আধুনিক ক্রিকেটে এখন ফরম্যাটের অভাব নেই; ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি, টি-টেন, দ্য হানড্রেড। কিন্তু ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের প্রশ্ন এলে উত্তর একটাই, টেস্ট ক্রিকেট!
আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সূচনা হয়েছিল এ রকমই এক ক্রান্তিকালে। ক্রিকেটে ফ্র্যাঞ্চাইজি যুগের সূচনা হয়েছিল আইপিএল দিয়ে। এরপর তার হাত ধরে বিগ ব্যাশ, বিপিএল; গত দশকের শেষ দিকে ডানা মেলে আকাশে উড়েছিল ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট। এতটাই পাখা মেলেছিল যে টেস্ট ক্রিকেট বলে যে একটা ফরম্যাট আছে, সেটাই ভুলতে বসেছিল অনেকে। হবে না-ইবা কেন? পাঁচ দিনের লড়াই, কোনো কোনো সময় এতটাই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয় যে কোনো ফলই আসে না। আর সেই সঙ্গে এই যুগে টানা পাঁচ দিন মাঠে যাওয়া কিংবা টিভির সামনে বসে থাকার ধৈর্যই-বা আছে কার? এর থেকে বরং টি-টোয়েন্টি দেখি। ৪ ঘণ্টার খেলা, ধুন্ধুমার অ্যাকশন, চার-ছয়ের ছড়াছড়ি, পূর্ণাঙ্গ বিনোদন।
ছোট ফরম্যাটের আগমন বদলে দিয়েছে টেস্ট ক্রিকেটের আবেদন। তাই বলে টেস্ট কিন্তু তার সৌন্দর্য হারায়নি। এখনো এর পরতে পরতে থাকে রোমাঞ্চ, এক পাশে টিকে থাকার প্রচণ্ড ইচ্ছে, ঠিক তার বিপরীতেই ভেঙে ফেলার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা। একদিকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা, অন্যদিকে গোড়াতেই গুঁড়িয়ে ফেলার অধ্যবসায়—সব মিলিয়ে টেস্ট ক্রিকেট যেন জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালেও দেখা মিলছে সেটারই।
টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফরম্যাটের সঙ্গে তো আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। দুই বছর ধরে একে অপরের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেলে দলগুলো। এবার অংশ নিয়েছিল র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে থাকা ৯টি দল। আর সেখান থেকেই একে অপরের বিপক্ষে খেলে শীর্ষ দুই দল মুখোমুখি হয় ফাইনালে। পয়েন্ট ব্যবধানে এগিয়ে থেকে এবারের শীর্ষস্থান দখল করেছে অস্ট্রেলিয়া। আর দ্বিতীয় স্থানে আছে ভারত। ইংল্যান্ডের ওভালে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে মুখোমুখি ভারত আর অস্ট্রেলিয়া। প্রশ্ন একটাই, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের গদা উঁচিয়ে ধরতে যাচ্ছে কারা? আর সেটার উত্তর দুই দলের কাছে সম্পূর্ণ দুই রকম।
ভারতের কথা দিয়েই শুরু করা যাক। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপজুড়ে তাদের সেরা পারফরমার ছিলেন ঋষভ পন্ত। উইকেটের সামনে ও পেছনে তিনিই ছিলেন ভারতের ভরসা। কিন্তু গত বছরের একেবারে শেষ দিকে ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন পন্ত। ক্রিজে ফেরা দূরে থাক, জীবন নিয়েই টানাটানি পড়ে যায় তাঁর। ঠিকভাবে হাঁটতেই পন্তের সময় লেগেছে প্রায় ৪ মাস, চোট কাটিয়ে মাঠে ফিরতে ফিরতে তো প্রায় দুই বছরের মতো সময় লেগে যাবে।
বাধ্য হয়েই তাঁর বিকল্প খুঁজতে শুরু করে ভারত। আর তখনই মাথায় হাত পড়ে ভারতের। মহেন্দ্র সিং ধোনির বিদায়ের পর উইকেটের পেছনে কম নিরীক্ষা করেনি ভারত। দিনেশ কার্তিক, পার্থিব প্যাটেল তো পুরোনো নাম, এক ম্যাচে কিপিং গ্লাভস হাতে দাঁড়িয়েছিলেন নোমান ওঝাও। কিন্তু কেউই থিতু হতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ঋষভের হাতেই ভরসা খুঁজে পেয়েছিল ভারতবাসী। লাল বলে ব্যাট হাতে যেমন দুর্দান্ত, তেমনি উইকেটের পেছনেও সমান পারদর্শী তিনি। অথচ ভারতের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটাতেই তিনি নেই।
ফাইনালে উইকেটের পেছনে ভারতের ভরসা শ্রীকার ভারত। গ্লাভস হাতে তাঁর অভিজ্ঞতা মাত্র চার ম্যাচের। গ্লাভস হাতে ভরসা রাখলেও কপালে একটা চিন্তার বলিরেখা রয়েই যায়।
শুধু উইকেটের পেছনে নয়, উইকেটের সামনেও দুশ্চিন্তা কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের। লাল বলে ওপেনার হিসেবে অনেকদিন ধরেই দলে থিতু হয়ে আছেন অধিনায়ক রোহিত শর্মা আর কে এল রাহুল। কিন্তু আইপিএলে ক্যাচ ধরতে গিয়ে চোটে পড়েন রাহুল। নিয়মিত ওপেনারকে হারিয়ে ভারতকে ভরসা করতে হচ্ছে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের দুর্দান্ত ফর্মে থাকা শুবমান গিলের ওপর। আইপিএলের ফর্ম লাল বলে বজায় রাখতে পারবেন কিনা, প্রশ্ন সেটাই।
ব্যাটিং-কিপিং ছাড়াও বোলিং ইউনিটেও চমক রেখেছে ‘ম্যান ইন ব্লু’রা। বোলিং র্যাংকিং-এর শীর্ষে থাকা রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে বাদ রেখেই সেরা একাদশ গড়েছে তাঁরা। সবুজ পিচে স্পিনার নয়, তাদের ভরসা বরং পেস ইউনিটে।
তাই বলে অস্ট্রেলিয়ান শিবিরেও যে খুব একটা শান্তির সুবাতাস বইছে, তা কিন্তু নয়। নিজেদের পেস অ্যাটাকের কান্ডারি জশ হ্যাজেলউডকে ইতিমধ্যে হারিয়েছে তারা। ইংল্যান্ডে পা দেওয়ার পরদিনই আসে দুঃসংবাদ। চোটের কারণে দলের বাইরে তিনি। এমনকী ইংল্যান্ডে এসে ওয়ার্নারও ঘোষণা দিয়েছেন লাল বলে নিজের ক্যারিয়ারের ইতি টানার। সবমিলিয়ে অস্ট্রেলিয়ান শিবিরেও আছে চিন্তার ঘনঘটা।
তবে এই ফাইনাল সামনে রেখেই কোটি টাকার এক চুক্তি করেছে ভারত। অ্যাডিডাসকে নিজেদের জার্সি স্পনসর হিসেবে দলে ভিড়িয়েছে তারা। ফলে আগামী তিন বছর রিয়াল মাদ্রিদ, বায়ার্ন মিউনিখ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো বড় বড় দলের জার্সির মতো ভারতের জার্সিও তৈরি করবে অ্যাডিডাস। ক্রিকেটের সঙ্গে এমন স্পোর্টস কোম্পানির এত বড় চুক্তি দেখা যায়নি আগে। অ্যাডিডাসের নতুন জার্সি শুধু ভারতের জার্সির চেহারা পাল্টে দেবে না, পাল্টে দেবে ভবিষ্যৎ ক্রিকেটের চিত্র।
তবে ফেরা যাক টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে। ওভালের পিচ উন্মুক্ত হয়েছে দিন দুই আগেই। মাঠের সঙ্গে পিচের পার্থক্য করা দুষ্করই বটে। পুরোপুরি সবুজ পিচে খেলা। বোঝাই যাচ্ছে, আগেরবারের মতো কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছে না আইসিসি। যদিও এক দিন রিজার্ভ ডে রয়েছে। চাইলে পাঁচ দিনের টেস্ট যেতে পারে ষষ্ঠ দিনেও। কিন্তু ফল আসা চাই। সে কারণেই হয়তো সবুজ পিচে হচ্ছে এবারের ফাইনাল।
প্রায় ৮ বছর পর টস জিতে বোলিং-এর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। ঋষভ পন্ত, কে এল রাহুল, অশ্বিন ছাড়া সবুজ পিচে কতটা সুবিধা করতে পারবে ভারত, সে উত্তর দিবে সময়ই। তবে চতুর্থ ইনিংসে যারাই ব্যাট করতে যাচ্ছে, তাদের জন্য সময়টা বেশ কষ্টকরই হবে।
বিনোদনজগতে খুব জনপ্রিয় একটা বাণী আছে—দ্য শো মাস্ট গো অন। ভারত আর অস্ট্রেলিয়ার জন্যও বাণীটি সত্য। যতই নিজেদের সেরা খেলোয়াড় মাঠের বাইরে থাকুক না কেন, লড়াই হবে সমানে সমান। সেখানে বাধাবিপত্তি পেরিয়ে মাঠে নামতে হবে, শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে দেখতে হবে, কে পারে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে। কে পরতে পারে সেরার মুকুট। নিউজিল্যান্ডের পর টেস্ট চ্যাম্পিয়ন হয় কে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।