আকরাম খান: চওড়া ব্যাটের, বিশাল মনের মানুষ

আকরাম খান নামটিই তো একটা ইতিহাস। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সেই সংগ্রামের দিনগুলোর কান্ডারি তিনি। মালয়েশিয়ার সুগোইবুলোর রাবার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মাঠে তাঁর ৬৭ রানের একটা ইনিংসই বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাস। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফির দ্বিতীয় পর্বে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচটিই আকরাম খানকে নিয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়। হ্যাঁ, তিনি তখন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। অধিনায়কেরা তো কত ইনিংসই খেলেন। এই যে ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি প্রতি ম্যাচেই সেঞ্চুরি করে তাঁর দেশকে জেতান, আকরামের সেই ৬৭ রানের ইনিংসটিতে এমন আহামরি আর কী থাকতে পারে, যেটি তাঁকে নিয়ে যেতে পারে ইতিহাসে? এই প্রজন্মের কাছে সে এক অপার বিস্ময়। কিন্তু আজ থেকে ২১ বছর আগে মালয়েশিয়ার সেই মাঠটিতে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন কিংবা অনেক দূরে বাংলাদেশে বসে রেডিও সেটের সামনে বসে দুরু দুরু বুকে যাঁরা সেই ম্যাচের চলতি ধারাবিবরণী শুনছিলেন, তাঁদের কাছে সেই ৬৭ রানের ইনিংসটির মহিমা যে কী, সেটি বোঝানো অসম্ভব! আরে, নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সেই ৬৭ রানের ইনিংসটি না হলে তো সেবারের আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশের সেমিফাইনালে খেলা হয় না, সেমিতে খেলা না হলে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ সম্ভাবনা ধুলায় লুটিয়ে পড়ে। অথচ শেষ পর্যন্ত সবই হয়েছে, সে ম্যাচে নেদারল্যান্ডসকে এক কঠিন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ হারিয়ে নাম লিখিয়েছে সেমিফাইনালে। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ-স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, পূরণ হয়েছে আইসিসি ট্রফি জয় করার আরাধ্য স্বপ্ন। সেই একটি ইনিংসের মালিকানা যাঁর, সেই আকরামকে তো ইতিহাস মনে করবেই।

বাংলাদেশের ক্রিকেট তখন টেস্ট ম্যাচের গণ্ডিতে পৌঁছায়নি। ছোট ছোট স্বপ্নকে একসঙ্গে জোড়া দিয়ে বড়, বিশাল এক স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে তখন বিভোর দেশের মানুষ, দেশের ক্রীড়াপ্রেমীরা। পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান কিংবা শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট ম্যাচগুলো টেলিভিশনে দেখতে দেখতেই ক্রিকেটপ্রেমীমাত্রই একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিরে বেরিয়ে আসত—ইশ্‌, আমরা যদি টেস্ট খেলতে পারতাম, আমাদের কোনো ক্রিকেটার যদি একটা সেঞ্চুরি করতেন! কেউ যদি ৫ উইকেট পেতেন। বাংলাদেশ যদি কোনো দিন একটা টেস্ট বা ওয়ানডে জয়ের সুযোগ পেত! আকরাম খানরা ছিলেন সেই সময় এসব ‘অলীক’ স্বপ্নের কারিগর। আজ ইএসপিএন, ক্রিকইনফোর পরিসংখ্যান পাতায় আকরামের নামের পাশে হয়তো একটা দুর্বল পরিসংখ্যানের দেখা মিলবে। কিন্তু সেসব পরিসংখ্যানের কোথাও দেখা মিলবে না, এ দেশের ক্রিকেটের জন্য আকরাম খানদের কী ত্যাগ, আকরামরা কীভাবে হাঁটি হাঁটি পা পা করতে থাকা ক্রিকেটকে নিজেদের রক্ত দিয়ে, ঘাম দিয়ে দাঁড় করিয়েছেন আজকের অবস্থানে। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ার সুগোইবুলোর রাবার রিসার্চ ইনস্টিটিউটে নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে সে ম্যাচটির প্রসঙ্গ বারবারই চলে আসবে। আকরাম তাঁর ৪৪ ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৫টি হাফ সেঞ্চুরি করেছেন, কিন্তু তিনি নিজেই বলবেন, মালয়েশিয়ার মাটিতে তাঁর সেই ৬৭ রানের ইনিংসটি ছাপিয়ে গেছে সত্যিকারের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর সব বড় সংগ্রহকে। অতীতে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির একটি নির্দিষ্ট ইনিংস, কোনো দেশের ক্রিকেটের গতিপথ ঠিক করে দিয়েছে কি না, সেটি নিয়ে কিন্তু বিস্তর আলোচনার অবকাশটা থেকেই যায়। দুই ভাতিজা নাফিস ইকবাল আর তামিম ইকবালকে নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের গল্পগুলো আকরাম কীভাবে বলেন, সেটি জানা নেই। কিন্তু এটা নিশ্চয়ই বলেছেন, তোমাদের মতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে আমরা ক্রিকেট খেলিনি। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করা বেশির ভাগ ক্লাবেরই ফুটবল দল আছে। আশি আর নব্বইয়ের দশকে ফুটবলের রমরমা অবস্থায় ক্রিকেটের অবস্থা যে কী ছিল, সেই গল্পটা নিশ্চয়ই পরবর্তী প্রজন্মের দুই ক্রিকেট তারকা নাফিস আর তামিমের কাছে করেছেন আকরাম। মাঠে যতক্ষণ ফুটবল দল অনুশীলন করত, ক্রিকেটাররা প্যাড-ট্যাড পরে ব্যাট হাতে মাঠের এক কোনায় চুপটি করে বসে থাকতেন। ফুটবলের আগে কখনো ক্রিকেট দলের অনুশীলন হয় নাকি!

ক্রিকেট তো খালি মৌসুমের খেলা। ফুটবল যে ঘরের লক্ষ্মী। আকরামদের কৃতিত্ব যে, তাঁরা নিজেদের খেলোয়াড়ি জীবনে ক্রিকেটকে যে জায়গায় দেখেছেন, সেই জায়গা থেকে ক্রিকেটকে বলতে গেলে হ্যাঁচকা টানে নিয়ে গেছেন অন্য জায়গায়। এমন মানুষেরাই তো ইতিহাসের নায়ক হন। নাদুসনুদুস চেহারা, মিষ্টি, সরল হাসি। আকরামকে দেখলে কখনোই মনে হবে না ব্যাট হাতে কী পরিমাণ দুর্ধর্ষ হয়ে উঠতে পারতেন তিনি। শার্টের একটা বোতাম খুলে গলার চেইনটাকে বাইরে বের করে আকরাম রীতিমতো খুন করতেন বোলারদের। ২০০০ সালের এশিয়া কাপে ঢাকায় ভারতীয় বোলাররা আকরামের ব্যাটের আগুন দেখেছিলেন। অজিত আগারকার, অনিল কুম্বলেদের মতো বোলারদের মাঠের চারদিকে আছড়ে ফেলছিলেন বারবার। এর ঠিক এক বছর আগে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপে সাউদাম্পটনে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক ম্যাচে শোয়েব আখতার, ওয়াকার ইউনিস, ওয়াসিম আকরাম ও সাকলায়েন মুশতাকরা আকরাম খানকে চিনেছিলেন। সেদিন ব্যক্তিগত সংগ্রহটা পঞ্চাশ না পেরোলেও ব্যাটের অগ্নিচ্ছটায় তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন নিজের জাতটা। বাংলাদেশের ক্রিকেটের গতিপথ বদলে দেওয়া এই তারকা এ দেশের ক্রিকেটের জন্য বড় এক আফসোসই হয়ে আছেন। ২০০০ সালে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর দল নির্বাচনের ভ্রান্ত নীতির কারণে মাত্র ৮ টেস্ট খেলেই শেষ হয়েছে তাঁর ক্যারিয়ার। ওয়ানডেও খেলেছেন মাত্র ৪৪টি। আকরামের মতো ক্রিকেটারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারটা দীর্ঘায়িত না হওয়ার দায়ভারটা কিন্তু নিতে হবে আমাদেরই। টেস্ট না খেলা যুগে সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা যে কয়জন ক্রিকেটার বাংলাদেশের ক্রিকেটকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার অনুষঙ্গ, আকরাম তাঁদের অন্যতম। আরও নির্দিষ্ট করে বললে তিনি অন্যতম মুখ্য চরিত্রও। আকরাম এখন আরও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ক্রিকেটের সঙ্গে। অন্য ভূমিকায়। ক্রিকেট বোর্ডের অপারেশনসের প্রধান হিসেবে আকরাম দেশের ক্রিকেটের মানোন্নয়নে, নতুন প্রতিভা খুঁজে বের করার কাজে ভূমিকা রাখছেন। জাতীয় ক্রিকেট দলের নির্বাচক হিসেবেও তিনি ক্রিকেটের সেবা করছেন।