নিজের কিট ব্যাগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন খেলোয়াড়, জুতা জোড়া পরিবর্তন করবেন বলে বের করেছেন নতুন এক জোড়া। একটা টেনিস ম্যাচে এটা খুব সাধারণ দৃশ্য। কিন্তু মাঝেমধ্যে সাধারণ দৃশ্যগুলোই অসাধারণ হয়ে ওঠে পরিবেশ আর পরিস্থিতির কল্যাণে।
ইগা সিওনতেকের বের করা সাদা স্নিকার্সে স্বর্ণালি অক্ষরে খোদাই করে লেখা ‘1GA’ আর তার নিচে দুটো স্টার। নিজের অর্জন করা দুটো গ্র্যান্ড স্লামের জন্য। কয়েক মিনিট পরেই পোডিয়ামে উঠে এলেন, ১৮ বছর বয়সী কোকো গ্রাফকে সরাসরি সেটে হারিয়ে জিতে নেওয়া ফ্রেঞ্চ ওপেন তুলে ধরলেন সবার উদ্দেশে। কয়েক মাস ধরা চলা নিন্দুকের কথা, সমালোচনা সব যেন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন ৬৮ মিনিটের এক ফাইনালে। টেনিস রানির উপাধিটা এবার সত্যিই অর্জন করে নিয়েছেন ইগা সিওনতেক।
কয়েক বছর ধরেই থমথমে অবস্থা নারীদের টেনিসে। টেনিসের ‘আসল’ রানি সেরেনা উইলিয়ামসের শেষ সাফল্য বলতে ২০২১ অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের সেমিফাইনাল। ২৩ গ্র্যান্ড স্লামজয়ী তারকার কাছে সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়াটা ব্যর্থতাই বটে। সেরেনার রেখে যাওয়া জায়গাটা দখল করার মতো কেউ ছিল না। রাদুকানু, আন্দ্রেস্কুর মতো তারকারা ধূমকেতুর মতো আগমন ঘটে, আবার মিলিয়েও যায়।
এত সবের মধ্যে নারী টেনিসে নিজের জায়গা খুঁজে নিতে শুরু করেছিলেন দুজন। একজন অ্যাশলি বার্টি, অন্যজন নাওমি ওসাকা। মাঠের ভেতরে–বাইরে নানা কারণে ওসাকাকে সে রকম ফর্মে পাওয়া যায় না বললেই চলে। আর সে সুযোগে নিজের জায়গাটা পাকাপোক্ত করছিলেন বার্টি।
কিন্তু হঠাৎই সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের অবসরের কথা জানিয়ে এক বিশাল পোস্ট দিলেন নারী টেনিসের নাম্বার ওয়ান তারকা অ্যাশ বার্টি। দুই মাস আগে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জেতা অ্যাশ বার্টি আর ফিরবেন না টেনিস কোর্টে। র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থাকা অবস্থাতেই বিদায় বলতে চান টেনিসকে। মুহূর্তেই যেন থমথমে এক পরিবেশ সৃষ্টি হলো নারী টেনিসে।
বার্টির বিদায়ে আচমকাই নারী টেনিসের সেরা খেলোয়াড়ের বাটনটা হাতবদল হয়ে গেল ২০ বছর বয়সী ইগা সিওনতেকের ওপর। বছরখানেক আগে একটা গ্র্যান্ড স্লাম জিতেছিলেন। এর পর থেকে ফর্মে নেই। গত এক মাসে দুটো শিরোপা জিতে একটু আলোয় আসতে শুরু করেছেন—এমন সময়ই আচমকা যেন উড়ে এসে জুড়ে বসল টেনিস রানির খেতাব।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইগা নিজেও তখন জানেন, নারী টেনিসের সেরা খেলোয়াড় তিনি নন। তাঁর নামের পাশে একটিমাত্র গ্র্যান্ড স্লাম, সেটাও এসেছে করোনাকালীন এক রোলাঁ গ্যাঁরোতে। পুরো ক্যারিয়ারে শিরোপাসংখ্যা মাত্র ৪। টানা দুটো শিরোপা ক্যারিয়ারের পালে হাওয়া দিয়েছে বটে, কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। তার ওপর কাগজে-কলমে নারী টেনিসের রানি এখন তিনি। কট্টর ইগা ভক্তরাও হয়তো তা মানতে নারাজ। কারণ, নিজেকে এই জায়গার যোগ্য প্রমাণ করতে হলে আরও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে তাঁকে।
কিন্তু এখন এমন একজনকেও পাওয়া যাবে না যে ইগার জায়গা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। পরশপাথরের খোঁজ পেয়েছেন যেন তিনি। নারী টেনিসের নাম্বার ওয়ান হওয়ার আগে থেকেই আস্তে আস্তে ফর্মে ফিরছিলেন। আর যখন ‘নাম্বার ওয়ান’ র্যাঙ্কিংটা ধরা দিল, তখন থেকে যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে তাঁর ফর্ম।
গত পাঁচ মাসে এমন একজন খেলোয়াড় আসেননি, যিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পেরেছেন ইগার দিকে। টানা ৩৫ ম্যাচ ধরে অপ্রতিরোধ্য ইগা। ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ থেকে এখন পর্যন্ত কেউ তাঁকে হারানো দূরে থাক, টেক্কাও দিতে পারেননি। ২১ শতকে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে অপরাজিত থাকার রেকর্ড এখন তাঁর নামের পাশে। সামনে শুধু মনিকা সেলেস আর মার্টিনা হিঙ্গিস। নব্বইয়ের দশকে যথাক্রমে ৩৬ ও ৩৭ ম্যাচ অপরাজিত ছিলেন তাঁরা।
শিরোপাগুলোও যে–সে শিরোপা নয়। এর মধ্যে রয়েছে একটা গ্র্যান্ড স্লাম, চারটা মাস্টার্স! টেনিসের সবচেয়ে নামকরা শিরোপাগুলো নিজের ক্যাবিনেটে তুলেছেন ইগা। বাঘা বাঘা তারকাদের পেছনে ফেলে প্রতিটি শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছেন তিনি। সেই সঙ্গে নামের পাশে মোট সাড়ে আট হাজার ডব্লিউটিএ পয়েন্ট। র্যাঙ্কিংয়ের ২ আর ৩-এ থাকা দুজনের মোট পয়েন্ট মিলিয়েও টেক্কা দেওয়া সম্ভব নয় তাঁকে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই অপ্রতিরোধ্য ইগাকে থামাবে কে? যাঁকেই তাঁর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর ক্ষীণ চেষ্টাও করা হয়েছে, তাঁকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন ইগা। ফাইনাল হারতেই যেন ভুলে গিয়েছেন তিনি। শেষ ২০১৯ সালে প্রথম ও শেষবারের মতো ফাইনাল হেরেছিলেন, তা–ও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে। এর পর থেকে ৯ বার ফাইনালে উঠেছেন, ৯ বারই শিরোপা ছিনিয়ে এনেছেন। তা–ও কোনো সেট ড্রপ না করেই। ঠিক কতটা ভয়ানক ফর্মে আছেন, তারই প্রমাণ এটা।
অথচ আজ থেকে ১৮ মাস আগে সেভাবে তাঁর নামও জানত না কেউ। করোনা–পরবর্তী ফ্রেঞ্চ ওপেনে তাঁর আগমন ঘটেছিল অন্য সব তরুণ তারকাদের মতোই। জুনিয়র সার্কিটে সর্বজয়ী একজন পেশাদার পর্যায়ে নিজের পায়ের তলায় মাটি খুঁজছেন—এমন খেলোয়াড়ের অভাব নেই। কিন্তু ইগা তৈরি হয়েছেন একটু অন্যভাবে। জুনিয়র লেভেলে কোনো ফাইনাল হারেননি। তাঁকে নিয়ে আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক।
অচেনা অজানা ইগা সিওনতেক তাঁর ট্রাম্প কার্ডটা খেললেন করোনা–পরবর্তী রোলাঁ গ্যাঁরোতে। বিশ্বের ১ নম্বর খেলোয়াড় সিমোনা হালেপ আর ৪ নম্বর খেলোয়াড় সোফিয়া কেনিনকে হারিয়ে জিতে নিলেন ফ্রেঞ্চ ওপেনের শিরোপা। সেটাও আবার কোনো সেট ড্রপ না করেই। পেশাদার টেনিসে তাঁর শিরোপাযাত্রা শুরুই হলো গ্র্যান্ড স্লাম দিয়ে। মনিকা সেলেসের পর এই প্রথম এত কম বয়সে কোনো নারী টেনিস তারকা উঁচিয়ে ধরলেন গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপা।
ইউরোপের প্রাণকেন্দ্রে থাকলেও টেনিস জগতে কখনোই নাম করতে পারেনি পোলিশরা। সেই পোল্যান্ডকে প্রথমবারের মতো গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপা উপহার দিয়েছেন ইগা সিওনতেক। তাঁকে শিরোপা উঁচিয়ে দেখতে অর্ধেক ইউরোপ পার করে ছুটে আসেন স্বয়ং রবার্ট লেফান্ডভস্কি। বাবা টমাস সিওনতেক ছিলেন পোল্যান্ড রোয়িং দলের সদস্য, অংশ নিয়েছেন অলিম্পিকেও। বাবার দেখাদেখি ছোটবেলায় জলের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল ইগার। সাঁতারে আগ্রহ দেখালেও আস্তে আস্তে তা বদলে আগ্রহ জন্মায় টেনিসে।
২০১৬-২০১৮, তিন বছর একই সঙ্গে জুনিয়র আর আইটিএফ সার্কিটে তাণ্ডব চালিয়েছেন ইগা। টানা সাত ফাইনাল জিতেছেন, যার মধ্যে একটি ছিল জুনিয়র উইম্বলডন ট্রফি। সেখানেও সেট ড্রপ করেছেন মাত্র একবার। পারফরম্যান্স এতটাই বিস্ফোরক ছিল যে নারীদের প্রফেশনাল (ডব্লিউটিএ) টুর্নামেন্টে অভিষেক হওয়ার আগেই র্যাঙ্কিংয়ের ১৭০ নম্বরে উঠে এসেছিলেন তিনি!
ধূমকেতুর মতো আগমন আবার ঠিক সেভাবেই পতন—টেনিসে এমনটা নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে নারী টেনিসে। সেরেনা উইলিয়ামসের পর নারী টেনিসে চলছে তরুণ তারকাদের যাওয়া–আসার খেলা। ২০২০ সালের শেষ গ্র্যান্ড স্লাম জেতার পর ২০২১ সালের ফর্ম দেখে অনেকে সেটাই ভেবে নিয়েছিলেন। ভাববেন না-ই বা কেন? গত বছরের গ্র্যান্ড স্লামজয়ী খেলোয়াড় পুরো বছরে শিরোপা জিতেছেন মাত্র ১টি।
নিজেকে হারিয়ে যখন খুঁজছিলেন, তখনই তাঁর জীবনে আশার আলোর মতো আগমন ঘটে তাঁর আইডল রাফায়েল নাদালের। ২০২১ সালের ফ্রেঞ্চ ওপেন এক অবিস্মরণীয় ঘটনার মুখোমুখি হয়। তৃতীয়বারের মতো ফ্রেঞ্চ ওপেনে হারের স্বাদ পান রাফায়েল নাদাল। তা–ও আবার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী নোভাক জোকোভিচের বিপক্ষে। অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করেন জোকোভিচ।
ইগা ধরেই রেখেছিলেন, এমন ম্যাচের পর এক বিধ্বস্ত নাদালকে দেখবেন তিনি। কিন্তু পরদিনও এক প্রাণোচ্ছল নাদালের দেখা পান ইগা। আর সেখানেই জীবনের সবচেয়ে বড় উপদেশ পান ইগা। ‘যত যা–ই হোক, দিন শেষে এটা একটা খেলাই। এখানে কখনো জিতবে, কখনো হারবে। দিন শেষে খেলাটাকে উপভোগ করতে শেখো।’
নাদালের একটা কথা খোলনলচে বদলে দেয় ইগাকে। একটা শিরোপা জেতার পর থেকে যেখানে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলেন, সেখানে নাদালের কথাতে যেন হুঁশ ফিরে পেলেন। জেতার নেশায় নিজের স্বাভাবিক খেলাটাই যেন ভুলে গিয়েছেন। চোটের কারণে ২০২১ সালে বলার মতো কিছুই করতে পারেননি।
কিন্তু ২০২২-এ এসে ঠিকই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। নিজের খেলায় খুঁজে পেয়েছেন এক অন্য রকম আনন্দ। নইলে কি এমন জয়রথ চালানো সম্ভব? যেখানে কয়েক মাস আগেই নিজের নামের পাশে ‘টেনিসের রানি’ উপাধি দেখে লজ্জা পাচ্ছিলেন; আজ সেটাই তাঁকে আলিঙ্গন করেছে। আর তা মেনে নিতে আপত্তি নেই কারোর।