আইপিএলের ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’ পদ্ধতি ভালো না খারাপ
‘বদলি’ শব্দটা খেলাধুলার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফুটবলে তো খেলোয়াড় বদলি করা কৌশলের অংশ। হকি, বাস্কেটবল থেকে হ্যান্ডবল—দলীয় যেকোনো খেলায় দেখা যায় বদলি খেলোয়াড়ের নিয়ম। ব্যতিক্রম শুধু ক্রিকেট। প্রায় ১৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও ক্রিকেট চলছে আপন গতিতে, কোনো বদলি খেলোয়াড়ের নিয়ম ছাড়াই।
ক্রিকেটে যে বদলি খেলোয়াড়ের নিয়ম একেবারে নেই, তেমনটা কিন্তু নয়। তবে নিয়মটা এসেছে একটু ভিন্নভাবে। প্রথমবার ক্রিকেটে বদলির ঘটনা ঘটে ১৮৮৪ সালে। একজন ফিল্ডারের চোটের কারণে বদলি হিসেবে মাঠে নামেন আরেকজন খেলোয়াড়। আস্তে আস্তে ক্রিকেটে প্রবেশ করে ‘দ্বাদশ খেলোয়াড়’-এর নিয়ম। একাদশের কোনো খেলোয়াড় চোটে পড়লে ফিল্ডার হিসেবে দ্বাদশ খেলোয়াড়কে বেঞ্চ থেকে তুলে আনতে পারত দলগুলো। কিন্তু ক্রিকেটে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে কাজ, ব্যাটিং ও বোলিং; কোনোটাই করতে পারতেন না এই দ্বাদশ খেলোয়াড়।
২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো কনকাশন বদলির নিয়ম চালু করে আইসিসি। ‘কনকাশন বদলি’ হতে পারবে তখনই, যখন ম্যাচ চলাকালীন সময়ে কোনো খেলোয়াড় মাথায় কিংবা ঘাড়ে চোট পান। তবে ‘কনকাশন বদলি’ হতে হবে ‘লাইক ফর লাইক’। অর্থাৎ একজন ব্যাটসম্যানের পরিবর্তে ব্যাটসম্যান, বোলারের পরিবর্তে বোলার, অলরাউন্ডারের পরিবর্তে অলরাউন্ডার নামতে পারবেন।
কিন্তু আইপিএলে ইমপ্যাক্ট খেলোয়াড়ের নিয়ম বদলে দিয়েছে ক্রিকেটের বাকি সব বদলির সংজ্ঞা। একজন বদলি খেলোয়াড় এখন শুধু ফিল্ডিং নয়, ব্যাটিং-বোলিং এমনকি উইকেট-কিপিংও করতে পারেন। এক কথায় বলতে পারো পুরোপুরি বদলি। ম্যাচের যেকোনো সময় যে কোনো অবস্থায় যে কোনো খেলোয়াড়কে বদলি করতে পারবে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো। বাকি সব খেলার মতোই খেলোয়াড় বদলির নিয়ম এখানে।
ক্রিকেটে এমন খেলোয়াড়ের বদলে খেলোয়াড় নামানোর নিয়ম অবশ্য নতুন নয়। ২০০৫ সালে ‘সুপার সাব’ নিয়ম চালু করেছিল আইসিসি। আইপিএলের ইমপ্যাক্ট খেলোয়াড়ের মতোই ছিল ‘সুপার সাব’-এর নিয়ম। কিন্তু ক্রিকেটে খুব বেশিদিন টিকতে পারেনি সেটা। খেলোয়াড়দের সমালোচনায় এক বছরের মধ্যেই ‘সুপার সাব’ পদ্ধতি থেকে সরে যায় আইসিসি। আইসিসি থামলেও থামেনি আইপিএল। ২০২৩ সালের আইপিএলে প্রথমবারের মতো চালু করা হয় ইমপ্যাক্ট খেলোয়াড়ের নিয়ম। প্রথম মৌসুমের ‘সাফল্য’-এর পর দ্বিতীয় মৌসুমেও চলছে ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’ নিয়মের জয়গান।
প্রথম মৌসুমে ফ্র্যান্সাইজিগুলোর মানতে একটু কষ্ট হলেও যতই সময় গিয়েছে, নিয়মের পূর্ণ ব্যবহার করেছে দলগুলো। আইপিএল ইতিহাসের প্রথম ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার ছিলেন তুষার দেশপান্ডে। নিজের যোগ্যতা দিয়ে দ্রুতই চেন্নাই সুপার কিংসের তুরুপের তাস হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কলকাতার ভেঙ্কটেশ আইয়ার, রাজস্থানের ধ্রুব জুরেল; গত মৌসুমে আইপিএলে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসেবেই জ্বলে উঠেছিলেন তাঁরা। যার প্রতিদান পেয়েছেন এই মৌসুমে। ইমপ্যাক্ট খেলোয়াড় থেকে নিয়মিত একাদশের অংশ তাঁরা।
দ্বিতীয় মৌসুমে এসে ইমপ্যাক্ট খেলোয়াড়ের প্রভাব আরও স্পষ্ট। এই মৌসুমে ইমপ্যাক্ট খেলোয়াড় দিয়ে চমকে দিয়েছে রাজস্থান রয়্যালস। ৮ ম্যাচের ৭টিতে জয় নিয়ে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে অবস্থান করছে রাজস্থান। কম–বেশি প্রতিটি ম্যাচেই তাদের ইম্প্যাক্ট খেলোয়াড় বদলে দিয়েছে খেলার মোড়। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর বিপক্ষে ইমপ্যাক্ট খেলোয়াড় জস বাটলার জয় এনে দিয়েছেন অসাধারণ এক সেঞ্চুরি করে। মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বিপক্ষে তিনজন বিদেশি খেলোয়াড় নিয়ে বেঞ্চে প্রস্তুত রেখেছিলেন নান্দ্রে বার্গার ও রভম্যান পাওয়েলকে। ম্যাচের অবস্থা বুঝে বার্গারকে দলে টেনে কঠিন ম্যাচ সহজে বের করে নিয়েছিল রাজস্থান।
যতই দিন গড়াচ্ছে, ইমপ্যাক্ট খেলোয়াড় হয়ে উঠছে দলের পরিকল্পনার অংশ। দলগুলো ম্যাচে নিজেদের অবস্থান, পিচের অবস্থা এমনকি প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা থেকে নিয়মিত পরিবর্তন আনতে পারছে দলে। শুধু তাই নয়, ইমপ্যাক্ট খেলোয়াড় নতুন করে সুযোগ করে দিচ্ছে নতুন খেলোয়াড়দের। আইপিএলের মতো বড় মঞ্চে, যেখানে প্রতিটি ম্যাচের ওপরেই নির্ভর করছে ভাগ্য। সেখানে তরুণ খেলোয়াড়দের ওপর শুধু ভালো খেলার চাপ নয়, দলে জায়গা পাওয়া যেমন কঠিন, তেমনই সেই জায়গাটা ধরে রাখা আরও কঠিন। ইমপ্যাক্ট খেলোয়াড়ের নিয়ম থাকার ফলে তরুণ খেলোয়াড়েরা যেমন বেশি সুযোগ পাচ্ছেন, তেমনই ভালো পারফরম্যান্স দিয়ে একাদশে নিজের জায়গাও করে নিতে পারছেন।
ইমপ্যাক্ট খেলোয়াড়ের জয়গান যেমন আছে, তেমন সমালোচনাও আছে বইকি। সবচেয়ে বড় সমালোচনাটা এসেছে ভারতের বর্তমান অধিনায়ক রোহিত শর্মার কাছ থেকে। এক পডকাস্টে সরাসরি ইমপ্যাক্ট খেলোয়াড় নিয়মের সমালোচনা করেছেন তিনি। রোহিতের মতে, ‘ইমপ্যাক্ট খেলোয়াড় নিয়মের পক্ষপাতী নই আমি। ক্রিকেট ১১ জনের খেলা, ১২ জনের না। এই নিয়ম ন্যাচারাল অলরাউন্ডারদের অনেক ক্ষতি করছে।’ রোহিত শর্মার সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন মোহাম্মদ সিরাজ ও মুকেশ কুমারও। শুধু রোহিত শর্মা নন, বিসিসিআইও খুব একটা খুশি নয় এই নিয়মের ব্যাপারে। আইপিএল চেয়ারম্যান পর্যন্ত এই নিয়ম নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তার কথা বলেছেন। কারণ, আইপিএল হয়তো নিজস্ব নিয়মে চলে, কিন্তু দিনশেষে খেলোয়াড়দের ফিরতে হবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। তখন মানিয়ে নেওয়া কষ্টকরই হবে বাকি খেলোয়াড়দের জন্য। বিশেষ করে ভারতের জন্য, যারা আইপিএল সৃষ্টির পর থেকে এখনো একটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতার অপেক্ষায়।
ইমপ্যাক্ট খেলোয়াড়ের নিয়ম কতটুকু ভালো কিংবা খারাপ, সে প্রশ্নের উত্তর তোলা থাকুক এক্সপার্টদের জন্য। কিন্তু ইমপ্যাক্ট খেলোয়াড়ের নিয়ম যে আইপিএলের আনন্দ বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে, সেটা স্পষ্ট। দেখা যাক কত দিন এই নিয়ম টিকে থাকে, নাকি হারিয়ে যায় কালের গহ্বরে।