ম্যাচ শুরু হতে এখনও মিনিট পাঁচেক বাকি। এমন সময় লেস্টারের কিং পাওয়ার স্টেডিয়ামের ওপর দিয়ে উড়ে গেল একটা ব্যানার। সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘কিং পাওয়ার ক্লুলেস স্যাক দ্য বোর্ড’। ভিআইপি স্ট্যান্ড থেকে সে ব্যানার দেখছিলেন কিং পাওয়ার কোম্পানির মালিক ও লেস্টার সিটি চেয়ারম্যান আইয়াওয়াত শ্রীবর্ধনপ্রভ। লেস্টার সমর্থকদের মনের কথা যেন এক বাক্যে বুঝিয়ে দিয়েছিল ব্যানারটি।
গত তিন মৌসুমের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার অবনমনের স্বাদ পেল লেস্টার। ম্যাচের আগে থেকেই নিশ্চিত ছিল তাদের বিদায়, ট্রেন্ট অ্যালেকজেন্ডার আর্নল্ডের গোল যেন সেটাকে কাগজে-কলমে নিশ্চিত করল। তিন পয়েন্ট লিভারপুলকে নিয়ে গেল শিরোপার এক ধাপ কাছে। আর লেস্টারকে ধরিয়ে দিল চ্যাম্পিয়নশিপের টিকিট। আর অবনমন নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি দুঃসংবাদ যুক্ত হয়েছে তাদের কাঁধে। এই মৌসুম শেষে বিদায়ের নিচ্ছেন অধিনায়ক জেমি ভার্দি। তাদের রূপকথার নায়ক ইতি টানছেন ১৩ বছরের সম্পর্ক।
গত মৌসুমের লেস্টার ছিল এক শব্দে অপ্রতিরোধ্য। ৯ বছর পর চ্যাম্পিয়নশিপে অবনমিত হয়েছিল ফক্সরা। বেশি দিন থাকার ইচ্ছে ছিল না তাদের। ইতালিয়ান কোচ এনজো মারেকসার অধীনে দুর্দান্ত এক মৌসুম কাটিয়েছিল ভার্দিরা। লিগ শেষ করেছিল ৯৭ পয়েন্ট নিয়ে, দুই ম্যাচ আগে নিশ্চিত হয়েছিল শিরোপা। আক্রমণে ভার্দি-মাভিদিদি জুটি আর মাঝমাঠে এনদিদি-হামজা জুটি দলকে নিয়ে গিয়েছিল অনন্য এক উচ্চতায়। এনজো মাররেসকার দুর্দান্ত ট্যাক্টিসের কাছে ধরাশায়ী হয়েছিল চ্যাম্পিয়নশিপের বাকি দলগুলো। লেস্টারজুড়ে ট্রফি প্যারেড শেষে দুঃসংবাদ হানা দেয় লেস্টার শিবিরে। ইতালিয়ান কোচ এনজো মারেসকাকে ভেড়ানোর জন্য তোড়জোর শুরু করেছে চেলসি। কোচও মৌন সম্মতি দিয়ে দিয়েছেন। লেস্টারকে খাদের কিনারা থেকে টেনে আনা কোচ বিদায় নিলেন এক মৌসুমের মধ্যে। নতুন কোচ হিসেবে নিয়োগ পান নটিংহাম ফরেস্টের প্রাক্তন কোচ স্টিভ কুপার। যিনি প্রায় দেড় মৌসুম ধরে ছিলেন ক্লাববিহীন।
নতুন কোচ নিয়োগে বেশ অপরিপক্বতা দেখিয়েছিল লেস্টার বোর্ড। দেড় বছর ধরে কোচিং না করানো কারও হাতে দল তুলে দেওয়া ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। তার দেখা মেলে মৌসুম গড়াতে না গড়াতেই। মারেসকার অধীনে অসাধারণ ফুটবল খেলা লেস্টার খেই হারিয়ে ফেলে নতুন মৌসুমে। এমনকি লেস্টার মাঝমাঠের প্রতিশব্দ হয়ে উঠা কেইরান ডিউসবেরি-হলকে ছেড়ে দেন তিনি। সুযোগ বুঝে নিজের প্রিয় শিষ্যকে চেলসিতে ভেরান কোচ এনজো মারেসকা। স্টিভ কুপার সে জায়গাটা পূরণ করতে চেয়েছেন নতুন খেলোয়াড় দিয়ে। কিন্তু নতুন কেউ সে জায়গাটি ধরে রাখতে পারেননি। বরং নতুন মিডফিল্ডারদের আগমনে চুরমার হয়েছে পুরোনো ট্যাকটিকস।
অলিভার স্কিপের আগমনে দলে জায়গা হারিয়েছেন হামজা চৌধুরী, হ্যারি উইংকসের জায়গায় বিলাল এল খানাউস; দুটি পরিবর্তন পুরোপুরি বদলে দিয়েছে দলের মাজেজা। পুরো মৌসুমজুড়ে কোনো যুৎসই মাঝমাঠ খুঁজে পাননি তিনি। বরং প্রতি ম্যাচেই তাঁর দল খেই হারিয়েছে মাঝমাঠে এসে। মৌসুমের সপ্তম ম্যাচে এসে জয়ের দেখা পায় লেস্টার। দুই জয় আর চার ড্র নিয়ে ১২ ম্যাচে লেস্টারের পয়েন্ট ছিল মাত্র ১০। তখনই স্টিভ কুপারের সঙ্গে চুক্তি ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয় লেস্টার। নতুন কোচ হিসেবে নিয়োগ পান ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অন্তর্বর্তীকালীন কোচের দায়িত্ব পালন করা রুড ফন নিস্টলরয়। তাঁকে নিয়ে বেশ আশা দেখেছিল বোর্ড। একে তো ইউনাইটেডের হয়ে ভালো পারফরম্যান্স, সঙ্গে প্রথম দুই ম্যাচে ৪ পয়েন্ট। দুই ম্যাচে ৫ গোল করে দলের গোলস্কোরিং অ্যাবিলিটির প্রদর্শন করছিলেন যেন তিনি। কিন্তু লেস্টারের যাত্রা থেমে গিয়েছে সেখানেই। এর পর থেকে ১৮ ম্যাচে ডাগ আউটে দাড়িয়েছেন নিস্টলরয়। গোল পেয়েছেন মোট ৫টি! এর মধ্যে টানা আট ম্যাচ ছিলেন গোলশূন্য! দলের স্ট্রাইকাররা যেন বেমালুম ভুলে গিয়েছে, কীভাবে গোল করতে হয়।
এই বছরে মাত্র একটি ম্যাচে জয়ের দেখা পেয়েছে লেস্টার, সেটাও টটেনহামের বিপক্ষে। একটা ড্র এসেছে ব্রাইটনের বিপক্ষে। বাকিদের সঙ্গে ফলাফল দূরে থাক, গোলের দেখাই পায়নি ফক্সরা। ফলাফল? মৌসুমের ৫ ম্যাচ বাকি থাকতে অবনমন নিশ্চিত করল লেস্টার।
মৌসুমের শুরু থেকে স্পষ্টত দূরত্ব ছিল কোচ ও খেলোয়াড়দের মধ্যে। স্টিভ কুপারের সঙ্গে খুব একটা বনিবনা হতো না তরুণ খেলোয়াড়দের। এমনকি সিনিয়র খেলোয়াড়দের সঙ্গেও ছিল দূরত্ব। অবনমন বাঁচাতে তাই তড়িঘড়ি করে বিদায়ের ঘণ্টা বেজেছিল তাঁর। রুড ফন নিস্টলরয়ের অধীনে দলে পরিবর্তন এসেছিল বটে, খেলোয়াড়-কোচের দূরত্বও কমে এসেছিল অনেকখানি। কিন্তু পারফরম্যান্সে ছিল না তাঁর ছিটেফোঁটাও। ট্যাক্টিকস, পারফরম্যান্স, ম্যান ম্যানেজমেন্টে রুড ফন নিস্টলরয়ের অপরিপক্বতা ছিল স্পষ্ট। মৌসুম শেষে তাই তাঁর বিদায় অবশ্যম্ভাবী।
তবে সমর্থকদের কাছে কোচের বিদায়ের থেকে ফুটবলের মুখ্য পরিচালক জন রুডকিনের বিদায়। গত কয়েক মৌসুম ধরে তাঁর অপারদর্শিতা নিয়ে জোড়ালো কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে লেস্টারে। স্টিভ কুপার ও রুড ফন নিস্টলরয়, দুজনেই ছিলেন রুডকিনের পছন্দ। এ ছাড়াও লেস্টারের প্রিমিয়ার লিগজয়ী কোচ ক্লদিও রানেইরিকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তও ছিল তাঁর। ফলে তাঁর পক্ষে জনসমর্থন না থাকাটাই স্বাভাবিক। ক্লাব চেয়ারম্যান আইয়াওয়াত শ্রীবর্ধনপ্রভকে তাই নিতে হবে কঠিন সিদ্ধান্ত।
হেলিকপ্টার দূর্ঘটনায় বাবার মৃত্যুর পর ক্লাবের দায়িত্ব এখন শ্রীবর্ধনপ্রভের হাতে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বড় কোনো শিরোপা দূরে থাক, ভালো ফলাফলও এনে দিতে ব্যর্থ তিনি। পরবর্তী মৌসুমের জন্য এখনই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু না করলে হয়তো প্রিমিয়ার লিগে ফেরা কঠিন হয়ে যাবে ফক্সদের জন্য।