রোমাঞ্চকর, শ্বাসরুদ্ধকর, অবিশ্বাস্য...আরও কোনো বিশেষণ থাকলে যোগ করে দিতে পারো। রাফায়েল নাদালের ফিরে আসাকে বাংলা শব্দের সব বিশেষণে বিশেষায়িত করলেও বোধ হয় কম হয়ে যাবে। বয়স ৩৬ ছুঁই ছুঁই, চোটে জর্জরিত শরীর, কোর্টের অপর পাশে ফর্মের তুঙ্গে থাকা দানিল মেদভেদেভ—কোনো কিছুই তাঁর জন্য বাধা নয়। ক্যারিয়ারের শেষবেলায় যে প্রতিজ্ঞা করেছেন নিজের কাছে, তা পূরণ করতে অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলাটাও নস্যি এই স্প্যানিশ তারকার কাছে।
বেশি দিন আগের কথা নয়, পাঁচ মাস আগেও ক্রাচে ভর করে হাঁটতে হয়েছে নাদালকে। পায়ের পাতার ইনজুরিতে মাটিতে পা ফেলতে পারেননি এক মাস। এবার খেলাটা ছেড়েই দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন ডাক্তার। আর কত? ২০ বছরের ওপরে ক্যারিয়ার নাদালের, ২০টি গ্র্যান্ড স্লাম, শরীরের সঙ্গে লড়াই করে কম তো হলো না। এবার অন্তত শরীরটাকে রক্ষা তো দিতেই পারেন।
এমন কথা অবশ্য নতুন নয়, ক্যারিয়ারের শুরু থেকে অসংখ্যবার ডাক্তারের ‘ছেড়ে দাও’ শুনতে হয়েছে নাদালকে। প্রথমবার শুনতে হয়েছিল সেই ১৬ বছর বয়সে। পেশাদার টেনিসে মাত্র অভিষেক হয়েছে তাঁর। প্রথমবারের মতো উইম্বলডন খেলে ফিরেছেন, অল্প বয়সে এমন চোট বেশ মারাত্মক। এই শরীরে টেনিস খেলা মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। নাদাল সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজের পায়ে কুড়ালই মারবেন। কোর্টে ফিরলেন, এক বছরের মাথায় বাগিয়ে নিলেন নিজের প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম। ১৮ বছর বয়সে সবাই যেখানে পেশাদার টেনিসে পা দেওয়ার স্বপ্ন দেখে, সেখানে তিনি গ্র্যান্ড স্লাম উঁচিয়ে ধরেছেন, বাঘা বাঘা তারকাকে পেছনে ফেলে।
এমন কথা শুনতে হয়েছিল ২০১৬ সালেও। সেবার বিরসবদনে ফ্রেঞ্চ ওপেন থেকে নেমে আসতে হয়েছিল নাদালকে। এবার চোট কবজিতে, র্যাকেট ধরার মতো অবস্থাই ছিল না তাঁর। ডাক্তার বললেন, এবার অন্তত রেহাই দাও হাতটাকে। আট মাস পর অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ফেদেরারের মুখোমুখি নাদাল, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মধ্যে ফ্রেঞ্চ আর ইউএস ওপেনের শিরোপা তাঁর হাতে।
যতবার তাঁর ইতি টানা হয়েছে, ততবার সেখান থেকে নতুন শুরুর গল্প লিখেছেন নাদাল। থামতে তিনি জানেন না, জানলে হয়তো রাফায়েল নাদাল নামটা লাইমলাইটে আসার আগেই মুছে যেত। যায়নি একটা কারণেই, নিজের দৃঢ়চেতা মনোভাব আর অটল প্রতিজ্ঞা।
এবারের অস্ট্রেলিয়ান ওপেন নিয়ে জল কম ঘোলা হয়নি। করোনার টিকা নেওয়া না থাকলে অস্ট্রেলিয়ায় ঢোকার অনুমতি পর্যন্ত মিলছিল না। আদালত পর্যন্ত গিয়েও খেলার অনুমতি পাননি নোভাক জোকোভিচ। নাদালও শঙ্কায় ছিলেন, টুর্নামেন্ট শুরুর কিছুদিন আগে হয়েছিলেন করোনা পজিটিভ। দ্রুত সুস্থ না হতে পারলে ইনজুরি থেকে ফিরে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই মাঠে নামতে হতো। অভিজ্ঞতার জোরে হয়তো এগোতেন অনেক দূর, তবু একটা ‘কিন্তু’ থেকেই যেত। মাঠে নামার আগে কোনো ‘তবু-কিন্তু’ চাইছিলেন না নাদাল। কিন্তু সেই ‘কিন্তু’ মাঠে নামার আগে নয়, এল মাঠের মাঝেই।
কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি ডেনিস শাপোভালোভ। প্রথম দুই সেট জিতে বেশ ভালো অবস্থানেই ছিলেন। কিন্তু তৃতীয় সেটের শুরুতেই হিটস্ট্রোকের শিকার হলেন নাদাল। এর মধ্যেই নিয়েছেন বাথরুম ব্রেক, মেডিকেল টাইম আউট। একসময় মাঠ থেকে উঠে যাওয়ার কথাও ভেবেছিলেন, সেই সুযোগে খেলাটা নিজের করে নিয়ে এসেছিলেন শাপোভালোভও। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি, অসুস্থ নাদালের অভিজ্ঞতার কাছেই পরাস্ত হতে হয়েছে তাঁকে।
সমস্যার সূচনা সেখান থেকেই। সেমিফাইনালের আগে পুরো দিন নাদালকে থাকতে হয়েছে বিশ্রামে। সেমিফাইনাল খেলতে পারাটাই একসময় বড় মনে হয়েছিল নাদালের কাছে। অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে এসে তিন সপ্তাহে চার কেজি ওজন হারিয়েছিলেন, কিন্তু মনোবল হারাননি। সেমিতে হেসেখেলেই হারিয়েছেন বেরেত্তিনিকে। কিন্তু ফাইনাল, ফাইনালটাই তাঁর জন্য বড় জুজু।
কথায় আছে ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’ নাদালের জন্য অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের শেষটাই যত খারাপ। মেলবোর্ন পার্কের রড লেভার অ্যারেনায় ছয়বার ফাইনাল খেলতে নেমেছেন। শিরোপা উদ্যাপন করতে পেরেছেন মাত্র একবার। সেটাও ১৩ বছর আগে। একবার শিরোপা খুইয়েছেন ইনজুরিতে, অন্য দুবার হেরেছেন ইতিহাসের পাতায় নাম লিখে। আর শেষবার তো নোভাক জোকোভিচের কাছে হেরেছেন সরাসরি সেটে। সেই ২০০৯ সালে শেষবার অস্ট্রেলিয়া থেকে হাসিমুখে ফেরত গিয়েছিলেন, এর পর থেকে অস্ট্রেলিয়া তাঁর কাছে এক গোলকধাঁধার নাম। এই ধাঁধার সমাধান যেন নেই তাঁর কাছে। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনাল তাঁর কাছে আস্তে এক ‘ল্যাবিরিন্থ’। ‘ল্যাবিরিন্থ’ হলো গ্রিক মিথোলজির সেই গোলকধাঁধা। যেখানে প্রবেশের পথ জানা আছে, বের হওয়ার পথ জানা নেই। নইলে কি আর পাঁচ-পাঁচবার হাতছোঁয়া দূরত্বে ডাবল ক্যারিয়ার স্লামটা রেখে ফেরত যেতে হয়?
এবারও অনেকে নাদালের শেষ দেখে ফেলেছিল। প্রথম সেটা পাত্তা পাননি, দ্বিতীয় সেটেও ভালো অবস্থানে থেকে লিড খুইয়েছেন, সেট হারিয়েছেন। ২ ঘণ্টা ৪ মিনিটের সব পরিশ্রম মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিলেন দানিল মেদভেদেভ। টিভিতে বড় বড় করে দেখাচ্ছিল, এখান থেকে রাফায়েল নাদালের জেতার সম্ভাবনা মাত্র ৪ শতাংশ। মেদভেদেভের জেতাটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ৩৫ বছর বয়সে এমন লড়াই করতে পেরেছেন নাদাল, এটাই তো অনেক বেশি। এখান থেকে আর যা–ই হোক, জেতা সম্ভব নয়।
নাদাল হয়তো সেটা দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিলেন, এত সহজে হাল ছাড়লে তাঁর নাম কি আর ‘এল ম্যাটাডোর’ হতো? হার না–মানা স্প্যানিশ ষাঁড়ের সঙ্গে যার তুলনা, তাঁকে নিয়ে কি আগে থেকে কিছু বলা চলে? চলে না। নাদাল ফিরলেন, একেবারে নিজের মতো করে। আগের দুই সেটে যেখানে ড্রপশট দেওয়ার সুযোগই পাচ্ছিলেন না, এখন সেখানে পুরো নাদালের ড্রপশট আর ফোরহ্যান্ড চোখেই দেখছিলেন না মেদভেদেভ। দেখে মনেই হবে না, একটু আগেই ম্যাচটা ছিল মেদভেদেভের হাতের মুঠোয়। অভিজ্ঞতার জোরে পুরো খেলা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন নাদাল। ০-২ থেকে মুহূর্তেই ম্যাচ হয়ে গেল ২-২। দানিল মেদভেদেভের হাতের মুঠোয় থাকা ম্যাচের চালকের আসনে তখন রাফায়েল নাদাল।
ততক্ষণে ম্যাচের সময় পেরিয়ে গিয়েছে ৫ ঘণ্টা, নাদালের জন্য অবশ্য এসব কোনো বিষয়ই নয়, অস্ট্রেলিয়াতে তো নয়ই। এর আগে এই মাঠেই তিনবার ৫ ঘণ্টার ওপরে ফাইনাল খেলেছেন তিনি, তাও জোকোভিচ-ফেদেরারদের বিপক্ষে, মেদভেদেভ আর নতুন কী? অন্যদিকে, বিরক্তি চেপে বসেছিল মেদভেদেভের চোখে-মুখে। দেখে মনে হচ্ছিল, ২৫ বছর বয়সী জোয়ান ছেলেটাই হয়তো নাদাল, আর মেদভেদেভের বয়স বেড়ে গিয়ে হয়েছে ৩৫! নিজেকে ভাঙতে দেননি নাদাল, কারণ তিনি জানেন শেষ দুবার ম্যাচ যখন ৫ ঘণ্টার কাঁটা ছুঁয়েছিল, তখন একটা মাত্র ভুল তাঁকে ছিটকে দিয়েছিল শিরোপা থেকে।
এবার সে ভুল করেননি, ম্যাচ যখন পেন্ডুলামের মতো এপাশ থেকে ওপাশে ঘুরছে, নাদাল তখন মাথা ঠান্ডা রেখে ব্রেকপয়েন্টটা নিজের করে নিলেন। ফাইনাল সেট, ম্যাচ পয়েন্ট, সার্ভ নাদাল। নাদালের ড্রপশটটা দৌড়ে এসেও ছুঁতে পারলেন না মেদভেদেভ। র্যাকেট ফেলে মুখে হাত দিয়ে অনন্তের দিকে চেয়ে রইলেন কতক্ষণ। যেন নিজেও বিশ্বাস করতে পারছেন না। ১৩ বছর পর, অস্ট্রেলিয়ার মুকুট এখন তাঁর মাথায়। ১৩ বছরের গোলকধাঁধা ভেঙেছেন, ৫ ঘণ্টা ২৪ মিনিটের লড়াই শেষে ডাবল ক্যারিয়ার স্লাম চ্যাম্পিয়ন, সর্বকালের সেরা প্রশ্নের উত্তরে এত দিনের সমতা ভেঙেছেন, ফেদেরার-জোকোভিচকে ছাড়িয়ে তিনি এখন ‘একুশ’-এ।
মায়োর্কার সেই ছোট ছেলেটা, ১৪ বছর বয়সে যে নিজের ইনজুরি লুকিয়ে ফাইনাল খেলতে নেমে পড়েছিল, শিরোপা জিততে চায় বলে, টেনিস কোর্টে প্রতিটি পয়েন্টের জন্য যুদ্ধ করা ছেলেটা আজ সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্লামজয়ী টেনিস খেলোয়াড়। আজ তিনি শিখরে। না ফেদেরার, না জোকোভিচ, কেউ তাঁর পাশে নেই। এই চূড়ায় তিনি একা। ‘২১’ সংখ্যাটা শুধুই তাঁর। অন্য কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকতে হবে না আর।
বারবার শেষ দেখে ফেলার পরও শীর্ষে ওঠার গল্পটাকে কি কোনো বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায়? তোমরাই বলো?