স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা একজন মানুষকে কত দিন কুরে কুরে খেতে পারে? ৫ বছর? ১০ বছর? ১৫ বছর? সেনেগালের আলিউ সিসেকে একটা পেনাল্টি মিসের যন্ত্রণা কুরে কুরে খেয়েছে ২০ বছর।
২০০২ সালের কথা। আলিউ সিসে সবে পা দিয়েছেন পঁচিশে। ক্লাবপর্যায়ে খেলছেন ফ্রান্সের বড় দলে, অধিনায়কত্বের দায়িত্বটাও তাঁর কাঁধে। তরুণ সেনেগাল দল নিয়ে স্বপ্নপূরণের আশায় বিভোর দেশবাসী। এর আগে তাঁদের দৌড় ছিল শেষ চার পর্যন্তই। সেটাও এক যুগ আগে। সেনেগালের স্বর্ণালি যুগের সেরা দল সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ কজনের কপালেই–বা জোটে?
কিন্তু নেতৃত্ব দিতে এসে পাশার দান এভাবে উল্টে যাবে, সেটা হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি সিসে। আফ্রিকান কাপ অব নেশনসের ফাইনাল। ক্যামেরুনের সঙ্গে নির্ধারিত সময় শেষ হয়েছে ০-০ গোলে। টাইব্রেকার, শেষ শট। বল জালে জড়ালেই বেঁচে থাকবে শিরোপা বাড়ি নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। সিসে শটটা সরাসরি তুলে দিলেন গোলরক্ষকের হাতে। উল্লাসে ফেটে পড়ল ক্যামেরুন। আফ্রিকান কাপ অব নেশনসের এতটা সামনে এসেও শিরোপা ছুঁয়ে দেখা হলো না সেনেগালের।
একই দল নিয়ে কয়েক মাস পরই গিয়েছিলেন বিশ্বকাপে, ফ্রান্সকে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসের সেরা বিশ্বকাপ মিশন ছিল সেটা। অতিরিক্ত সময়ে গিয়ে তুরস্কের কাছে হারার আগে সেনেগাল পৌঁছেছিল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে। সেনেগালের মানুষের জন্য সেটাই ছিল বড় আনন্দের ব্যাপার। আফ্রিকার এই দেশটিকে নিয়ে সেখানকার মানুষের আনন্দ করার মতো রসদ খুবই কম। এর মাঝে ফুটবল হয়ে আসে একপশলা বৃষ্টির মতো। কিন্তু আলিউ সিসের জন্য ২০০২ সালটার অর্থই যন্ত্রণা। তিনি জানেন সেনেগালের স্বর্ণালি যুগকে শিরোপা এনে দেওয়া একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল, তিনি সে সুযোগ হারিয়েছেন হেলায়। সবকিছু পেছনে ফেলে যখন নতুন শুরুর কথা ভাবছিলেন, তখন সেই বছরেরই সেপ্টেম্বরে ফেরি দুর্ঘটনায় হারান নিজের পরিবারের অর্ধেক সদস্য।
সিসে জাতীয় দলকে বিদায় বলেছেন ২০০৫ সালে। এরপর থেকে সেনেগাল জাতীয় দলের গ্রাফটা নিচের দিকেই নেমেছে। ১০ বছর পর যখন কোচ হিসেবে আবারও ফিরে এলেন জাতীয় দলে, ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে অবস্থানে তখন সেনেগাল দল। টানা তিন বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ নেই, আফ্রিকান কাপ অব নেশনসেও গ্রুপপর্বের বাধা পার করতে পারেনি। ভঙ্গুর সেনেগালকে আবারও সঠিক পথে ফেরানোর দায়িত্ব নিলেন সিসে। বাকি গল্পটা উত্থানের।
দায়িত্ব নিয়েই খোলনলচে বদলে ফেললেন দলের, ১৬ বছর পর টিকিট কাটলেন বিশ্বকাপের। ‘ফেয়ার প্লে’ নিয়মের বেড়াজালে পয়েন্ট-গোল ব্যবধান সমান থাকার পরও বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয় সেনেগালকে। তাতে দমলেন না, বরং লক্ষ্য দাঁড় করালেন আফ্রিকান কাপ অব নেশনস। যে স্বপ্ন অধিনায়কের আর্মব্যান্ড হাতে পূরণ করতে পারেননি, সেটা ডাগআউটে দাঁড়িয়েই করবেন—দৃঢ়সংকল্প তাঁর।
কিন্তু পুরোনো ক্ষত এত সহজে কি মুছে যায়? গত ১৭ বছর যে গ্লানি তাড়া করে ফিরেছে তাঁকে, সেই গ্লানি যেন নতুন করে ধরা দিল আবার। পুরোনো সে ক্ষতে নতুন ঘা হয়ে আসে আলজেরিয়া। ডাগআউটে দাঁড়িয়ে আবারও নায়ক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর সিসের আফ্রিকা জয় করা হয়নি। দুই মিনিটের মাথায় আলজেরিয়ার করা গোল পরিশোধ করতে পুরোটা ম্যাচ কড়া নেড়ে গেছেন। সে ডিফেন্স দুর্গ ভেঙে গোল আসেনি। হতাশ সিসে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছেন, আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছেন। দুবার যে শিরোপা হাতের সামনে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে প্রতিপক্ষ, এবার সে শিরোপা জিততে একচুলও ছাড় দেবেন না।
বাবরি চুলের আলিউ সিসে এবারের আফকন খেলতে এসেছিলেন একটা লক্ষ্যেই। যেকোনো মূল্যেই হোক, শিরোপা তাঁর চাই। ২০ বছর ধরে এক দুঃস্বপ্ন তাড়া করে ফিরছে তাঁকে, এ স্বপ্নের সমাধান তার চাই-ই চাই। সামনে সাদিও মানে, ডিফেন্সে কালিদু কোলাবালি, গোলবারের নিচে এদুয়ার্দো মেন্দি। তারকার মেলাকে একসুতায় বেঁধে রাখতে ছিলেন একজন আলিউ সিসে। এর আগেও একটা স্বর্ণালি দল এভাবেই মিইয়ে গিয়েছিল তাঁর চোখের সামনেই, এবার আর সেটা হতে দিতে রাজি নন সিসে।
অপরাজিত থেকে দ্বিতীয় পর্ব, সেখান থেকে মাত্র ২ গোল হজম করে ফাইনালে। সিসের ফাঁড়া তো সেই ফাইনালেই। তার ওপরে প্রতিপক্ষে মোহাম্মদ সালাহর মিসর, স্বপ্নভঙ্গ না নতুন রূপে হানা দেয় সেনেগালকে!
ফাইনাল ভালোমতো মাঠে গড়াতে না গড়াতেই দুঃস্বপ্ন নতুন করে হানা দিল সিসের সামনে। সাত মিনিটের মাথায় পেনাল্টি আদায় করে নেন মানে, শুরুতেই এগিয়ে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ হাতে পায় সেনেগাল। কিন্তু সেটাই জালে জড়াতে ব্যর্থ হলেন মানে। পুরোনো সে স্মৃতি যেন আবারও ফিরে এল কোচের মনে। সেবারও একটা পেনাল্টি মিসই ছিটকে দিয়েছিল তাদের। এবার সে ভুল করতে দিলেন না নিজের খেলোয়াড়কে।
০-০ গোলে নির্ধারিত সময় শেষ হওয়া ম্যাচ ভিড়ল টাইব্রেকারে। তবে এবার পুরোনো স্মৃতি রোমন্থনের সুযোগ দিলেন না শিষ্যরা। মিসরের চতুর্থ পেনাল্টি থামিয়ে হিরো বনে গেলেন এদুয়ার্দো মেন্দি। এবার সুযোগ সাদিও মানের। শেষ পেনাল্টি, এই বল জালে জড়াতে পারলেই প্রথমবারের মতো দেশকে আনন্দে ভাসাতে পারবেন তিনি। গুরুর ভুল শিষ্য করলেন না, মাথা ঠান্ডা রেখে বল জড়ালেন জালে। এরপর মেতে উঠলেন উৎসবে। সেনেগালজুড়ে তখন উৎসবের আনন্দ। কোচ আলিউ সিসে তখন চিৎকার করে লুটিয়ে পড়েছেন মাটিতে।
২০ বছর ধরে এই দিনটার অপেক্ষা করেছেন তিনি, শুধু নিজের দেশের নামের পাশে চ্যাম্পিয়ন শব্দটা দেখার জন্য। আশা হারাননি তিনি, আশা হারায়নি তাঁর দেশের মানুষও। বিশ্বাস রেখেছিলেন সিসের প্রতি, তাই তো ২০ বছর পরে এসেও স্বপ্নজয়ের আনন্দ বিন্দুমাত্র ফিকে হয়নি। সেনেগালের রাস্তায় টিম বাসের ওপর দাঁড়িয়ে উদ্যাপন করেছেন, সেনেগালের প্রতিটি মানুষের মন জিতে নিয়েছেন ডাগআউটে দাঁড়িয়ে। এই ক্যামেরুনের বিপক্ষেই পেনাল্টি মিস করে নিজের জীবনের দুঃস্বপ্ন শুরু হয়েছিল তাঁর। সেই ক্যামেরুনের মাটিতে দাঁড়িয়েই ঘুরে দাঁড়ানোর অন্য রকম এক গল্প লিখলেন আলিউ সিসে।