বনাম অস্ট্রেলিয়া—২০০৭ বিশ্বকাপ
ফলাফল: জিম্বাবুয়ে ৫ উইকেটে জয়ী
২০০৭ বিশ্বকাপের চতুর্থ ম্যাচ ছিল সেটি। সদ্য ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতে আসা অস্ট্রেলিয়া তখন কোনো তর্ক ছাড়াই বিশ্বের সেরা ক্রিকেট দল। অন্যদিকে নিজেদের সেরা খেলোয়াড়দের হারিয়ে নতুন করে তরুণ এক দল গড়ে তুলছে জিম্বাবুয়ে। সেই তরুণ তুর্কিরাই এমন এক দৃশ্যের জন্ম দিল, যা শুধু টি-টোয়েন্টি নয়, ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম বড় চমক হয়ে রইল। ২০ ওভারে ১৩৮ করতেই হাঁসফাঁস করছিল অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সেরা ব্যাটিং লাইনআপ। ব্র্যাড হগের ২২ বলে ৩৫ রান না হলে হতো না সেটিও।
জিম্বাবুয়ের বোলাররা কাজটা করেই দিয়েছিলেন, বাকি ছিল ব্যাটসম্যানদের তীরে তরি ভেড়ানোটা। সেটি করাও সহজ কোনো বিষয় ছিল না। সামনে অস্ট্রেলিয়ার দুর্দান্ত বোলিং লাইনআপ—ব্রেট লি, মিচেল জনসনরা। কিন্তু তাঁদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ২১ বছর বয়সী ব্রেন্ডন টেলর খেললেন ৪৫ বলে ৬০ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। ইনিংসের শেষ বল পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে জিম্বাবুয়েকে এনে দিলেন ৫ উইকেটের এক অবিস্মরণীয় জয়। সেই সঙ্গে রচনা করলেন ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম চমকের গল্পও।
বাংলাদেশ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ—২০০৭ বিশ্বকাপ
ফলাফল: বাংলাদেশ ৬ উইকেটে জয়ী
আগের রাতে অস্ট্রেলিয়ার পরাজয় দেখে যাঁরা ঘুমাতে গিয়েছিলেন, তাঁরা হয়তো ভাবতেও পারেননি, পরপর দুই দিন দুটি চমক দেখবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখনো এখনকার মতো টি-টোয়েন্টি জগতের ত্রাস হয়ে ওঠেনি। কিন্তু নাম-জশ তো একটা ছিলই। বাংলাদেশেরও টি-টোয়েন্টি জগতে প্রথম আগমন। কিন্তু আসতে না আসতেই এমন চমক দেখাবে, কে জানত?
শুরুটা ভালোই করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাংলাদেশের মতো দলের জন্য ১৬৪ রান তখন বিশালই বলা যায়। সাকিব আল হাসান ৪ উইকেট নিয়ে রাশ টেনে না ধরলে হয়তো আরও অনেক দূর যেতে পারত রান। কিন্তু তখন এই রান তাড়া করাই বাংলাদেশের জন্য বিরাট ব্যাপার। তার ওপর ২৮ রানে দুই ওপেনার নেই। সেটাই যেন শাপেবর হয়ে এল বাংলাদেশের জন্য। ক্রিজে আসা আফতাব আহমেদ আর অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল তাণ্ডব চালালেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলারদের ওপর। আউট হওয়ার আগে ৭ চার আর ৩ ছক্কায় ২৭ বলে ৬১ রান করে গিয়েছিলেন আশরাফুল। আর অপর পাশে ৪৯ বলে ৬২ করে ম্যাচ শেষ করে ফিরেছিলেন আফতাব আহমেদ। সেদিন দুজনের ব্যাটে ভর করেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিল বাংলাদেশ।
ইংল্যান্ড বনাম নেদারল্যান্ডস—২০০৯ বিশ্বকাপ
ফলাফল: নেদারল্যান্ডস ৪ উইকেটে জয়ী
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসরে অবশ্য চমকের জন্য ৪ ম্যাচের অপেক্ষা করতে হয়নি। প্রথম ম্যাচেই স্বাগতিক দর্শকদের চমকে দিয়েছিল নেদারল্যান্ডস। স্বাগতিক ইংল্যান্ডের দর্শকেরা ভেবেছিলেন, বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ দেখবেন নির্ভার হয়ে। কিন্তু তাঁদের একেবারে নাড়িয়ে দিয়েছে ইউরোপিয়ান সঙ্গী নেদারল্যান্ডস। বিশাল ওপেনিং পার্টনারশিপের পর ইংল্যান্ডের ইনিংস শেষ হয়েছিল ১৬২ রানে। সবাই ধরেই নিয়েছিলেন, নেদারল্যান্ডসের পক্ষে এই রান পার করা অসম্ভব।
কিন্তু ব্যাটিং শুরু হতেই বোঝা গেল, তালে তাল মিলিয়ে ব্যাটিং করছে নেদারল্যান্ডস। ছোট ছোট অবদানে শেষ ওভারে দরকার ছিল ৭ রান। স্টুয়ার্ট ব্রডের সেই ওভারে শেষ বলে ২ রান নিয়ে ম্যাচ নিজেদের করে নিল নেদারল্যান্ডস। আর দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম চমক তৈরি হলো সেখানেই। হোম অব ক্রিকেট লর্ডসে ১৬৩ তাড়া করে কমলা বাহিনী লিখল নিজেদের নতুন ইতিহাস। লর্ডসের আত্মবিশ্বাসটা ২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও কাজে লাগিয়েছিল নেদারল্যান্ডস। বাংলাদেশে হওয়া সেই বিশ্বকাপেও ইংল্যান্ডকে ৪৫ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়েছিল ডাচরা। নেদারল্যান্ডসের ১৩৩ রানের জবাবে মাত্র ৮৮ রানে অলআউট হয়ে যায় হেলস-মরগান-বাটলারদের ইংল্যান্ড। ক্রিকেট–বিশ্বকে আরও একবার চমকে দেয় নেদারল্যান্ডস।
বাংলাদেশ বনাম হংকং—২০১৪ বিশ্বকাপ
ফলাফল: হংকং ২ উইকেটে জয়ী
নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে হংকংয়ের মতো দলের বিপক্ষে হার—কেই–বা মেনে নিতে পারে? বাংলাদেশকে মেনে নিতে হয়েছিল। সেবার বিশ্বকাপে বাংলাদেশ স্বাগতিক। নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ, সমর্থকদের আশাও ছিল তুঙ্গে। বাংলাদেশের জন্য ‘লাকি’ স্টেডিয়ামখ্যাত চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামে বাংলাদেশি সমর্থকেরা গিয়েছিলেন ধুন্ধুমার এক ম্যাচ দেখতে। এর আগেই মূল পর্ব নিশ্চিত করে রাখায় একটু ধীরেই এগোচ্ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সেটাই যে কাল হবে, কে জানত? ১০৮ রানে অলআউট হয়ে যায় পুরো দল। সাকিব-মুশফিক হাল না ধরলে ১০০ রানও পেরোতে পারত না বাংলাদেশ। নাদিম আহমেদ আর নিজাকাত খান মিলে একেবারে ধসিয়ে দেন বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ।
বোলিংয়ে এসে পিচের সুবিধা বাংলাদেশও নিয়েছিল, কিন্তু যথেষ্ট ছিল না সেটা। ম্যাচ শেষ ওভার পর্যন্ত গড়ালেও হংকংকে থামাতে পারেনি বাংলাদেশ। টেস্ট খেলুড়ে দলকে নিজেদের মাটিতে হারিয়ে গর্বভরে সে বিশ্বকাপ থেকে বাড়ি ফিরেছিল হংকং।
আফগানিস্তান বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ—২০১৬ বিশ্বকাপ
ফলাফল: আফগানিস্তান ৬ রানে জয়ী
২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কথা উঠলেই চোখে ভাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ্বকাপ জয়ের মুহূর্তটি। ইংল্যান্ডের বেন স্টোকসের করা শেষ ওভারে পরপর ৪ বলে ৪টি ছয় হাঁকিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বিশ্বকাপ জেতান কার্লোস ব্রাফেট। কিন্তু অনেকেরই হয়তো মনে নেই, গ্রুপ পর্বে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজই হেরে বসেছিল নিজেদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ খেলতে আসা আফগানিস্তানের কাছে।
শুরুটা অবশ্য ফেবারিটদের মতোই শুরু করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। স্যামুয়েল বাদ্রি, আন্দ্রে রাসেলের বোলিংয়ে ৫৬ রানেই ৫ উইকেট খুইয়ে ধুঁকছিল আফগানরা। তখনই ক্রিজে এসে ৪০ বলে ৪৮ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন নজিবউল্লাহ জাদরান। তাঁর ইনিংসে ভর করে ১২৩ রানের লড়াকু পুঁজি পায় আফগানিস্তান।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের তারকাসমৃদ্ধ ব্যাটসম্যানদের কাছে ১২৩ কোনো লক্ষ্যই হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু অল্প পুঁজিতে কী করে লড়াই করতে হয়, তা জানে আফগানিস্তান। রশিদ খান, মোহাম্মদ নবীর নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ৮ উইকেটে ১১৭ রানে থামতে হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। ৬ রানের রোমাঞ্চকর এক ম্যাচ জিতে নেয় আফগানিস্তান। হয়তো এই হারে নড়েচড়ে বসেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফলাফল তো দেখতেই পেল ক্রিকেট–বিশ্ব। দ্বিতীয়বারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছিল ড্যারেন স্যামির দল।