মেজাজটাই গরম হয়ে গিয়েছিল মাশরুর রেজার, ‘তোকে খেলতে বলি ফুটবল, আর তুই কি না খেলিস ক্রিকেট। ক্রিকেট একটা খেলা হলো! কী হবে মড়ার খেলাটা খেলে!’
মাশরুর রেজার মেজাজ খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক। নিজে ছিলেন ফুটবলার। স্বপ্ন ছিল, একদিন জাতীয় দলের হয়ে খেলবেন। গায়ে চড়াবেন লাল-সবুজ জার্সিটা। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তবে নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন ভাগনে উজ্জ্বলকে, যে উজ্জ্বল ঠিকই একদিন খেলেছেন বাংলাদেশ ফুটবল দলে।
কিন্তু নিজের ভাগনের জাতীয় দলে খেলা আর নিজের ছেলের খেলার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে। প্রত্যেক বাবাই চান তাঁর অতৃপ্ত, অপূর্ণ স্বপ্ন নিজের সন্তান পূরণ করবে। ফলে তাঁর ছেলে বড় হয়ে একদিন বড় ফুটবলার হোক—এই তো চাওয়া ছিল মাশরুর রেজার।
কিন্তু ছেলেটা? তার চাওয়া যে একেবারেই অন্য রকম। সে-ও জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখে ঠিকই। গায়ে লাল-সবুজ জার্সিটা পরার স্বপ্নও দেখে। তবে ফুটবল দিয়ে নয়, ক্রিকেটে। ক্রিকেটই তার ভালোবাসা। ধ্যানজ্ঞান। ফুটবল বনাম ক্রিকেট। বাবা বনাম ছেলের স্বপ্ন। এই লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছেন দেখে খেপে গিয়ে বাবা মাশরুর রেজা একদিন করলেন কী, দা-বঁটি দিয়ে কেটে টুকরা টুকরা করে ফেললেন ছেলের ব্যাট-বল!
না, তাতেও ক্রিকেট খেলা থামেনি ছেলেটার। কোনো একটা কাজের প্রতি এত্ত এত্ত ভালোবাসা থাকলে কী হয়, সেটাই দেখিয়ে দিল সেই ছেলে। একদিন সত্যি সত্যিই জাতীয় দলে খেলে ফেলল সে। এবং শুধু জাতীয় দলের বড় তারকা নয়, সেই ছেলে একদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই হয়ে উঠল মস্ত বড় এক ক্রিকেটার। বিশ্বের বাঘা বাঘা সব ক্রিকেটারকে ছাপিয়ে হয়ে গেল আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর অলরাউন্ডার। সেই ছেলেই আমাদের সাকিব আল হাসান।
সাকিবকে তো আমরা সবাই চিনি। কিন্তু ফয়সাল? ফয়সালটা আবার কে?
ফয়সালকে চিনতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে মাগুরা শহরের আলোকদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে।
আজ থেকে এক যুগ আগের কথা। ২০০১ সাল। ফয়সাল তখন পড়ে ক্লাস সেভেনে। খুব শান্ত স্বভাবের এক ছেলে। বয়সের তুলনায় একটু যেন বেশিই চাপা স্বভাবের। দুষ্টুমি নেই। পাড়ার এর-ওর বাসার গাছ থেকে পেয়ারা চুরি করার অভিযানে নেই। বন্ধুদের ঝগড়া-মারামারিতেও নেই। সে পড়ে আছে শুধু ক্রিকেট নিয়ে। সে-ই শুধু ক্রিকেটকে ভালোবাসে না, ক্রিকেটও যেন তাকে ভালোবাসে খুব। সেই ছোট্টটি থাকতেই ব্যাট-বলের এই খেলাটা সে খেলে দুর্দান্ত।
খুব ভালো খেলে বলেই নানা জায়গা থেকে ডাক আসে ‘খ্যাপ’ খেলার। খ্যাপ হলো এ পাড়ার সঙ্গে ও পাড়ার ম্যাচে কোনো একটা দলের হয়ে খেলা, বিনিময়ে অল্প কিছু টাকা পাওয়া। তো এমনই একটা ম্যাচ খেলতে মাগুরা থেকে বাসের ছাদে চেপে এই আলোকদিয়ার মাঠে এসেছে ফয়সাল।
সেই ম্যাচে এতটাই ভালো খেলেছিল, তার খেলা দেখে ম্যাচের আম্পায়ার সাদ্দাম হোসেন (গোর্কি) রীতিমতো মুগ্ধ। এই ম্যাচে আম্পায়ার হলেও সাদ্দাম আদতে একজন ক্রিকেটপাগল মানুষ। নিজের একটা দলও আছে তাঁর মাগুরায়। ইসলামপুরপাড়া স্পোর্টিং ক্লাব। ফয়সালে মুগ্ধ হয়ে তিনি প্রস্তাব দিয়ে বসলেন তাঁর দলের হয়ে খেলার জন্য।
ছেলেটাও চলে এল একদিন। ছেলেটা মূলত পেস বোলিং করে। সেটিও সত্যিকারের ক্রিকেট বলে নয়, টেপ টেনিসে। সত্যিকারের ক্রিকেট বল তখনো হাত দিয়ে ধরার সৌভাগ্য হয়নি তার। সত্যি, অবাক করার মতোই কাণ্ড। যে ছেলেটার সত্যিকারের ক্রিকেট বল জীবনের এত পরে এসে ধরার সৌভাগ্য হবে, একদিন ক্রিকেট বলই নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাববে, এই ছেলেটার হাতের স্পর্শ পেয়ে!
ইসলামপুরপাড়া ক্লাবের নেটেও ফয়সাল প্রথমে পেস বোলিং করল, পরে শখের স্পিন। সাদ্দামের অভিজ্ঞ চোখ বলল, ছেলেটার হাতে স্পিনই বেশি খেলে। বললেন, ‘তুমি স্পিনই করো।’ কদিন পরই মাগুরা লিগে অভিষেক হলো ফয়সালের। সত্যিকার ক্রিকেট বলে প্রথমবারের মতো কোনো ম্যাচে বল করতে এল ফয়সাল। এবং কী আশ্চর্যের কথা, জীবনের প্রথম বলেই উইকেট! সেই ফয়সালটাই আমাদের সাকিব, সাকিব আল হাসান। ফয়সাল ডাকনামটা যার আড়ালেই চলে গেছে ভক্তদের সাকিব সাকিব স্লোগানে!
তবে মায়ের কাছে তো তিনি এখনো ফয়সালই, আদরের ফয়সাল। সেই মা শিরিন আখতারও বলেছেন, কতটা খেলাপাগল ছিলেন সাকিব, ‘ছোটবেলা থেকে খেলার অস্বাভাবিক নেশা ছিল ওর। বাসায়ও সব সময় হাতে বল থাকতই। লোফালুফি করছে, নয়তো দেয়ালে মেরে ক্যাচ ধরছে, খাওয়ার সময় পর্যন্ত নেই। বিকেএসপিতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ওকে খাইয়ে দিতে হয়েছে আমাকে।’
মায়ের প্রশ্রয় পেয়েছেন। কিন্তু বাবা? বাবার যে খুব রাগ। মাশরুর রেজার সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় ব্যাট-বল কেটে ফেলার প্রসঙ্গটা তুলতেই তিনি হাসলেন। মনে হলো, একটু যেন বিব্রতকর হাসি, ‘ওই একবারই কেটেছি। আসলে ছেলেটা ক্রিকেট খেলে কদ্দুর যেতে পারবে সেটা তো আর জানতাম না। আমি ভেবেছিলাম, হয় ছেলেটা ফুটবলার হবে। নয়তো পড়ালেখা করবে। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে যদি পড়াশোনার ক্ষতি হয়। ছাত্র যে খুবই ভালো ছিল।’
কতটা ভালো ছাত্র ছিলেন সাকিব? বাবার কাছেই শোনা গেল, জীবনে কখনো তৃতীয় হননি। প্রায় সময়ই প্রথম হতেন। বড়জোর দ্বিতীয়। সাকিব যেন ছোটবেলা থেকেই ‘নাম্বার ওয়ান’ হওয়ার জন্যই জন্মেছেন!
মাগুরা থেকে বিকেএসপি। সেখান থেকে বয়সভিত্তিক দল হয়ে এক্কেবারে জাতীয় দল। সাকিবের উত্থানটা হয় অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। প্রতিটা ধাপেই যে একের পর এক চমক উপহার দিয়েছেন তিনি।
প্রতিভা বাছাইয়ের জন্য একটা ট্রায়ালে বিকেএসপির কোচরা এসেছিলেন মাগুরায়। ফুটবল, ক্রিকেট, অ্যাথলেটিকস—সব ধরনের খুদে প্রতিভা খুঁজছিলেন তাঁরা। মাশরুর রেজা যেহেতু ফুটবলার ছিলেন, জেলা ফুটবল সংস্থার সঙ্গেও জড়িত, তাই তাঁকে ভার দেওয়া হয়েছিল ফুটবলার খোঁজার দায়িত্বে। আর সাকিব? তিনি তখন ক্রিকেটার বাছাইয়ের লাইনে দাঁড়িয়ে!
বিকেএসপির এক কর্মকর্তা বাছাইয়ের একপর্যায়ে ছুটে এলেন মাশরুর রেজার কাছে, ‘আপনি তো বলেন নাই আপনার ছেলেও এই বাছাইয়ে আছে, ক্রিকেটে।’ মাশরুর বললেন, ‘আমি বলব কেন? খেলা জিনিসটা সুপারিশ দিয়ে হয় না। নিজের মধ্যে প্রতিভা থাকা লাগে। ওর মধ্যে যদি প্রতিভা না থাকে, আর আমি যদি আপনাদের ওকে নেওয়ার অনুরোধ করি, ও আর কত দূরই বা যাবে?’
যাবে মানে, অনেক দূরই যাবে। সেই কর্মকর্তা সাকিবের মধ্যে সেই প্রতিভার ঝলক দেখতে পেয়েছিলেন। বিকেএসপির এক মাসের ট্রায়ালে নির্বাচিত হয়েছেন সাকিব। দ্রুত পূরণ করতে হবে ফরম। কিন্তু সাকিব যে সঙ্গে ছবিই আনেননি! সেই ছবিও দ্রুত আনা হলো। এক মাসের ট্রায়ালে সাকিব গেলেন পাশের জেলা নড়াইলে। মাশরাফি বিন মুর্তজার নড়াইল!
মাশরাফির বাবা আর সাকিবের বাবা ফুটবলের সূত্রেই ছিলেন কাছের বন্ধু। মাশরাফি তত দিনে জাতীয় দলের তারকা। মাশরাফির কাছেই মাশরুর রেজা জানতে চান, ‘বাবা, আমার ছেলেটাকে দিয়ে কি হবে?’
বাবা তিনি। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ তো হবেই। মাশরুর রেজার একটাই কথা। ছেলে ছাত্র হিসেবে তুখোড়। যদি খেলাধুলায় কিছু না-ই হয়, খামোখা সেখানে সময় নষ্ট করা কেন? এর চেয়ে মন দিয়ে পড়ুক।
মাশরাফি তাঁকে আশ্বস্ত করেন, ‘চাচা, আপনে কোনো চিন্তা কইরেন না তো। এইখান থেকে বিকেএসপিতে যদি একজনও চান্স পায়, সেইডেই হবে সাকিব।’
মাশরাফির কথাই সত্যি হলো। কিন্তু বিকেএসপিতে সরাসরি ভর্তির সুযোগ এত সহজ নয়। এবার ছয় মাসের একটা ট্রায়াল। সেই ট্রায়ালও হবে ঢাকায়। আর সেই ট্রায়ালে সারা বাংলাদেশের ভেতর সাকিব পেলেন সর্বোচ্চ নম্বর! সাকিবের ফাইলের ওপর একটাই সংখ্যা লেখা: ওয়ান!
ব্যস, বিকেএসপিতে ভর্তি হয়ে গেলেন সাকিব। যে বাবা একদিন নিজ হাতে ছেলের ব্যাট-বল কেটেছিলেন, সেই তিনিই ৪৫ হাজার টাকা খরচ করে কিনে দিলেন ব্যাট, বল, প্যাড, গ্লাভস, স্পাইকওয়ালা জুতা।
কিন্তু এত্তটুকুন বয়সে বিকেএসপিতে থাকতে মোটেও ভালো লাগত না সাকিবের। বিশেষ করে মাকে ছেড়ে থাকতে। গোপনে কেঁদেছেনও অনেক। একবার নাকি বিকেএসপি ছেড়ে চলেই আসতে চেয়েছিলেন বাড়িতে! ভাগ্যিস আসেননি। এলে কি আর আজকের সাকিবকে আমরা পেতাম!
কারণ, সেই বিকেএসপি থেকেই এরপর একে একে অনূর্ধ্ব ১৩, ১৫, ১৯ দলের সিঁড়ি ভাঙা। সেখান থেকে জাতীয় দল। সাকিব যে দলেই খেলেছেন, বেশির ভাগ সময় ব্যাটে-বলে ঝড় তুলে জানান দিয়েছেন নিজের আগমনী বার্তার।
সবাই জানত, হ্যাঁ, আসছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক রাজপুত্র!