সে অনেককাল আগের কথা। তখন পৃথিবীতে রাজাটাজাদের বেশ দাপট ছিল। এতই তাদের প্রতাপ, বাঘে-মহিষেও এক ঘাটে জল খেতে নেমে পড়ত।
সে রাজারা নিজেদের দাপট বোঝাতে নিয়মিতই যুদ্ধে নামতেন। কিন্তু এই দাপুটে রাজাদেরও নিজেদের সামলে রাখতে হতো নির্দিষ্ট কয়েক মাস। ওই সময়টায় অলিম্পাস পর্বতের কাছে গ্রিক বীরেরা ব্যস্ত থাকতেন অন্য কাজে। সে সময়কার অলিম্পিকে আরেকটি ব্যাপার ঘটত। অলিম্পিয়ায় নিজেদের শৌর্য দেখাতে নামা অ্যাথলেটদের গায়ে একটা সুতাও থাকত না। কেন এভাবে নিজেকে উজাড় করে দেখানোর চেষ্টা—এ প্রশ্নের তিনটি ভিন্ন উত্তর পাওয়া যায়।
শুরুতে লেংটি পরেই দৌড়াতেন সবাই। কেউ দাবি করেন, একবার একটু ঢিলে হয়ে নিচে পড়ে যাওয়া লেংটিতে আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন এক অ্যাথলেট। তাঁর এ দশা দেখা বাকিরা পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, বিসর্জন দিয়েছিলেন নিজ নিজ বস্ত্র।
অন্য এক গল্পে দাবি করা হয়, অর্সিপাস বা অর্হিপাস নামের এক অ্যাথলেট কোমরের ওই বস্ত্র ছাড়া দৌড়ালে গতি বাড়ে, এ সত্য আবিষ্কার করে সে পথে এগিয়েছিলেন। পরে অন্যরাও অনুসরণ করেছেন তাঁকে। তবে আরেক গল্পের দাবি, এক নারী পরিচয় লুকিয়ে অংশ নিয়েছিলেন অলিম্পিকে। এমনকি বিজয়ীও হয়েছিলেন, এমনটা যাতে না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করতেই অ্যাথলেটদের নগ্নভাবে অংশ নিতে বলা হতো।
এ গল্পের ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। তবে ক্যাল্লিপেতেইরা নামের এক সম্ভ্রান্ত নারী নিজেকে লুকিয়ে ছেলের ট্রেনার হিসেবে অলিম্পিক স্টেডিয়ামে ঢুকেছিলেন এবং ছেলে বিজয়ী হওয়ার পর ভুলে নিজের পরিচয় দিয়ে ফেলেছিলেন। এরপর থেকে ট্রেনারদেরও যে নগ্ন হওয়ার নির্দেশ এসেছে, এটা সত্য বলেই মানেন সবাই।
আদি অলিম্পিক ছিল এমনই। সেটা ছিল পুরুষদের বীরত্ব দেখানোর স্থান। নারীদের উপস্থিতি সেখানে অগ্রহণযোগ্য ছিল। সেসব দিন যে পৃথিবী পেরিয়ে এসেছে, তার বড় প্রমাণ টোকিও অলিম্পিক।
টোকিও অলিম্পিক এমনিতেও অন্য সব অলিম্পিকের চেয়ে ভিন্ন। রিও অলিম্পিক আয়োজন নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েছিল। জিকা ভাইরাসের কারণে অনেক অ্যাথলেট নাম কাটিয়ে নিয়েছিলেন, কিন্তু ব্রাজিলের মানুষ অন্তত অধীর আগ্রহে অলিম্পিকের অপেক্ষায় ছিলেন।
টোকিও অলিম্পিকই সম্ভবত প্রথম অলিম্পিক, যেখানে উদ্বোধনী দিনেও সম্রাট নারুহিতো যখন বললেন, ‘আমি অলিম্পিক উদ্বোধন করছি,’ তখনো স্টেডিয়ামের বাইরে একদল লোক এর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। এক বছর পিছিয়ে দেওয়ার পরও এক জরিপে আয়োজক টোকিওর তিন-চতুর্থাংশ লোক অলিম্পিকের বিপক্ষে মত দিয়েছেন!
এসব নেতিবাচক খবর। ইতিবাচক দিকেই বরং যাওয়া যাক। এবারের অলিম্পিকের পদকগুলো বানাতে পরিবেশের কথা মাথায় রাখা হয়েছে। দুই বছর ধরে ৭৮ টনের বেশি পরিত্যক্ত মোবাইল ও ইলেকট্রনিক যন্ত্র থেকে বের করা সোনা, রুপা ও ব্রোঞ্জ থেকে এবারের মেডেল প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো টোকিও অলিম্পিকে নারী-পুরুষে সমতা আনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ, সব খেলা মিলিয়ে যত অ্যাথলেট যাবেন, তার অর্ধেক নারী হবেন। আর সবকিছুর মতোই করোনা মহামারি এখানেও বাদ সেধেছে। অনেকেই সংক্রমণের ভয়ে সরে গেছেন, অনেকে শেষ মুহূর্তে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে ৪৯ শতাংশ নারী অ্যাথলেট নিয়েই এবার সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে আয়োজকদের।
একসময় নারীবিবর্জিত অলিম্পিক এবার আরেকটি দিক থেকে অনন্য। প্রথমবারের মতো কোনো লিঙ্গ-পরিবর্তিত ব্যক্তি অংশ নিচ্ছেন অলিম্পিকে। নিউজিল্যান্ডের ভারোত্তোলক লরেল হাবার্ড নারীদের ৮৭ কেজি-ঊর্ধ্ব ওজন শ্রেণিতে অংশ নিচ্ছেন। আধুনিক অলিম্পিকের ১২৫ বছরের ইতিহাসে প্রথম কোনো লিঙ্গ-পরিবর্তিত ব্যক্তি হিসেবে এই কীর্তি হাবার্ডের। অলিম্পিক শুরুর আগে হাবার্ড আলোচনায় থাকলে প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের অ্যাথলেট হিসেবে অলিম্পিকে নামার রেকর্ডটি কুইনের। কানাডা নারী ফুটবলের এই মিডফিল্ডার রিও অলিম্পিকেও ছিলেন। তবে সেবার ব্রোঞ্জ জয়ের সময় জন্মগত রেবেকা ক্যাথেরিন নামেই পরিচিত ছিলেন। টোকিও অলিম্পিকের আগে নিজেকে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি হিসেবেই পরিচয় দিতে স্বচ্ছন্দবোধ করেছেন কুইন।
এবারের অলিম্পিকে বাইরের আলোচনাটাই কেন যেন বেশি হচ্ছে। অবশ্য এর পেছনে সুপার অ্যাথলেটদের অনুপস্থিতিও বড় কারণ। আদি অলিম্পিকে একবার এক কাণ্ড হয়েছিল। অলিম্পিকের আগে অলিম্পিয়া পর্বতের পার্শ্ববর্তী এলিস শহরে সব অ্যাথলেট অনুশীলন করতেন। এক বিশাল বপু এসেছিলেন রেসলিংয়ে। তখন পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু দৈত্যাকার সেই রেসলার নিজের বস্ত্র বিসর্জন দিতেই বাকি সবাই অলিম্পিক ছেড়ে পালালেন। কারণ, একে হারানো যে তাঁদের কাজ নয়, সেটা বুঝতে বাকিদের দেরি হয়নি।
গত তিনটি অলিম্পিকে সাঁতারপুল আর ট্র্যাকে এমন কিছুই ছিল। আধুনিক যুগ বলে কেউ পালাতেন না, কিন্তু মাইকেল ফেল্প্স আর উসাইন বোল্টের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যে কারও জেতার জো নেই, সেটা তো সবাই জানতেন। টানা তিন অলিম্পিকে রাজত্ব করে ফেল্প্স ২২টি পদক নিয়ে এখন অবসরে। ওদিকে সতীর্থের দোষে একটি সোনা হারানোর পরও ট্র্যাক থেকে অকল্পনীয় ৮টি সোনা জিতে অনতিক্রম্য এক চূড়ায় বসেছেন বোল্ট।
টেনিসেও নেই রজার ফেদেরার-রাফায়েল নাদালের মতো নাম। ফুটবলেও নেই নেইমার-মেসির মতো কেউ।
‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’-এর এমনই মহিমা, নতুন তারকার জন্ম তো এখানেই। রিও অলিম্পিকেই সর্বকালের সেরাদের তালিকায় চলে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সাঁতারু কেটি লেডেকি আছেন। ওদিকে জিমন্যাস্টে তাঁর স্বদেশি সিমোন বাইলসও নিজের আলোয় জ্বলজ্বল করছেন।
বোল্টের মতো তারকার অনুপস্থিতি অন্তত এবার অলিম্পিকের সেরা ইভেন্ট নিয়ে আগ্রহ বাড়াচ্ছে। এত দিন যেটা বোল্টের সম্পত্তি বলেই জানতেন সবাই, সেটা এবার অন্য কারও হচ্ছে এবং বহুদিন পর ১০০ মিটারে কোনো ফেবারিট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রিওতে ব্রোঞ্জ জেতা আন্দ্রে দি গ্রাসেরই ফেবারিট থাকার কথা ছিল। কিন্তু কানাডিয়ান নিজের ফর্ম হারিয়ে বসেছেন। রিওতে তাঁর চেয়ে ০.০৩ সেকেন্ড পিছিয়ে থাকা আকানি সিম্বাইন দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন ২০২০ সালে। করোনা মহামারি এসে দক্ষিণ আফ্রিকানের পথে কাঁটা বিছিয়েছে। এ দুজনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেভিন ব্রোমেল ও রনি বেকারকেও হিসাবে রাখা হচ্ছে।
জিমন্যাস্ট এবার এমনিতেই চমক দেখিয়ে ফেলেছে। জাপানিদের প্রিয় ‘কিং কোহেই’ উচিমুরা বার থেকে পড়ে গেছেন। আর সে সুযোগে ফাইনালে উঠেছেন আর্তুর দালালোয়ান। এখনো নিষেধাজ্ঞা চলায় এবারও রাশিয়া নামে কোনো দেশ নেই অলিম্পিকে। রাশিয়ান অলিম্পিক কমিটি নামে খেলতে আসা জিমন্যাস্ট দল এরই মধ্যে চমক দেখিয়েছে। ফেবারিট জাপানকে হারিয়ে দলগত সোনা জিতে নিয়েছে।
ওদিকে চমক নয়, ইতিহাসই গড়েছে ফিলিপাইন ও বারমুডা। প্রথমবারের মতো অলিম্পিক সোনা জিতেছে দুই দেশ। ফিলিপাইনকে ভারোত্তোলন থেকে সোনা এনে দিয়েছেন হিদিলিন দিয়াজ। যিনি সোনা জয়ের আনন্দের পর বলেছেন, এত কষ্টের পর এবার একটু পেট ভরে খাবেন! ওদিকে মেয়েদের ট্রায়াথলনে ঝড় তুলে ফ্লোরা ডাফির এই পদক দেশটির মাত্র দ্বিতীয় অলিম্পিক পদক।
প্রাপ্তির কথায় এবার বাংলাদেশও কিছু পাচ্ছে। প্রতিবার শুধু অংশগ্রহণেই সন্তুষ্ট হতে হয় বাংলাদেশকে। আর্চারিতে রোমান সানা ও দিয়া সিদ্দিকীর লড়াকু পারফরম্যান্স এবার দেশকে গর্ব করার সুযোগ করে দিয়েছে। এ পারফরম্যান্স ভবিষ্যতে পদকের হাসিতে রূপ নেবে, এমন প্রত্যাশা তাই এখন আর দুরাশা নয়।