কিউই বোলিং লাইপআপে ‘স্পিনার’ একটি রহস্যময় জায়গা। নিউজিল্যান্ড দলে তিন পেসার যেভাবে নিজেদের জায়গা পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন, স্পিনারদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। প্রায়ই এখানে চলে মিউজিক্যাল চেয়ারের খেলা। এক মিচেল স্যান্টনার তবু নিজেকে একটু থিতু করেছেন। কিন্তু হরহামেশাই তাঁকেও বসতে হয় সেই মিউজিক্যাল চেয়ারে। সে রকমই এক মিউজিক্যাল চেয়ার দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল রাচিন রবীন্দ্র।
২০২১ সালের ভারত সফরে কিউইদের প্রয়োজন ছিল একজন অতিরিক্ত স্পিনার। যিনি ব্যাটিংও ভালো পারেন। স্যান্টনার আর ব্রেসওয়েলের অনুপস্থিতিতে ভারতের মাটিতে অভিষেকটাও হয়ে যায় রাচিন রবীন্দ্রর। টেস্ট ফরম্যাটে মাত্র তিনটি ম্যাচই খেলার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। উপমহাদেশের মাটি থেকে কিউইরা উড়াল দেওয়া মাত্রই শেষ হলো তাঁর ম্যাচ খেলার সম্ভাবনা। নিউজিল্যান্ডের জার্সিতে মাঠে নামতে তাঁর লেগেছে আরও দেড় বছর। স্যান্টনার-ব্রেসওয়েলের চোটে আবারও ভাগ্যের চাকা খোলে রবীন্দ্রর। সেটাকে কাজে লাগাতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি।
বড় ফরম্যাটে যা করতে পারেননি, ছোট ফরম্যাটে সেটাই করেছেন বাঁহাতি অলরাউন্ডার। প্রথম ম্যাচেই বাজিমাত। ৭ নম্বরে নেমে ৪৯ রানের একটা ইনিংস খেলে ব্যাট হাতে নিজের সামর্থ্যের জানান দিলেন। কিন্তু এক ম্যাচেই তো সব প্রমাণ হয়ে যায় না। ভারত বিশ্বকাপের আগে কিউইদের দরকার ছিল একজন জাত স্পিনার, আর সেই খোঁজই তারা চালিয়ে যাচ্ছিল রবীন্দ্রর মাঝে। রবীন্দ্রও সেই পরীক্ষায় উতরে গিয়েছেন সহজেই। ৯ ইনিংসে ১২ উইকেট নিয়ে বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাকাপোক্ত করেছেন আগে। যদিও ব্রেসওয়েলের চোট তাঁর দলে জায়গা পাওয়াতে বড় ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু ব্যাটিং যাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে, তাঁকে কি চাইলেই ব্যাটিং থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়?
বাবা রবীন্দ্র কৃষ্ণমূর্তি ছিলেন ক্রিকেটের বিশাল ভক্ত। প্রত্যেক ভারতীয় ক্রিকেটারের মতো তাঁর ক্রিকেটপ্রেমও শুরু হয়েছিল সেই ছোটবেলা থেকে। বেঙ্গালুরুর রাজ্য পর্যায় পর্যন্ত খেলেছেন তিনি। কিন্তু বয়সের সঙ্গে বাড়তে থাকে দায়িত্ব, তাই তো জীবিকার প্রয়োজনে ক্রিকেটকে আর পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়নি তাঁর। মনোযোগ দিলেন পড়াশোনায়, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে পাড়ি জমালেন নিউজিল্যান্ডে। মনে মনে একটা ইচ্ছা তো ছিলই, নিজের স্বপ্ন নিজের সন্তানদের দিয়ে পূরণ করানোর। মেয়েকে ক্রিকেটার বানাতে চেয়েছিলেন, তাতে বিন্দুমাত্র সায় ছিল না মেয়ের। কিন্তু ছেলেকে ক্রিকেটার বানাতে কোনো পরিশ্রম করতে হয়নি তাঁর। নিজ থেকেই ক্রিকেটে পা রেখেছেন রাচিন।
বাবা রবীন্দ্র কৃষ্ণমূর্তি সন্তানের নাম রেখেছেন ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা দুই ব্যাটসম্যানের নাম থেকে। রাহুল দ্রাবিড়ের ‘রা’ আর শচীন টেন্ডুলারের ‘চিন’, দুই মিলে ছেলের নাম রেখেছেন রাচিন। আর সেই খেলোয়াড় ক্রিকেটে পা রাখবে, এটাই তো স্বাভাবিক। মাত্র ১৬ বছর বয়সে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছেন রাচিন, ২০ বছর বয়সে কিউই দলে অভিষেক। ড্যানিয়েল ভেট্টোরির মতো বাঁহাতি স্পিন আর শেষ দিকে নেমে ঝোড়ো ইনিংস খেলতে পারেন—এটুকুই যথেষ্ট ছিল কিউই ম্যানেজমেন্টের জন্য। কিন্তু রাচিন সেখানে থেমে থাকার পাত্র নন।
অধিনায়ক কেইন উইলিয়ামসনের মাথায় ছিল অন্য চিন্তা। যে কারণেই বিশ্বকাপের আগে আগে দুটি প্রস্তুতি ম্যাচে একটা বাজি লাগালেন। ভারতের পিচে, ভারতীয় খেলোয়াড়কে দিয়ে ইনিংস শুরু করলে কেমন হয়? বল হাতে নয়। ব্যাট হাতে। প্রস্তুতি ম্যাচের ওপেনিংয়ের দায়িত্ব তুলে দিলেন রবীন্দ্রর কাঁধে। সুযোগের সদ্ব্যববহার যাকে বলে, সেটার উদাহরণ স্থাপন করলেন তিনি। পাকিস্তানের বিপক্ষে ৭২ বলে ৯৭ করে জানিয়ে দিলেন, সুযোগ পেলে ব্যাট হাতেও রাচিন রবীন্দ্র নামটা কতটা ভয়ংকর। তাই তো ইংলিশদের বিপক্ষে একটা বাজি ধরেই ফেললেন কেইন উইলিয়ামসনের পরিবর্তে অধিনায়কত্ব করা টম ল্যাথাম।
নিয়মিত অধিনায়ক কেইন উইলিয়ামসনের অনুপস্থিতিতে কাউকে না কাউকে ওপরে উঠতেই হতো। ল্যাথাম বাজি রাখলেন ২৩ বছর বয়সী রাচিন রবীন্দ্রের ওপর। উইল ইয়াংয়ের উইকেট পতনের পরই মাঠে নামলেন রাচিন। বাকিটা সময় বিশ্বজয়ী ইংল্যান্ড দল শুধু মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখেই গেল তাঁকে। কী ছিল না তাঁর ব্যাটে? মার্ক উডের ১৪৯ কিলোমিটার গতির বল আছড়ে পড়ল গ্যালারিতে। ওকসের স্লোয়ার ডেলিভারিটা মাথার ওপর দিয়ে পাঠালেন গ্যালারিতে। স্যাম কারেন, মঈন আলী, আদিল রশিদ; কেউই বাকি ছিলেন না রাচিনের শিকার হতে।
পরপর দুই বিশ্বকাপ ফাইনাল হারতে দেখেছেন টিভি পর্দায়। চার বছর আগের ফাইনালের ক্ষত এত সহজে ভুলে যাওয়ার কথা নয় কারও। ‘বাউন্ডারি রুল’ নামক এক অদ্ভুত নিয়মের কারণে শিরোপা রেখেই বাড়ি ফিরতে হয়েছিল কিউইদের। এবার তার ধার ধারেননি রাচিন। ১১ চার, ৫ ছক্কায় গড়া ইনিংসে ছিল না বিন্দুমাত্র খুঁত। বিশ্বকাপে সবচেয়ে কম বলে সেঞ্চুরি করা কিউই এখন এই রাচিন রবীন্দ্রই। চার বছর ধরে যে জ্বালা-যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছিল কিউইরা, তাতে যেন কিছুটা প্রলেপ দিলেন রবীন্দ্র। আহমেদাবাদের প্রায় খালি মাঠে বিশ্বকাপের প্রথম দিনটা ছিল রাচিন রবীন্দ্রের। রাচিন কি পারবেন বিশ্বকাপটা নিজের করে নিতে?