টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের কথা বেশ আগে থেকেই ভাবছিলেন ক্রিকেটের নীতিনির্ধারকেরা। বারবার বাতিল হওয়ার পর ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো যখন সবুজসংকেত এল, টেস্টপ্রেমী মানুষের জন্য এর চেয়ে খুশির সংবাদ কিছু ছিল না। আইসিসির নতুন এই টুর্নামেন্ট ছিল কাঠফাটা রোদ্দুরের মধ্যে একটুখানি শান্তির পরশ।
টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে শুরু হয়েছে অনেক কিছুই। প্রথমবারের মতো সাদা জার্সির পেছনে নাম লেখা হয়েছে, জার্সিতে স্পষ্ট হয়েছে স্পনসরের নাম। মানুষের কাছে টেস্ট পৌঁছে দিতে যা যা করা প্রয়োজন, সবই করেছে আইসিসি। তার ফলাফলও পেয়েছে তারা। দুই বছর ধরে টেস্ট ক্রিকেটের প্রতিটি ম্যাচ ছিল দর্শকের চোখের মণি। একটা ম্যাচও হেলাফেলা করে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। ফলাফলটা চোখের সামনে। ‘টেস্ট ক্রিকেট হারিয়ে যাচ্ছে’ তকমা ভুলে ঘটা করে টেস্ট বিশ্বকাপ দেখতে বসেছে মানুষ। সেই বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি ভারত আর নিউজিল্যান্ড।
টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের নিয়মটাও একটু অন্য রকম করে সাজানো হয়েছিল। বলাই হয়েছে, যত যা–ই হোক, দিন শেষে ক্রিকেট ম্যাচ। কোনো একটা কিছুর কমতি হলেই ম্যাচ মাঠেই গড়াবে না। ইংল্যান্ড তাই সব প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নেমেছিল। এই টেস্ট পাঁচ দিন গড়াবে মাঠে। যদি বৃষ্টিতে ভেসে যায়, তবে তা গিয়ে গড়াবে ষষ্ঠ দিনে। ওভাবেই ভেবে রাখা হয়েছিল। ইংল্যান্ডে এমনিতেই ক্রিকেট মাঠে গড়ায় শুধু গ্রীষ্মে, তার মধ্যে যদি বেরসিক বৃষ্টি এসে হানা দেয়, তখন কী হবে? তা ভেবেই রিজার্ভ ডে রাখার সিদ্ধান্ত ছিল আইসিসির।
নিরপেক্ষ ভেন্যুতে দুই প্রান্তের দুই দল নিজেদের কন্ডিশন থেকে বেরিয়ে মুখোমুখি হয়েছিল বৈরী আবহাওয়ার। দুই দলের সামনেই ইতিহাস গড়ার সুযোগ। প্রথমবারের মতো টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের গদা কে তুলে নেবে নিজেদের কাঁধে?
বিরাট কোহলির সামনে ছিল নিজেকে ভারতের সেরা অধিনায়ক প্রমাণের সুযোগ। বারবার কথা উঠেছে তাঁর অধিনায়কত্ব নিয়ে, অধিনায়ক ট্যাগটা নাকি তাঁর নামের পাশে যায় না। অন্যদিকে কেইন উইলিয়ামসনের সামনে কিউইদের আক্ষেপ ঘোচানোর সুযোগ। টানা দুই বিশ্বকাপে রানার্সআপ ট্রফি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাদের। নিজেদের নামের পাশেও আস্তে আস্তে ‘চোকার’ তকমাটা লেগে যাচ্ছিল যেন। কেইন উইলিয়ামসন সে ধারাটাই ভাঙতে নেমেছিলেন, ভারতের বিশাল ব্যাটিং লাইনআপের সামনে পাঁচ পেসার নিয়ে।
অধীর আগ্রহে বসে থাকা মানুষের জন্য প্রথম দিনই নিয়ে এল দুঃসংবাদ। মাঠে বল গড়ানো দূরে থাক, টসই সম্পন্ন হতে পারেনি প্রথম দিন। দ্বিতীয় দিনে যখন সুয্যিমামা মুখ তুলে তাকিয়েছেন, তখন প্রত্যেক ক্রিকেট দর্শকের মনেও আশার আলো জ্বলেছে। তিনি যখন দেখা দিয়েছেন, আজ তখন বল মাঠে গড়াবেই। টস হলো, নিউজিল্যান্ড সুযোগটা হারাল না, জিতেই ভারতকে পাঠিয়ে দিল বৃষ্টিভেজা পিচে ব্যাটিং করতে। প্রথম দিন পুরোটা সম্পন্ন হতে পারল না আলোকস্বল্পতার জন্য।
তৃতীয় দিনে শুরু হতে না হতেই শুরু হলো জেমিসন পর্ব। মাত্র অষ্টম টেস্ট খেলতে নামা কাইল জেমিসন একাই ধসিয়ে দিয়েছেন ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ। আর নিউজিল্যান্ডও সুযোগটা নিয়েছে ভালোভাবেই। নিউজিল্যান্ডের ইনিংসের মধ্যেই বৃষ্টিতে ভেসে যায় চতুর্থ দিন আর পঞ্চম দিনের প্রথম সেশন। পাঁচ দিনের টেস্ট নেমে এল সাড়ে তিন দিনে! দেড় দিনে শেষ করতে হবে দেড় ইনিংস, টেস্ট ক্রিকেটের সম্পূর্ণ সৌন্দর্য যেন ঠিকরে বের হচ্ছিল শেষ সময়ে!
ক্রিকেটের সম্পূর্ণ সৌন্দর্য দেখা গেল শেষ দেড় দিনে। নিউজিল্যান্ড ম্যাচ জেতার সর্বোচ্চ চেষ্টা নিয়েই এগোতে শুরু করল। ৩২ রানের লিড নিয়ে শেষ হলো তাদের ইনিংস, দিন শেষ করার আগেই ভারতের দুই উইকেট হাওয়া। ষষ্ঠ দিনে এসে বাকি এখনো দেড় ইনিংস, পিচের অবস্থা থেকে ম্যাচ যেকোনো দিকেই হেলতে পারে। ভারত যখন নিজেদের ব্যাটিং লাইনআপের ওপর ভরসা করে বসে ছিল, তখনই তাণ্ডব চালাতে চলে আসেন নিউজিল্যান্ডের পেসাররা। দেড় সেশনেই শেষ ভারতের বিশাল লাইনআপ। শেষ ৫৩ ওভারে নিউজিল্যান্ডের প্রয়োজন মাত্র ১৩৯ রান। ভারতের দরকার ১০ উইকেট।
আর সেটাই করে দেখিয়েছে নিউজিল্যান্ড। রান করাটা কষ্টের নয়, বরং টিকে থাকাটাই বড়। এই পিচে স্পিনার মানেই যম। সেখানে রবীন্দ্র জাদেজা আর রবিচন্দ্রন অশ্বিন আসা মানেই ম্যাচ হাত থেকে ছুটে যাওয়া। কার্যত হয়েছেও সেটা। অশ্বিন এসেই তিন ওভারে তুলে নিয়েছিলেন তিন উইকেট। রিভিউ নিয়ে বেঁচেছেন উইলিয়ামসন। আর তখন থেকেই নিজেদের দেয়াল গড়েছেন উইলিয়ামসন ও রস টেলর। নিউজিল্যান্ডে তাঁদের মতো অভিজ্ঞতার ভান্ডার আর কারও নেই। আর সেটাই করেছেন দুজন। মাঠে খুঁটি গেড়ে বসে ছিলেন, আস্তে আস্তে ম্যাচ বের করেছেন। এর মধ্যে দুই ক্যাচ মিস যেন আরও সুবিধা করে দিয়েছে কিউইদের। ম্যাচজুড়ে আগ্রাসী কোহলিকে যেন যখন দরকার, পাওয়া গেল না তখনই। চাপের মুখে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হলো তাঁর অধিনায়কত্ব। কোনোভাবেই অভিজ্ঞ জুটিকে ফেরত পাঠাতে পারলেন না ড্রেসিংরুমে। আর শেষ সেশনের অর্ধেকটা বাকি থাকতেই শিরোপা নিজেদের করে নিল নিউজিল্যান্ড। তৈরি করল নতুন এক ইতিহাস। দুই বছর ধরে চলা টুর্নামেন্ট, বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া ফাইনাল, ১৯৭৮ সালের পর প্রথম কোনো টেস্ট গড়াল ষষ্ঠ দিনে। আর তার শেষটা হলো ছবির মতো, যখন সেরা দলটি শিরোপা উঁচিয়ে ধরে।
কোনো টুর্নামেন্টের শুরুতেই কিউইদের ফেবারিট ধরা হয় না। ২০১৫ বিশ্বকাপে তাদের উত্থানটাও ধরা হয়েছিল ফ্লুক হিসেবেই। নিন্দুকের ‘স্বাগতিক বলেই এত দূর আসতে পেরেছে’ কথাটা প্রমাণও হয়েছিল ফাইনালে বাজে পারফরম্যান্স করে। দুই বছর আগে এই ইংল্যান্ড থেকেই দুবার টাই করে চার-ছক্কার ব্যবধানে বিশ্বকাপ খুইয়েছিল তারা। কেইন উইলিয়ামসন হাল ছাড়েননি, বি জে ওয়াটলিং, রস টেলর, টিম সাউদি—কেউই হাল ছাড়েননি। আইসিসি টুর্নামেন্টে এসে বারবার ফাইনাল হারার দুঃসহ স্মৃতিটা আর নিতে পারছিল না কিউইরা।
নিউজিল্যান্ড উইকেটকিপার বি জে ওয়াটলিংয়ের বিদায়ী টেস্ট ছিল এটি। পরিসংখ্যানের খেরো খাতায় হয়তো তাঁর নামটা কোনোভাবেই উচ্চাসনে রাখা হবে না, কিন্তু প্রত্যেক কিউই সমর্থক জানেন, ওয়াটলিং তাঁদের কত আপন। মার্টিন ক্রো, স্টিফেন ফ্লেমিং, ড্যানিয়েল ভেট্টোরি, ব্রেন্ডন ম্যাককালামরা যে স্বাদ দিতে পারেননি নিউজিল্যান্ডকে, সেটাই করতে পেরেছেন কেইন উইলিয়ামসন। আপন মানুষকে সর্বোচ্চ উচ্চতায় তুলে বিদায় দেওয়ার মতো আনন্দ আর কীই–বা হতে পারে?