ইউরোর মতো বড় ফুটবল টুর্নামেন্টগুলোয় সব সময়ই নজর কেড়ে নেয় ফেবারিটরা, যাদের আখ্যায়িত করা হয় ‘বড় দল’ হিসেবে। শক্তিমত্তার বিচারে তাদের কেউ কেউ দুর্বল হলেও তারকা খেলোয়াড়, অতীত ইতিহাস, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি সমীকরণের অঙ্ক কষে ঠিকই ফেবারিটের তকমা লাগিয়ে দেন ভক্তরা। তথাকথিত ‘ছোট দল’গুলো থেকে যায় আলোচনার বাইরে। অবশ্য এই অবহেলার খানিকটা সুফলও মেলে। পাদপ্রদীপের আলো তাদের ওপর না থাকায়, অনেকটা চুপিসারেই নিজেদের শক্তির পাল্লা ভারী করতে পারে তারা। কেবল অগ্নিপরীক্ষায় কোনো বড় দলকে কাঁপিয়ে দিলেই সবার নজর ফেরে তাদের দিকে, যেমনটা ফিরেছে এবারের ইউরোর ডেনমার্ক, চেক প্রজাতন্ত্র, সুইজারল্যান্ড আর ইউক্রেনের ওপরে। চারটি দলই উঠেছে আসরটির কোয়ার্টার ফাইনালে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স, ইউরো চ্যাম্পিয়ন পর্তুগাল, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসের মতো ফেবারিটরা বিদায় নিয়েছে টুর্নামেন্ট থেকে। এই দলগুলোর হঠাৎ উত্থানের রহস্য কী?
সোনালি প্রজন্ম
যদিও একসময় ফুটবল–বিশ্বের শক্তিধরদের তালিকার প্রথম সারিতেই থাকত ডেনমার্ক ও চেক প্রজাতন্ত্র। ১৯৯২ সালের ইউরোর চ্যাম্পিয়ন ডেনিশরা। চেকোস্লোভাকিয়ার সময়কালে চেকদেরও সমীহ করে কথা বলত প্রতিপক্ষরা। তবে একেকটা দলের শক্তিমত্তা নির্ভর করে কয়েকটা বিষয়ের ওপর। যেমন খেলোয়াড়দের সোনালি প্রজন্ম, তাদের ঠিকমতো পরিচর্যা ও ব্যবহার করতে পারা। সেটি ঠিকমতো হচ্ছিল না ডেনমার্কের। তবে ১৯৯২ সালের পর আবারও একটি সোনালি প্রজন্ম পেয়েছে ডেনমার্ক। ক্যাসপার স্মাইকেল, সিমন কায়ের, পিয়েরে এমিল হোয়েবার্গ, ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন, ইউসুফ পোলসেন, মার্টিন ব্রাথওয়েট—প্রত্যেকেই খেলেন ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবগুলোতে। জাতীয় দলের জার্সিতেও সামর্থ্যের প্রমাণ রেখে তাঁরা এগিয়ে নিচ্ছেন ডেনমার্ককে।
এরিকসেনে উজ্জীবিত ডেনমার্ক
এবারের আসরের কথাই ধরা যাক। ফিনল্যান্ডের বিপক্ষে ডেনমার্কের প্রথম ম্যাচে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হন দলের সেরা মিডফিল্ডার, প্লেমেকার ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছিটকে পড়েন টুর্নামেন্ট থেকে। আবেগতাড়িত সেই ম্যাচে দুর্দান্ত খেলেও ফিনল্যান্ডের কাছে ১-০ গোলে হেরে যায় ডেনমার্ক। দ্বিতীয় ম্যাচে বেলজিয়ামের বিপক্ষে শুভসূচনা করেও ২-১ গোলের হারে অনেকেই লিখে ফেলেছিলেন ডেনিশদের বিদায়। ঠিক তখনই ফিনিক্স পাখির মতো জ্বলে উঠল তারা, গ্রুপের শেষ ম্যাচে রাশিয়াকে ৪-১ গোলে বিধ্বস্ত করল এরিকসেনের দল। সব রকমের সমীকরণে পানি ঢেলে গ্রুপ রানার্সআপ হয়ে শেষ ১৬ নিশ্চিত করল ডেনমার্ক। আর শেষ ১৬–তে ওয়েলসকে পেয়ে হেসেখেলে হারিয়ে নিশ্চিত করেছে কোয়ার্টার ফাইনাল। এই ম্যাচে তারা জিতেছে ৪-০ গোলে। দলের প্রয়োজনে যেমন গোল করেছেন স্ট্রাইকাররা, তেমনি ডিফেন্ডাররাও, দলগত অবদান যাকে বলে।
সাধারণত ছোট দলগুলো রক্ষণাত্মক সাহায্য নিয়ে খেলে থাকে, শক্তিশালী দলের বিপক্ষে আক্রমণ আটকে দিয়ে কাউন্টার অ্যাটাকে গোল করাটাই সাধারণত মূল দর্শন হয় তাদের। কিন্তু ডেনমার্কের খেলায় এর কোনো ছাপ নেই। রীতিমতো দৃষ্টিনন্দন আক্রমণের পসরা সাজিয়ে ঘায়েল করেছে প্রতিপক্ষকে। বর্তমান ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের প্রথম দল বেলজিয়ামকে মুহুর্মুহু আক্রমণে তটস্থ করে রেখেছিল তারা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফল তাদের পক্ষে আসেনি।
তবে সোনালি প্রজন্মের খেলোয়াড়দের সঙ্গে দলগত রসায়নটাও জরুরি। গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনার কৌশলগত দর্শনও। এসবের সম্মিলিত ফলাফলই ডেনমার্কের এমন চোখধাঁধানো সাফল্য।
সঠিক কৌশলের ব্যবহার
চেক প্রজাতন্ত্রের ব্যাপারটা খানিক আলাদা। ডেনমার্কের মতো তারা মার মার কাট কাট আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে না, এমনকি এটি তাদের ইতিহাসের সেরা প্রজন্মও নয়। তবু দলগত রসায়ন ও সঠিক কৌশলের ব্যবহার সাফল্য এনে দিচ্ছে তাদের। ক্রোয়েশিয়া, ইংল্যান্ডের মতো দুই পরাশক্তির সঙ্গে একই গ্রুপে থেকেও ভালো ফুটবল খেলে তারা জায়গা করে নিয়েছিল শেষ ১৬-তে। এ ধাপে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল নেদারল্যান্ডস। পুরোনো আধিপত্য না থাকলেও শক্তিমত্তার বিচারে চেকদের চেয়ে এগিয়ে ডাচরা। ধারালো আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে তারা পা দিয়েছে শেষ ১৬-তে। ফলে বেশির ভাগ ফুটবলবোদ্ধাই চেকদের ইউরো–যাত্রার সমাপ্তি টেনেছিলেন।
কিন্তু ম্যাচের ফল হলো উল্টো। ২-০ গোলে শক্তিধর ডাচদের চেকমেট করল চেকরা। নিজেদের ডিফেন্সকে আঁটসাঁট রেখে প্রতিপক্ষের ভুলের সুযোগে গোল করাটাই তাদের খেলার মূলমন্ত্র। ম্যাচের ৫৫ মিনিটে ডিফেন্ডার ডি লিখটের লাল কার্ডে ১০ জনের দলে পরিণত হয় নেদারল্যান্ডস। এরই সুযোগ নিয়ে দুটি গোল আদায় করে নেয় চেক প্রজাতন্ত্র। অথচ ম্যাচটিতে আধিপত্য করেছিল ডাচরাই।
যেমনটি বলেছিলাম, নিজেদের রক্ষণকে সুরক্ষিত রাখাটাই চেকদের খেলার প্রথম মন্ত্র। ইউরোর চার ম্যাচে মাত্র দুটি গোল হজম করেছে চেক প্রজাতন্ত্র, যেখানে তারা মুখোমুখি হয়েছে যোজন শক্তিতে এগিয়ে থাকা ক্রোয়েশিয়া, ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের। আর প্রতিপক্ষের ভুলের সদ্ব্যবহার করতে তাদের প্রধান অস্ত্রের নাম পাত্রিক শিক। ২৫ বছর বয়সী এই তরুণ এরই মধ্যে করেছেন চার গোল। যার মধ্যে একটি আছে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে গোলকিপারের ভুলের সুযোগ নিয়ে ৪৯.৭ মিটার দূর থেকে করা রেকর্ড গড়া গোল। মূলত নিখুঁত ফিনিশিং করতে পারার গুণের কারণে শিক যেন একাই টেনে নিয়ে চলছেন চেককে।
হার না মানা মানসিকতা
সুইজারল্যান্ড গ্রুপ পর্বের শুরুটা করেছিল ঢিমেতালে। নিজেদের পরিপূর্ণভাবে মেলে ধরেছে শেষ ১৬-তে এসে। ফ্রান্সের মতো পরাশক্তির বিপক্ষে ৮০ মিনিট পর্যন্ত পিছিয়ে ছিল ৩-১ গোলে। এরপরও হার না মানা মানসিকতায় শেষ ১০ মিনিটে করেছে দুই গোল। বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন এবং গত ইউরোর রানার্সআপ ফ্রান্সের বিপক্ষে এভাবে টেক্কা দিয়ে লড়াই করা সুইসরা রূপকথা গড়েছে সে রাতে। করিম বেনজেমা, এমবাপ্পে, গ্রিজমানদের মতো ধারালো আক্রমণের পাল্টা জবাবে শাকিরি, সেফেরোভিচরা জ্বলে উঠে জানান দিয়েছেন নিজেদের সামর্থ্যের। কোয়ার্টার ফাইনালে তাঁদের প্রতিপক্ষ সাবেক বিশ্ব ও ইউরো চ্যাম্পিয়ন স্পেন।
ওদিকে ইউক্রেনের সাফল্যের সূত্রধর আন্দ্রে শেভচেঙ্কো। কিংবদন্তি এই ফুটবলার ছিলেন ইউক্রেনের ইউরো ইতিহাসের প্রথম গোল স্কোরার। তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনে ইউক্রেন কখনো ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছাতে না পারলেও কোচ হয়ে ছুঁয়েছেন সে অর্জন। সাবেক ব্যালন ডি’অরজয়ী শেভচেঙ্কো ২০১৬ সালে জাতীয় দলের কোচ হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর থেকে ইউক্রেনের খেলায় ধারাবাহিক উন্নতি চোখে পড়ার মতো। ইউরোর এবারের আসরে কার্যকর ফুটবল খেললেও গ্রুপ পর্বে তেমন দাপট দেখাতে পারেনি পূর্ব ইউরোপের দেশটি। কিন্তু নকআউট পর্বে প্রতিপক্ষ সুইডেনের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলেছে তারা। এর সুফল হিসেবে ধরা দিয়েছে ঐতিহাসিক অর্জন। ৯০ মিনিটে ১-১ গোলে ড্র থাকার পর অতিরিক্ত সময়ের খেলায় দুই দলই ছিল সমানে সমান। তবে সুইডিশ ডিফেন্ডার ড্যানিয়েলসন বিপজ্জনক এক ফাউল করে বসায় লাল কার্ড দেখেন। সুইডেনের এই বিপাকের মুহূর্তের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন শেভচেঙ্কোর শিষ্যরা। অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের খেলায় সুইডেনকে কোণঠাসা করে রেখেছিলেন তাঁরা। একদম শেষ মুহূর্তে ইনজুরি সময়ে গোল করে ইউক্রেন। ছোট দল হিসেবে টুর্নামেন্ট শুরু করা ইউক্রেন পৌঁছে গেল কোয়ার্টার ফাইনালে। জিনচেঙ্কোর ক্রস থেকে আসা বদলি স্ট্রাইকার দোবভিকের গোলটি না হলে টাইব্রেকারে গড়াত দুই দলের ভাগ্য। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হবে তারা।
তবে চেক প্রজাতন্ত্র কিংবা ডেনমার্ক, রূপকথার মতো উড়তে থাকা দল দুটির কোনো একটিকে থামতে হবে ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে। কেননা সূচি অনুসারে একে অপরের বিপক্ষে খেলবে তারা। ওদিকে সুইজারল্যান্ড ও ইউক্রেনও তাদের চমক অব্যাহত রাখে কি না, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে ২ জুলাই পর্যন্ত ।
ইউরোর ইতিহাসে ছোট দলের চমক দেওয়ার ঘটনা এবারই কিন্তু প্রথম নয়! ১৯৯২ সালে ডেনমার্কের ইউরো জয়ও চমকে দিয়েছিল ফুটবলপ্রেমীদের। তবে সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত চমক দেখিয়েছিল গ্রিস, ইউরো ২০০৪-এ। রাউলের স্পেন, মাইকেল বালাকের জার্মানি, ফ্রানসেস্কো টট্টির ইতালি, জিদান-অঁরির ফ্রান্স, ফিগো-রোনালদোর পর্তুগাল ছিল সেবারের হট ফেবারিট। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় গ্রিস। অঘটনের সেই যাত্রাপথে তারা গোল ব্যবধানে স্পেনকে হটিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছিল, সেখানে ফ্রান্সকে আটকে দেয় ১-০ গোলে। সেমিফাইনালে পাভেল নেদভেদের চেক প্রজাতন্ত্রকে অতিরিক্ত সময়ের একমাত্র গোলে হারিয়ে ফাইনাল খেলার যোগ্যতা পায়। এমনকি ফাইনালেও ফিগো, রোনালদোর পর্তুগালের বিপক্ষেও একটি মাত্র গোল করে ইউরোপ–সেরার মুকুট মাথায় নেয় গ্রিস। অঘটনঘটনপটিয়সী গ্রিকরা সেবার খেলেছিল চূড়ান্ত রক্ষণাত্মক ফুটবল। কোনোক্রমে একটি গোল করতে পারলেই দলের সবাই মিলে প্রতিপক্ষের আক্রমণ আটকাতে জানপ্রাণ উজাড় করে দিত। ছোট দল হিসেবে গ্রিসের ইউরো জয়ের কৌশল নিয়ে তাই বীরত্বগাথার বদলে সমালোচনাও হয় অনেক।