কথায় আছে, লাল বলের খেলা দুই ধরনের। একটা তো টেস্ট; অন্যটা অ্যাশেজ। প্রশ্ন করতে পারো দুটোই লাল বলের খেলা, পাঁচ দিনে মীমাংসা না হলে ফলাফল ড্র; তবে পার্থক্যটা কিসে? পার্থক্যটা আভিজাত্যে, ঐতিহ্যে আর আত্মসম্মানে। যে কারণে ১৪৫ বছর ধরে প্রতি দুই বছর পরপর ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া মুখ দেখে পরস্পরের। পাঁচ দিন করে সাকল্যে মুখোমুখি হয় ২৫ দিন। এতেই নির্ধারিত হয় সব, কোনো এক দলের আভিজাত্য ছাই হয়ে মিশে যায় মাটিতে, আর অন্য এক দল তা নিয়ে করে উল্লাস। অ্যাশেজ সেই আত্মসম্মানের লড়াই।
‘অ্যাশেজ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ছাই। বাংলা আভিধানিক অর্থের সঙ্গে অ্যাশেজ ক্রিকেট সিরিজের অর্থে কোনো পার্থক্য নেই। তবে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা ছাইয়ের থেকে অ্যাশেজের পার্থক্য হাজার গুণ। অ্যাশেজ মানে আত্মসম্মানের লড়াই। অ্যাশেজ–জয়ী দল শুধু ম্যাচই জেতে না, জেতে প্রতিপক্ষকে পুড়িয়ে ধ্বংস করা ছাই। ১৬ সেন্টিমিটারের এই ট্রফির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৩৫ বছর আগের এক ইতিহাস। আজকের অ্যাশেজের মাতামাতি পুরোটাই রেজিনাল্ড ব্রুকসের অবদান। বাইশ গজের তারকা ছিলেন না তিনি। তাঁর কাজ ছিল বাইশ গজের তারকাদের ক্ষতবিক্ষত করা। বল–ব্যাটের চেয়ে কাগজ–কলমেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য তাঁর।সময়টা ১৮৮২, বিলি মারডকের অধীনে ইংল্যান্ডে খেলতে এসেছে অস্ট্রেলিয়া। প্রায় ১০ হাজার মাইল পেরিয়ে অজিদের ইংল্যান্ড ভ্রমণ সুখের ছিল না কখনোই। নিজেদের মাটিতে মেলবোর্ন টেস্ট জিতেছিল ঠিকই, কিন্তু ইংল্যান্ডে বেড়াতে এলেই যেন জয়ের কথা বেমালুম ভুলে যেত ব্যাগি গ্রিনরা। এক টেস্টের সিরিজ বলে আদাজল খেয়ে নেমেছিল বিলি মারডকরা। কিন্তু প্রথম ইনিংসেই সেই আশার গুড়ে বালি, ৬৩ রানে অলআউট। ইংলিশ ব্যাটসম্যানরাও যেন অজিদের সঙ্গে একই ক্ষুরে মাথা কামালেন। ফ্রেডরিক স্পোফোর্থের ভয়ংকর বোলিংয়ে ১০১ রানে অলআউট ইংলিশরা। পরের ইনিংসে টেনেটুনে অজিরা করল ১২২। টার্গেট মাত্র ৮৫। ক্রিকেটের বুড়ো দাদু ডব্লিউ জি গ্রেস যেন হাসছিলেন, এ আর এমন কি? এ ম্যাচ তো একাই বের করতে পারবেন তিনি। ইনিংসের শেষটা না জানলে এ কথা বলার দুঃসাহস করতেন না জীবনেও। ইনিংস শেষে দেখা গেল ব্যাট হাতে তিনি একাই দাঁড়িয়ে ছিলেন (৫৪ বলে ৩২)। অন্যরা শুধু এসেছে আর গিয়েছে। ফ্রেডরিক স্পোফোর্থ টানা দুই ইনিংসে ৭ উইকেট নিয়ে ভড়কে দিলেন ইংলিশদের। ৮৫ রানের টার্গেটেও ৭ রানের জয় নিয়ে হোটেলে ফিরল অজিরা। সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের প্রথম ইংল্যান্ড জয়।
বাংলা অভিধানে একটা রাশভারী শব্দ আছে, ‘মণিকাঞ্চন যোগ’। মানে পারফেক্ট টাইমিং। রেজিনাল্ড ব্রুকস এই দিনটার অপেক্ষাতেই ছিলেন। ইংল্যান্ড দলকে খোঁচা দেওয়ার বড়সড় একটা সুযোগ খুঁজছিলেন তিনি। কিন্তু খাপে খাপ মিলছিল না। এবার পেয়েছেন। দ্য স্পোর্টিং টাইমস-এ লিখে ফেললেন একটা অবিচ্যুয়ারি।
আগের দিন যেখানে ডব্লিউ জি গ্রেস ক্রিকেট ছেড়ে পাকাপাকিভাবে চিকিৎসক হওয়ার কথা ভাবছিলেন, সেখানে এই আবিচ্যুয়ারি দেখে রক্ত মাথায় চড়ে গেল। পরের মৌসুমেই অজিদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনবেন অ্যাশেজ, নিজের মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেললেন ‘দ্য ওল্ড বেবি’।
অ্যাশেজের যাবতীয় উত্তেজনা ওখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। পরের মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়া হলো না ডব্লিউ জি গ্রেসের। এমনকি আগের অ্যাশেজের অধিনায়কেরাও নেই। ইংল্যান্ডে এমন ব্যঙ্গ বা রসিকতা সবাই খুব সহজেই নেয়, তাই হারিয়ে যেতেও বেশি সময় লাগত না। কিন্তু নতুন ইংলিশ অধিনায়ক তাতে ছাড় দিলেন না। কোনো টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা ছাড়াই অধিনায়ক হওয়া আইভো ব্লাই ঘোষণা দিলেন, অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি অ্যাশেজ ফেরত আনতে। বললেই কি আর ছিনিয়ে আনা যায়? মেলবোর্নে প্রথম ম্যাচে হেরে বসল ইংল্যান্ড। কিন্তু পরের দুই টেস্ট জিতেই অ্যাশেজ নিজেদের করে নিল ইংল্যান্ড। তিন টেস্টের সিরিজ জিতে নেয় ইংলিশরা। কিন্তু মেলবোর্নে আরেক টেস্টের আয়োজন করে অস্ট্রেলিয়া। ভাগ্য যেন সেখানেই তাঁকে ডাকছিল। ইংল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়া আসার পথে এসএস পেশোয়ারে একজনের চোখে চোখ পড়ে গিয়েছিল তাঁর। সেখান থেকেই পরিচয়, পরিণয়ে গড়ানোর সময় হয়নি, তার আগেই জার্সি গায়ে মাঠে নেমে পরতে হয়েছিল ব্লাইকে। সেই ফ্লোরেন্স মার্ফির দেখা পেলেন চতুর্থ টেস্টে। মার্ফি একা নন, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন একটা ছোট্ট ছাইদানি। যাতে খোদাই করে লেখা অ্যাশেজবৃত্তান্ত। এতে করেই ছাই নিয়ে বাড়ি ফিরবেন ব্লাই। সে ম্যাচ হেরে গেলেও বিজয়ী বেশে বাহুডোরে প্রেয়সী আর ট্রফি হাতে ইংল্যান্ড ফেরেন ব্লাই। ১৬ সেন্টিমিটারের সেই শিরোপার নাম হয়ে যায় ‘অ্যাশেজ আর্ন’। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ব্লাইয়ের কাছেই শোভা পেয়েছিল আর্ন। মৃত্যুর পর ১৯২৭ সালে তা লর্ডস জাদুঘরে তুলে দেন মার্ফি।
টেস্ট ক্রিকেট মানেই পাঁচ দিনের ম্যাড়মেড়ে লড়াই বললে বলতে পারো, কিন্তু অ্যাশেজকে সে তালিকায় ফেলতে গেলে যেকোনো দিক থেকে উড়ুক্কু জুতো ধেয়ে আসতে পারে। ১৩৫ বছরে ক্রিকেট কম পাল্টায়নি। দিনের টেস্ট থেকে দিন-রাতের টেস্ট, জার্সির পেছনে নাম—কোনোভাবেই একটুও কমেনি অ্যাশেজের আবেদন। অ্যাশেজ মানে নতুন শুরু, নতুন পরিকল্পনা। দুই সপ্তাহ আগে বিশ্বকাপ জেতা অধিনায়কেরও জায়গা হয় না এখানে। অ্যাশেজে খেলানোর জন্য বিশ্বকাপযাত্রায় বিরতি ঘটে জশ হ্যাজেলউডের। ব্রড, অ্যান্ডারসনদের সারা বছর অপেক্ষায় রাখা হয় অ্যাশেজের জন্যই। বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগে নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন স্টিভেন স্মিথ। অথচ অ্যাশেজে সব ভোল পাল্টে একেবারে নতুন এক স্মিথ। প্রথম ম্যাচে দুই সেঞ্চুরি। দ্বিতীয় টেস্টে ওভাবে মাঠ না ছাড়তে হলে হয়তো এবারও ইংলিশ বোলিংকে নাস্তানাবুদ করতেন। আবার তৃতীয় টেস্টে নিশ্চিত হেরে যাওয়া ম্যাচটা অতিমানবীয় এক সেঞ্চুরি করে জেতালেন বেন স্টোকস! অ্যাশেজের উত্তেজনাটা এ রকমই। এখানে খেলাটা যতটা না হয় ব্যাটে–বলে, তার চেয়ে বেশি হয় মাথায়। সাদা পোশাকের স্নায়ুযুদ্ধে বার্মি আর্মির সিরিশ কাগজ দেখানোর পরিবর্তে ওয়ার্নারের পকেট খুলে দেখানোর অভিনব প্রতিবাদ। ইনিংসজুড়ে দুয়ো দেওয়া সত্ত্বেও মাঠ থেকে বেরোনোর সময় নিজের নামটা দেখিয়ে যাওয়া। এটাই অ্যাশেজ। ডন ব্র্যাডম্যান, স্টিভ ওয়াহ, রিকি পন্টিং কিংবা ডব্লিউ জি গ্রেস, ইয়ান বোথাম, অ্যালিস্টার কুকেরা আর নেই। সময়ের স্রোতে, বডিলাইন সিরিজ বা নেটওয়েস্ট টেস্ট—সবই ইতিহাসের পাতায় বন্দী। সময় এখন নতুন করে ইতিহাস লেখার, টিম পেইন-জো রুটদের সামনে।