জমে উঠেছে বিশ্বকাপ। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে পয়েন্ট টেবিলের দলগুলোর মধ্যে। প্রতি ম্যাচেই রোমাঞ্চ, কে কাকে ঠেলে ওপরে উঠিয়ে দেয়। শুনে হয়তো খটকা লাগতে পারে। আরে, পয়েন্ট টেবিলে লড়াই হবে ওপরে ওঠার। নিচে নামার জন্য আবার কে প্রতিযোগিতা করে? ২০২৩ বিশ্বকাপ সবার সামনে সুযোগ করে দিয়েছে এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা দেখার, প্রতি ম্যাচে প্রতিযোগিতা হচ্ছে, কে কত নিচে নামতে পারে!
গ্রুপ পর্বের অর্ধেক ম্যাচ শেষে সেমিফাইনালের টিকিট কারা পেতে যাচ্ছে, তা নিয়ে একটা ধারণা কমবেশি সবারই হয়ে গেছে। পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষ চার নিয়ে তাই আগ্রহী ভক্তকুলের সংখ্যাও বেশ কম। বরং সবাই কড়া নজর রাখছে পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে! ১০ নম্বর পজিশনের জন্য এমন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষ কবে দেখা গিয়েছিল, কে জানে! ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে চলছে বাংলার টাইগার আর ইংলিশ লায়নদের লড়াই। শেষ হওয়ার লড়াই!
শক্তিমত্তা বা সাফল্য—দুই দলের পার্থক্য যোজন যোজন। একদিকে বিশ্বজয়ী ইংল্যান্ড দল, অন্যদিকে আশায় বুক বাঁধা বাংলাদেশ। ভারতে প্রবেশ করার আগে দুই দলই ভেসেছিল বিশ্বজয়ের স্বপ্নে। কিন্তু বিশ্বমঞ্চে পা রাখতে না-রাখতেই শুরু হয় পা হড়কানো।
ভারত বিশ্বকাপের সূচনা হয়েছিল গত বিশ্বকাপের দুই ফাইনালিস্টকে দিয়ে। ফাইনালের পুনরাবৃত্তি হয়নি, বরং শুরুর দিনই ইংল্যান্ডকে উড়িয়ে দিয়ে উড়ন্ত সূচনা হয় নিউজিল্যান্ডের। হোঁচট খেয়ে যাত্রা শুরু হয় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের।
বাংলাদেশ অবশ্য সেদিক দিয়ে একটু ভাগ্যবানই বটে। বিশ্বকাপের সূচনা হয়েছিল সহজ প্রতিপক্ষ আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। যদিও সাম্প্রতিক ফর্ম দেখে ‘সহজ’ প্রতিপক্ষ কথাটা খুব একটা খাটে না। তবু বড় মঞ্চে জয় দিয়েই শুরু হয়েছিল টাইগারদের। দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল একে অপরের বিপক্ষে। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে রানের পাহাড় গড়ে ইংল্যান্ড। সে রানের পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে শুরুর আগেই ম্যাচ হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডের বিশাল জয় ভুলিয়ে দেয় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের পরাজয়।
সেই শেষ। বিশ্বকাপের মাটিতে ওই একটি জয়ের গল্পই লেগে আছে তাদের নামের পাশে। এরপর আরও আট ম্যাচ খেলে ফেললেও জয়ের মুখ দেখতে পারেনি কেউই। বরং তাদের পরাজয় উল্টো লজ্জায় ফেলেছে খেলোয়াড় থেকে শুরু করে খোদ সমর্থকদের। নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে ইংল্যান্ড নতি স্বীকার করেছে আফগানিস্তানের আছে। যে আফগানিস্তান ধুঁকে ধুঁকে মরছিল বিশ্বকাপে, সেই আফগানিস্তানই ইংল্যান্ডকে সামনে পেয়ে হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। ফলাফল? বিশ্বকাপ ইতিহাসে নিজেদের দ্বিতীয় জয় তুলে নেয় আফগানিস্তান। সেটাও বিশ্বজয়ী ইংলিশদের বিপক্ষে।
পয়েন্ট টেবিলে তখনো বাংলাদেশ আর ইংল্যান্ড সম্মানজনক একটা অবস্থানেই ছিল। বিপত্তিটা বাধায় দক্ষিণ আফ্রিকা। কে ভেবেছিল নেদারল্যান্ডসের মতো দলের বিপক্ষে হেরে বসবে তারা? ২৪৫ রান তাড়া করতে গিয়ে গুটিয়ে যায় ২০৭ রানে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এক জয় দিয়ে বাংলাদেশ-ইংল্যান্ডকে কাটিয়ে পয়েন্ট টেবিলের অষ্টম অবস্থানে উঠে যায় ডাচরা। আর শুরু হয় বাংলাদেশ-ইংল্যান্ডের ইঁদুর-বিড়াল খেলা।
ভারতের বিপক্ষে হেরে দশম পজিশনে অবনমিত হয় বাংলাদেশ। বাংলার বাঘদের এমন দুর্দিন যেন সহ্য হচ্ছিল না ইংলিশ সিংহত্রয়ীর! তাই তো দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২২২ রানের বিশাল ব্যবধানে হেরে বাংলাদেশকে আবারও নবম অবস্থানে তুলে দেয় ইংল্যান্ড। বাংলাদেশও কম যায় না, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হেরে আবারও নেমে আসে দশম অবস্থানে। জনদরদি ইংল্যান্ড দল এবার হেরে বসে শ্রীলঙ্কার কাছে। লক্ষ্য? যেভাবেই হোক বাংলাদেশকে তো ওপরে রাখতে হবে!
বাংলার টাইগাররাও কি কম যায়? ক্রিকেটের গুরুজন বলে কথা। তাই তো নেদারল্যান্ডসের মতো দলের কাছে হেরে ইংল্যান্ডকে আবারও তুলে দেয় নবম অবস্থানে। যত কিছুই হোক, জুনিয়র বলে কথা। যতই পায়ে পড়ুক না কেন, দিন শেষে তাদের অবস্থান তো বুকেই। তাই স্বাগতিক ভারতের কাছে ১০০ রানে হেরে আবারও বাংলাদেশকে নবম অবস্থানে তুলে ধরেছে ইংল্যান্ড।
৬ ম্যাচ শেষে দুই দলের পয়েন্টসংখ্যা ২। মাইনাস ১.৩৩৮ রানরেট নিয়ে নবম অবস্থানে বাংলাদেশ। আর মাইনাস ১.৬৫২ রানরেট নিয়ে তলানিতে ইংল্যান্ড। এখন প্রশ্ন করতেই পারো, এই ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলবে কত দিন? আর শেষমেশ এই খেলার ‘বিজয়ী’ই-বা হবে কে?
দুই দলেরই খেলা বাকি তিনটি করে। বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়া। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস ও পাকিস্তান। ফর্মের হিসাব করলে বাকি তিন দলের সামনে দু দলের কেউ যে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে, তেমনটা মনে হচ্ছে না! তবে বিশ্বকাপের পয়েন্ট টেবিল থেকেই নির্ণয় হবে, কারা পাবে ২০২৫ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির টিকিট। শীর্ষ সাত দল আর স্বাগতিক পাকিস্তানকে নিয়ে পাকিস্তানে বসবে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির নতুন আসর। শেষ মুহূর্তে তাই দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে দুই দলেরই। পাকিস্তানের টিকিট পেতে চাইলে দুই দলকেই জিততে হবে বিশ্বকাপের বাকি ম্যাচগুলো। আহত বাঘ কিংবা সিংহ—দুটোই কোণঠাসা হলে হয়ে উঠতে পারে ভয়ানক।
আপাতদৃষ্টে বাংলাদেশের তুলনায় ইংল্যান্ডের প্রতিপক্ষ তুলনামূলক সহজ। বাকি তিন ম্যাচে দুই দলেরই আছে দুজন 'কমন' প্রতিপক্ষ; অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তান। অস্ট্রেলিয়া যে ফর্মে আছে, তাতে তাদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চিন্তা করাও যেন পাপ। পাকিস্তান বরাবরই 'আনপ্রেডিক্টেবল', সে ম্যাচের কলকাঠি ঘুরতে পারে যে কারও দিকে। এশিয়ার দেশ হিসেবে পাকিস্তানের বিপক্ষে একটু হলেও বাড়তি সুবিধা আছে বাংলাদেশের। এশিয়ার মাটিতে বরাবরই দুর্বল ইংল্যান্ডের সেই সুযোগটাও নেই। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচ বরাবরই জমজমাট হয়, ভারতীয় পিচের সুবিধা নিতে পারলে তাদের হারানো কঠিন কিছু না। অন্যদিকে নেদারল্যান্ডস যে ফর্মে আছে, বিশ্বজয়ী ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিলেও কেউ অবাক হবে না!
বোঝাই যাচ্ছে, বিশ্বকাপের শীর্ষ চারে ওঠার লড়াইয়ে যতটা না রোমাঞ্চ, তার থেকে বহু গুণ বেশি রোমাঞ্চ চলছে টেবিলের তলানিতে। হতাশা ভুলে একটু রিল্যাক্স হয়ে খেলা দেখতে বসো, দেখবে হার নিশ্চিত ম্যাচেও দেখা মিলছে বিমল আনন্দের। বিশ্বকাপ সেমির আশা ফুরিয়ে এর থেকে বেশি আর কী-ইবা বলার আছে বাংলাদেশি সমর্থকদের।