বাংলা অভিধানে ‘পরিপূরক’ বলে একটা শব্দ আছে, যার অর্থ যা দ্বারা একজন অপরজনকে পরিপূর্ণ করেন। একজন মেসির জন্য সর্বদাই একজন রোনালদো থাকবেন। পেলের জন্য ম্যারাডোনা। কোহলির জন্য স্টিভ স্মিথ আর লারার জন্য শচীন! টেনিসেও গল্পটা একই রকম ছিল। রজার ফেদেরারের পরিপূরক ছিলেন রাফায়েল নাদাল। ছিলেন বলতে হচ্ছে, কারণ তাঁদের রাজ্যে হানা দেওয়া ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে আরেকজনের।
নোভাক জোকোভিচের টেনিসে হাতেখড়ি হয়েছিল ন্যাটো বোম্বিংয়ের মধ্যে, বেলগ্রেডের রাস্তায়, ক্লে কোর্টে যখন তাঁর পদচারণ, ঠিক সে সময়েই শহরের আরেক প্রান্তে পড়ছে একের পর এক বোমা। যুগোস্লাভিয়া ভাঙার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ভয়াবহ ধকল গেছে সার্বিয়ার ওপর দিয়ে। প্রতিদিনের বেঁচে থাকার তাড়না, আর ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস রেখে এগিয়ে যাওয়া—দুইয়ে মিলে ভেতরে ভেতরে গড়ে উঠেছে টেনিসজগতের নতুন এক পরাশক্তি। বোমা-বারুদের গন্ধ তাকে শিখিয়েছে ম্যাচ পয়েন্ট হোল্ড করার চাপ সামাল দেওয়া, কীভাবে চারদিকের চাপেও মাথা ঠান্ডা রেখে ম্যাচ বের করে নিয়ে আসা যায়, কীভাবে দুই রাজার গ্রেটনেসকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তোলা যায়।
জোকোভিচের টেনিস রাজত্বে আগমন অনেক দেরিতে। তত দিনে টেনিসে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন ফেদেরার আর নাদাল। ফেদেরার তো টেনিস কিংবদন্তির আসনে চলে গিয়েছেন। সর্বজয়ী ফেদেরারের একমাত্র বাধা? তাঁর নাম রাফায়েল নাদাল। জোকোভিচ যখন প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনাল খেলেন, তখন ফেদেরারের ঝুলিতে ১২টি গ্র্যান্ড স্লাম। সর্বোচ্চ গ্র্যান্ড স্লামের মালিক হতে প্রয়োজন আর মাত্র দুটি গ্র্যান্ড স্লাম। নাদালও নিজের জায়গা খুঁজে নিচ্ছেন টেনিস জগতে, নোভাকের তখন মাত্র শুরু। আর সেখান থেকেই শুরু নোভাকের টেনিসকে নিজের করে নেওয়ার যাত্রা।
যাত্রা কোনোভাবেই শুভ ছিল না, যতটা না বাধা মনের, তার থেকে বেশি বাধা মাঠের। দিনে দিনে একজন খেলোয়াড় যত নিজেকে শাণিত করেন, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে তাঁদের ভক্তসংখ্যা। কিন্তু নোভাকের বেলায় সে কথাটা তেমন সত্য নয়। তাঁর ভক্ত ছিল না বললে ভুল হবে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে ফেদেরার আর নাদাল যেভাবে নিজের ভক্তকুল বাড়িয়েছেন, সেভাবে মানিয়ে নিতে পারেননি নোভাক।
টেনিসে ‘ব্যাড বয়’ কথাটার খুব একটা প্রচলন নেই বললেই চলে। কারও আচরণই মাঠের ভেতরে–বাইরে উগ্র নয়। কিন্তু নোভাক ছিলেন টেনিস দর্শকদের চোখের বালু। কারণটা অনেকভাবেই বলা যায়। টেনিসে যতটা না বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় শিরোপাকে, তার থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় সৌন্দর্যকে। রজার ফেদেরারকে বলা হয় ধ্রুপদি টেনিসের আবিষ্কারক। তাঁর খেলা দেখে কোনো দিন টেনিস না দেখা মানুষটাও খেলা দেখতে বসে পড়বেন। সমসাময়িক নাদাল ছিলেন পুরোপুরি উল্টো। পুরো মাঠ কাভার করে ‘ওয়ারিয়র’ টেনিস খেলতেন তিনি। তাঁর খেলা দেখে ধ্রুপদি ভাব না এলেও বিরক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল না।
নোভাক জোকোভিচ এই দুই দিক দিয়েই উল্টো। তাঁর খেলায় না আছে ‘প্রাণ’, না আছে তথাকথিত সৌন্দর্য। রসকষহীন একেকটা ম্যাচ খেলে যান, প্রতিপক্ষ বিরক্ত হয়, দর্শকেরা বিরক্ত হন। অনেকটা গোলের খেলা ফুটবলে ‘বাসপার্ক’ করার মতন। আক্রমণ নেই, শুধুই ডিফেন্স। টেনিসের ভাষায় যাকে বলে রিটার্ন। তাঁর রিটার্নে বিরক্ত হয়ে প্রতিপক্ষ একটা না একটা ভুল করেই বসে, আর সেই ভুলকেই কাজে লাগিয়ে জয়টা পকেটে পুরে নিয়ে যান জোকোভিচ। দিনের পর দিন এভাবেই কোর্টে রাজত্ব করেছেন জোকোভিচ, কখনো পেরেছেন, কখনো পারেননি; কিন্তু হাল ছাড়েননি। ফেদেরার-নাদালের যুগে তিনি ছিলেন পথের কাঁটা। নাদাল-ফেদেরার যখন নিজেদের শীর্ষে নিয়ে গিয়েছেন অনেক আগেই, জোকোভিচ তখন তাঁদের ধারেকাছে থেকেও নিজেকে শীর্ষ বলতে পারছিলেন না।
প্রথম গ্র্যান্ড স্লামের পর দ্বিতীয় গ্র্যান্ড স্লামের মালিক হতে জোকোভিচকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল পাক্কা তিন বছর। সেই থেকে শুরু। সেখান থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। সে বছরই তুলে নিয়েছেন ৩ গ্র্যান্ড স্লাম, এত দিন ধরে গুটি গুটি পায়ে এগোনো নোভাক গর্জে উঠলেন নিজের শক্তিতে। ২০১১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ২০১৪–এর অস্ট্রেলিয়ান ওপেন বাদে কোনো গ্র্যান্ড স্লামেই সেমির আগে বাড়ি ফিরতে হয়নি তাঁকে। টেনিস জগতের দুই অবিসংবাদিত রাজার মাঝামাঝি সময়ে জন্ম নিয়ে এত দিন যাকে লোকে বলত দুর্ভাগা, সেই নোভাকই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে বুঝিয়ে দিয়েছেন, কারও জন্ম দুর্ভাগা হয় না। কর্ম দিয়ে সেই দুর্ভাগ্য সৌভাগ্যে পরিণত করে নিতে হয়। ‘জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো’ কথাটাকে নিজের মন্ত্র বানিয়ে নিয়েছিলেন এই সার্বিয়ান। আর তার ফলাফল দিয়েছেন খেলায়।
বছরটা নোভাক জোকোভিচ শুরু করেছিলেন নাদাল-ফেদেরার থেকে তিন ধাপ পেছনে থেকে। দুই রাজা বসে আছেন ২০ শিরোপা নিয়ে চূড়ায়, আর জোকোভিচ ১৭ নিয়ে তৃতীয়তে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই যাঁর চূড়ায় উঠবার ইচ্ছা, তাঁকে কি দমানো যায়? ‘দ্য হ্যাপি স্ল্যাম’ জিতেছিলেন নিজের মতন করে। কথা উঠেছিল ফ্রেঞ্চ ওপেন নিয়ে। রোলা গ্যাঁরোর অবিসংবাদিত রাজা রাফায়েল নাদাল; ক্যারিয়ারে গুনে গুনে মাত্র দুইবার হেরেছেন এই মাটির কোর্টে। তাঁকে হারানো অসম্ভবের থেকেও কঠিন। কিন্তু নোভাক জোকোভিচ কী অনায়াসেই সেটা করে দেখালেন। প্রতিরোধ গড়েছিলেন নাদাল, কিন্তু জোকোভিচের সঙ্গে আর পাল্লা দিয়ে পেরে ওঠেননি। জোকোভিচ গড়েছেন এমন এক রেকর্ড, যা টেনিসের দুই রাজা এখনো স্বপ্ন দেখেন। প্রতিটি গ্র্যান্ড স্লাম দুইবার করে জেতার আনন্দে মেতেছেন জোকোভিচ। নাদাল-ফেদেরারের জন্য যা এখনো স্বপ্ন। শুধু কি তাই? প্রতিটি মাস্টার্স ট্রফিতেও আছে তাঁর ছোঁয়া। টেনিসের রেকর্ড বুকে শিরোপার সঙ্গে একটি নাম সব সময়ই জড়িয়ে আছে, তা হলো নোভাক জোকোভিচ।
জোকোভিচের সামনে প্রমাণ করার মতো কিছুই বাকি ছিল না, ক্যারিয়ারের এই সময়ে এসে সব জিতে যাওয়ার মতো আনন্দ আর অর্জনের ভাগীদার না থাকা জোকোভিচকে নিয়ে গিয়েছে অন্য এক চূড়ায়। সে চূড়ায় তিনি একাই বাস করছেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন যে তা–ও ছাড়িয়ে যাওয়ার। স্বপ্ন, টেনিস ইতিহাসের সবখানে নিজের নাম প্রথমে দেখার। উইম্বলডন ছিল তাঁর স্বপ্ন পূরণের শেষ ধাপ।
টেনিস ইতিহাসের সবচেয়ে সম্মানজনক শিরোপা হিসেবে ধরা হয় উইম্বলডনকে। এই উইম্বলডনেই দুই বছর আগে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফাইনাল উপহার দিয়েছিলেন জোকোভিচ। আর সেই উইম্বলডন দিয়েই নিজেকে ইতিহাসের পাতায় তোলার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাননি সার্বিয়ান। লন্ডনের এক প্রান্তে যখন ফুটবলপ্রেমীরা ব্যস্ত ইউরো ফাইনাল দেখতে, ঠিক তখনই লন্ডনের অন্য প্রান্তে শিরোপাটা নিজের করে নিয়েছেন জোকোভিচ। ষষ্ঠ উইম্বলডন শিরোপা জিতলেন নিজের মতন করেই। টুর্নামেন্টের শুরুতে আর শেষে একটা একটা করে সেট হেরে সবাইকে জানান দিয়েছেন, ‘আমিও মানুষ, হারতে আমিও পারি।’
ওপেন এরাতে ক্যালেন্ডার স্লাম নিজের করে নেওয়ার সুযোগ ছিল তাঁর সামনে। কিন্তু সেটা হারিয়েছেন ১ ম্যাচ দূরত্বে। তীরে এসে তরি ডোবা যাকে বলে আরকি। সরাসরি সেটে দানিল মেদভেদেভের কাছে হেরে রড লেভারের পাশে নিজের নামটা লেখাতে পারেননি তিনি। তাতে কি? টেনিস রাজত্বে যা কেউ করে দেখাবে বলে ভাবতেও পারেনি, সেটাই করে দেখিয়েছেন।
ইতিহাসের পাতায় এখন লেখা হবে, টেনিস সাম্রাজ্যে রাজা এখন ৩ জন। রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল, নোভাক জোকোভিচ। ২০ নম্বর শিরোপাটা বাগিয়ে নিয়ে এখন যৌথভাবে শীর্ষে এখন তাঁরা তিনজনেই। ক্যারিয়ারে তাঁর একমাত্র আক্ষেপ অলিম্পিক আর ক্যালেন্ডার স্লাম। তাতে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বে বিন্দুমাত্র প্রশ্ন ওঠেনি, উঠতে পারবে না।
সার্বিয়ার সেই ছোট্ট ছেলেটা, যার দিন কাটত বোমা হামলার ভয়ে, আজ তিনি টেনিস ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়। হয়তো তাঁর পেছনে দর্শকদের মুহুর্মুহু চিৎকার নেই, মাঠে রগচটা হয়ে র্যাকেট স্ম্যাশ করেন, গালাগালিও করেন; কিন্তু তাতে তাঁর থোড়াই কেয়ার। দর্শকের মনে থাকতে তাঁর আগমন ঘটেনি, ঘটেছে বিশ্বসেরা হতে, আর এখন পর্যন্ত সেটাই করে যাচ্ছেন তিনি!