ইউরো ২০২০ শেষ হয়েছে বেশ কয়েক দিন হয়ে গেল। ৫১ ম্যাচ, ১৪২ গোল শেষে টাইব্রেকারেই রচিত হয়েছে টুর্নামেন্টের ফল—ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জিতেছে ইতালি। ইউরো বা বিশ্বকাপের মতো বড় টুর্নামেন্টেই পারফরম্যান্স দিয়ে চমকে দেন তরুণ খেলোয়াড়েরা। এসব টুর্নামেন্টের দারুণ নৈপুণ্যই গড়ে তাঁদের পুরো ক্যারিয়ারে ভিত্তি। মাইকেল ওয়েন, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, ওয়েইন রুনি থেকে শুরু করে হালের মেসুত ওজিল, হামেস রদ্রিগেজের উত্থান নিশ্চয়ই মনে আছে তোমাদের। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্সই তাদের জায়গা করে দিয়েছে বড় দলে। এবারের ইউরোতেও তার ব্যতিক্রম নয়। ইউরোর আগে ‘অপরিচিত’ হয়ে থাকা খেলোয়াড়েরাই এখন রাতারাতি হয়ে গিয়েছেন তারকা। এমন কয়েকজননের গল্প বলছি আজ।
ম্যানুয়েল লোকাতেল্লি (ইতালি)
ইউরোজয়ী ইতালি দলের সেরা পারফর্মার কে? পুরো টুর্নামেন্ট আবার মনোযোগ দিয়ে দেখলেও এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া সহজ নয়। টুর্নামেন্ট সেরা হয়েছেন জিয়ানলুইজি ডোনারোম্মা, যিনি ছিলেন গোলবারের নিচে। কিন্তু মাঝমাঠে শুরু থেকেই আলো কেড়ে নিয়েছিলেন ২৩ বছর বয়সী ম্যানুয়েল লোকাতেল্লি।
ইতালিকে নতুন করে সাজিয়েছেন কোচ রবার্তো মানচিনি। একক কোনো তারকার ওপর ভিত্তি করে খেলে না দলটি, সবাইকে নিয়েই সাজানো ছিল তাদের খেলা। দলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই সাজিয়েছিলেন অভিজ্ঞতা আর প্রতিভার সমন্বয়ে। আর সেই মিডফিল্ডে হাল ধরেছিলেন লোকাতেল্লি। বল পায়ে দক্ষতা দেখলে কেউ বলবে না তাঁর বয়সটা মাত্র ২৩। কিয়েলিনি-বনুচ্চির কাছ থেকে বল নিয়ে আক্রমণের জোগান দিতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত বোধ ছিল না তাঁর মাঝে। গ্রুপ পর্বের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দুই গোল করে দলকে এনে দিয়েছেন জয়। আর তাতেই বিশ্ববাসীর নজরে পড়ে গিয়েছেন লোকাতেল্লি। ইউরোর আগে খেলতেন সাসসুওলোতে। আর ইউরো শেষ হতে না হতেই তাঁকে নিয়ে টানাটানি পড়ে গিয়েছে জুভেন্টাস, আর্সেনালের মতো বড় দলের। কিছুদিনের মধ্যেই কোনো একটা বড় দলের জার্সিতে দেখা যাবে এই মিডফিল্ডারকে।
মিকেল ড্যামসগার্ড (ডেনমার্ক)
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ডেনমার্কের এই দলে হয়তো সব ম্যাচে সুযোগই পেতেন না ড্যামসগার্ড। কিন্তু ডেনমার্কের জন্য ইউরোটাই তো শুরু হয়েছিল বাজেভাবে। প্রথম ম্যাচেই মাঠের মাঝখানে হার্ট অ্যাটাক হয় ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনের। বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে পুরো দল। মাঠের মধ্যেই লুটিয়ে পড়া সেই ঘটনা টিভি পর্দায় লাইভ দেখে বিশ্ববাসী।
প্রথম ম্যাচেই দলের সেরা তারকাকে হারিয়ে ফেলে ডেনমার্ক। আর তাঁর না খেলাই শাপেবর হয়ে আসে মিকেল ড্যামসগার্ডের জন্য। মাত্র ২১ বছর বয়সী তারকাকেই পাঠানো হয় এরিকসেনের জায়গা পূরণ করতে। প্রথম ম্যাচ শেষ করেছেন বেঞ্চে বসে থেকেই, কিন্তু এরপর থেকে প্রতিটি ম্যাচেই ছিলেন ডেনমার্কের প্রথম একাদশে। রাশিয়ার বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ, পরের পর্বে যাওয়ার জন্য যেখানে প্রয়োজন একটা বড় জয়, সেখানেই ঝলসে উঠলেন ড্যামসগার্ড। ডেনমার্ককে প্রথমেই এগিয়ে নেন তিনি। বাকি কাজটা করেছেন সতীর্থরাই। রাশিয়াকে ৪-১ গোলে হারিয়ে পরের পর্ব নিশ্চিত করে ডেনমার্ক।
টুর্নামেন্টে ডার্কহর্স হয়ে আসা ডেনমার্কের যাত্রা তখন মাত্র শুরু। নকআউট ম্যাচেও ওয়েলসের বিপক্ষে প্রথম গোলের কারিগর ছিলেন ড্যামসগার্ড। কোয়ার্টারে একটু নিষ্প্রভ থাকলেও আবার ঝলসে ওঠেন সেমিতে। পুরো টুর্নামেন্ট গোলবার অক্ষত রাখা জর্ডান পিকফোর্ড আর ইংল্যান্ডকে দিয়েছেন গোলের তিক্ত স্বাদ। শুধু তা–ই নয়, গোলটাও করেছেন ফ্রি-কিকে। যেটা হয়ে রয়েছে এই ইউরোর একমাত্র ফ্রি-কিক থেকে গোল।
কিন্তু সেদিন আর জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারেননি তিনি। কিন্তু এর আগেই হেভিওয়েটদের নজরে পড়ে গিয়েছেন তিনি। ইতালির সাম্পোদিয়াতে খেলা ড্যামসগার্ডকে এর মধ্যেই চোখে চোখে রাখছে লিভারপুল, টটেনহাম, এসি মিলানের মতো দল।
জেরেমি ডোকু (বেলজিয়াম)
গত কয়েকটা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেই ফেবারিট ধরা হয়েছিল বেলজিয়ামকে। কিন্তু প্রতিবারই নিজেদের সেরা দল নিয়ে এসেও খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে তাদের। এবারের ইউরোতে হেভিওয়েট দল নিয়ে কিছু করে দেখানোর একটা সুযোগ ছিল, কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। তবে কোয়ার্টারে কাটা পড়ার আগে নজর কেড়েছেন বেলজিয়ামের ১৯ বছর বয়সী জেরেমি ডোকু।
এই মিডফিল্ডারকে নিয়ে বেলজিয়ানদের আগ্রহের শেষ নেই।বেলজিয়ান লিগে থাকতেই নিজেকে প্রমাণ করেছেন,যার ফলে পাড়ি জমিয়েছেন ফ্রেঞ্চ লিগের ক্লাব রেনে। কিন্তু নিজেকে প্রমাণ করার জন্য আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের চেয়ে বড় আর কীই–বা হতে পারে? সে সুযোগটা করে দিয়েছিল এই ইউরো। আর তাতেই বাজিমাত। কোচ রবার্তো মার্তিনেজ তাঁকে সুযোগ করে দিয়েছিলেন গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচটায়, সেখানে নিজের স্পিড আর পজিশনিং দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল সবাই।
বেলজিয়ামের গোল্ডেন জেনারেশনের পরই তাদের ফুটবল শেষ হয়ে যাচ্ছে—এমনটা ধারণা যে ঠিক নয়, তা-ই যেন বুঝিয়ে দিলেন ডোকু। মাঠে নেমেই অ্যাসিস্ট। আস্থার জায়গাটা অর্জন করতে পেরেছিলেন তিনি। যে কারণে কোচ রবার্তো মার্তিনেজ ভরসা করেছিলেন কোয়ার্টার ফাইনালেও, চোটাক্রান্ত ইডেন হ্যাজার্ডের জায়গায় নামিয়েছিলেন ডোকুকে। বড় ম্যাচে নিজেকে মানিয়ে নিতে সময় নিয়েছেন ডোকু, কিন্তু ভুল করে বসেননি। নিজের কাজটা ঠিকমতই করেছিলেন, কিন্তু ইতালির অভিজ্ঞ ডিফেন্স ভাঙা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। মাত্র দুই ম্যাচে এক অ্যাসিস্ট করেই নজর কেড়েছেন বড় ক্লাবগুলোর।
ডনিয়েল মালেন (নেদারল্যান্ডস)
নেদারল্যান্ডের এই খেলোয়াড়কে নিয়ে খুব একটা মাতামাতি হয়নি ইউরোতে। কিন্তু যতটুকু খেলেছেন, তাতেই নজর কেড়ে নিয়েছেন মালেন। তিনি মূলত ফরোয়ার্ড। যদিও নেদারল্যান্ড তাদের খেলা পুরোটাই সাজিয়েছিল মেমফিস ডিপাবয়কে কেন্দ্র করে। যে কারণে তাঁর দিকে নজর দেওয়ার সময় হয়নি কারও। মালেনও তাঁর কাজটা পালন করেছেন ভালোমতোই।
দলে তাঁর কাজ ছিল ডিপাইয়ের জন্য বল বানিয়ে দেওয়া। সে কাজটাই করেছেন তিনি। খেলেছেন ৪ ম্যাচেই। দুটোতে বেঞ্চ থেকে,দুটোতে প্রথম একাদশে। মোট ২ গোলে সরাসরি সহায়তা করেছেন। নেদারল্যান্ডস হয়তো বেশি দূর যেতে পারেনি, কিন্তু মালেন যে অনেক দূর যাবেন তা বুঝতে পেরেছে অনেক বড় দলই। এই ইউরোই হয়ে উঠেছে তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। 'প্রতিভাবান নয়' বলে একসময় আর্সেনাল একাডেমি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। সেখান থেকে এখন ইউরোপের বড় বড় দলের শর্ট লিস্টে তিনি। নিজের ক্যারিয়ারকে ঠিকমতোই ঘোরাতে পেরেছেন মালেন।