‘বাটারফ্লাই ইফেক্ট’
পদার্থবিজ্ঞানের বিখ্যাত ক্যাওস থিওরির ওপর প্রতিষ্ঠিত থিওরির মূল প্রতিপাদ্য খুবই সাধারণ। পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে ঘটা এক নগণ্য ঘটনা পৃথিবীর ঠিক উল্টো প্রান্তে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়ে ফেলতে সক্ষম। ১৯৭২ সালে গণিতবিদ এডওয়ার্ড নরটন যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, কীভাবে আমাজন জঙ্গলের একটি প্রজাপতির ডানা ঝাপটানো জাপানে একটি টাইফুনের কারণ হতে পারে। প্রশ্ন করতে পারো, খেলার পাতায় এসে পদার্থবিজ্ঞানের জটিল থিওরি নিয়ে কথা বলছি কেন? কারণ, আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে ৩৬ বছরের খরা কাটিয়ে বিশ্বকাপের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন আর্জেন্টাইনরা। আর তার সূত্রপাত হয়েছিল একটা ‘বাটারফ্লাই ইফেক্ট’ দিয়েই। ফ্রেঞ্চ ফুটবলার নিল মউপের করা এক ফাউল থেকে।
ঘটনার সূত্রপাত ২০২০ সালের ২০ জুন। ব্রাইটনের ফ্যালমার স্টেডিয়ামে মুখোমুখি আর্সেনাল আর ব্রাইটন। করোনা–পরবর্তী ফুটবল, মাঠে নেই কোনো দর্শক, পিনপতন নীরবতার মধ্যেই চলছে ম্যাচ। আচমকা বল থামাতে গিয়ে ব্রাইটন স্ট্রাইকার নিল মউপের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হলেন আর্সেনাল গোলরক্ষক ব্র্যান্ড লেনো। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন লেনো। মিনিট পাঁচেক সেবা-শুশ্রূষা করার পর বোঝা গেল, এই ম্যাচে তাঁকে আর পাওয়া সম্ভব নয়। বেঞ্চ থেকে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিতে লাগলেন বদলি গোলরক্ষক। নাম তাঁর এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। বাটারফ্লাই ইফেক্টের সূচনা এখান থেকেই।
এই ম্যাচের আগপর্যন্ত এমিলিয়ানো মার্তিনেজ নামটা আর্সেনাল ড্রেসিংরুমে ছিল অতিথির মতোই। ২০১২ সাল থেকে আর্সেনালে আছেন এই গোলরক্ষক। কিন্তু এক মৌসুমে দুবারের বেশি আর্সেনালের জার্সি পরার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর। হয় বেঞ্চে থেকে অন্য গোলরক্ষকদের কারিকুরি দেখেছেন, নইলে ধারে খেলতে গিয়েছেন ইংলিশ লিগের অন্য কোনো দলে। আর্সেনালের জার্সিতে প্রিমিয়ার লিগ খেলার স্বপ্নটা অধরাই ছিল মার্তিনেজের জন্য।
সবটা বদলে গেল নিল মউপের সৌজন্যে। লেনোর দুই মাসের চোট খুলে দিল মার্তিনেজের ভাগ্য। গোলবারের নিচে আর্সেনালের ভরসা হয়ে উঠলেন এমি। একের পর এক চোখধাঁধানো পারফরম্যান্স দিয়ে চোখের মণি হয়ে উঠলেন আর্সেনাল সমর্থকদের। বিশেষ করে চেলসির বিপক্ষে এফএ কাপের ফাইনালের পারফরম্যান্স নতুন করে চেনাতে শুরু করে মার্তিনেজকে। অসাধারণ এক মৌসুম কাটানোর পর আশা ছিল মার্তিনেজকে দলের প্রধান গোলরক্ষক হিসেবে সুযোগ দেবে আর্সেনাল। কিন্তু সে সুযোগ না পাওয়ায় আর্সেনাল ছেড়ে অ্যাস্টন ভিলায় যোগ দেন এমি। দুর্দান্ত ফর্ম চলতে থাকে অ্যাস্টন ভিলার জার্সিতেও।
২০২১ কোপা আমেরিকার ঠিক আগে জাতীয় দলে ডাক পান এমি মার্তিনেজ। সার্জিও রোমেরোর বিদায়ের পর আর্জেন্টিনার গোলবার নিয়ে প্রচুর কাটাছেঁড়া হয়েছে। শেষমেশ ফ্রাঙ্কো আরমানিতে কিছুটা ভরসা পেয়েছেন লিওনেল স্কালোনি। কোপা আমেরিকার ঠিক আগে আগে সেই আরমানিও ছিটকে গেলেন। করোনা পজিটিভ হওয়ায় তাঁকে ছাড়াই দল ঠিক করতে হয় স্কালোনিকে। কপালের জোরে আর্জেন্টিনার গোলবারের দায়িত্ব পড়ল মার্তিনেজের কাঁধে। এরপর মার্তিনেজ যা করলেন, তা নিয়ে একটা উপন্যাস রচনা করলেও যেন কম হয়ে যাবে। চিলির বিপক্ষে পেনাল্টি সেভ। সেমিফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে টাইব্রেকারে একটি নয়, দুইটি নয়, তিনটি শট সেভ করেন এমি। আর্জেন্টিনাকে একা হাতে নিয়ে চলেন ফাইনালে। টাইব্রেকারে দাঁতে দাঁত কামড়ে শুধু নিজের গোলবারই রক্ষা করেননি; বরং প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলে তাদের স্বাভাবিক খেলাটাও ভন্ডুল করে দেন তিনি। তাই তো আর্জেন্টিনার কাছে যেভাবে মার্তিনেজ বনে গিয়েছেন নায়ক। আদর করে যাকে সবাই ডাকে ‘বাজপাখি’! আর অন্যদিকে বাইরের বিশ্বের কাছে আস্তে আস্তে পরিণত হয়েছেন ভিলেনে।
তাতে অবশ্য আরও থোড়াই কেয়ার। ফাইনালে দেখা মিলল সেই মার্তিনেজের, প্রতিপক্ষের মনে ভীতি জাগানো এমিলিয়ানো মার্তিনেজের। যাঁর সামনে স্বাগতিক ব্রাজিলও তুচ্ছ। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের মাটি থেকে কোপা আমেরিকা ছিনিয়ে আনল আর্জেন্টিনা। ২৮ বছরের শিরোপা–খরা কাটিয়ে অবশেষে শিরোপার দেখা পেল আর্জেন্টিনাবাসী। লিওনেল মেসির অপেক্ষার পালা ফুরাল। আর সেটাও মার্তিনেজের হাত ধরেই। তবে আর্জেন্টিনার লক্ষ্যটা আরও বড়, মেসি-মার্তিনেজ-মারিয়া থেকে শুরু করে আর্জেন্টিনার প্রতিটি মানুষের নজর সেই স্বর্ণালি ট্রফিটার দিকেই। প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যে বসছে বিশ্বকাপ, নিয়মিত শিডিউল ভেঙে শীতকালীন বিশ্বকাপ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কম ছিল না। তাতে নজর দেওয়ার সময় কোথায় আর্জেন্টাইনদের? তাঁদের লক্ষ্য বিশ্বকাপ নিয়ে ঘরে ফেরা।
বিশ্বকাপের শুরুটা হলো হোঁচট খেয়ে। টানা ৩৫ ম্যাচ অপরাজিত থাকার পর সৌদি আরবের কাছে হেরে শুরু হলো বিশ্বকাপ মৌসুম। গোলবারের নিচে ‘বাজপাখি’ মার্তিনেজ হুট করেই কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। সবাই যখন আর্জেন্টিনাকে ফেবারিটের তালিকা থেকে মুছে ফেলতে উদ্যত, তখনই স্বরূপে ফিরে এল আর্জেন্টিনা। একের পর এক অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স দিয়ে খাদের কিনারা থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে চলে গেল দলটি। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সে ম্যাচ গড়াল টাইব্রেকারে। আর টাইব্রেকার মানেই সেই পুরোনো মার্তিনেজ। প্রতিপক্ষকে তাতিয়ে শুধু নিজের আত্মবিশ্বাসই ফেরত আনেন না, প্রতিপক্ষের মনোবলও গুঁড়িয়ে দেন মুহূর্তেই। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও তাঁর ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। ভার্জিল ফন ডাইক আর স্টিভেন বারগুইসের প্রথম দুই শট থামিয়ে ম্যাচ নিজের করে নেন মার্তিনেজ। বাকি কাজটা সামলে নিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়েরা।
সেমিফাইনাল পার করে আবারও ফাইনালে আর্জেন্টিনা। আট বছর আগে এই ফাইনালে এসেই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল তাদের। হাতছোঁয়া দূরত্বে থাকা শিরোপা ছুঁয়ে দেখতে পারেনি আর্জেন্টিনা। এমি মার্তিনেজ সেই দৃশ্য দেখেছিলেন নিজের বাসায় বসে, টিভি পর্দার সামনে। এবার সরাসরি, গোলবার সামলানোর সবচেয়ে বড় দায়িত্বটা এখন তাঁর কাঁধে। পুরো ফ্রান্স দলকে আটকে দিলেও পরাক্রমশালী এমবাপ্পেকে আটকানোর উপায় ছিল না মার্তিনেজের কাছে। নির্ধারিত সময় শেষ হলো ২-২ গোলে। অতিরিক্ত সময়ও ৩-৩ গোলে শেষ হওয়ার পথে।
এমন সময় হুট করে ডি–বক্সের সামনে বল পেয়ে গেলেন ফ্রান্সের কোলো মুয়ানি। কোনো ডিফেন্ডার নেই আশপাশে, সামনে বাধা বলতে এক এমি মার্তিনেজ। এই তো সুযোগ নায়ক হওয়ার। ঠিকঠাক প্লেস করতে পারলে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ ফ্রান্সের দুয়ারে। আট বছর আগে এমনই এক জায়গা থেকে বল পেয়ে গিয়েছিলেন মারিও গোৎজা। সেই শট থামাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন সার্জিও রোমেরো। মুহূর্তেই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল চার কোটি আর্জেন্টাইনের। কিন্তু গল্পটা তো রোমেরোর নয়, এমি মার্তিনেজের। আড়াই বছর আগেও যিনি একটা ম্যাচের জন্য প্রার্থনা করতেন ঈশ্বরের দুয়ারে। সেই মার্তিনেজ আজ গোলবারের সামনে দাঁড়িয়ে, সাড়ে চার কোটি আর্জেন্টাইনের স্বপ্ন বুকে নিয়ে। একটু এদিক–সেদিক হলেই আবারও স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় পুড়ল কোটি আর্জেন্টাইন সমর্থক।
দুই হাত-পা ছড়িয়ে মার্তিনেজ দাঁড়িয়ে গেলেন কোলো মুয়ানির সামনে। এমির পায়ের কানায় লেগে বল ছিটকে গেল রোমেরোর মাথায়। মুহূর্তের মধ্যে বল চলে গেল ফ্রান্সের হাফে। বেজে উঠল ম্যাচ শেষের বাঁশি। নিজের ম্যাচ বাঁচানো সেভ উদ্যাপন করার বিন্দুমাত্র সুযোগ পেলেন না মার্তিনেজ, নামতে হবে অগ্নিপরীক্ষায়। বিশ্বকাপ ফাইনাল নির্ধারিত হবে টাইব্রেকারে। পুরোনো মার্তিনেজ ফিরলেন। প্রতিপক্ষকে তাতিয়ে আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেওয়ার প্রচেষ্টামাত্র। এমবাপ্পেকে ভাঙতে পারলেন না, কিন্তু চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন চুয়ামেনি আর কোমান। চুয়ামেনির শট বেরিয়ে গিয়েছিল জালের অনেকটা দূর দিয়ে। আর কোমানের শটটায় মার্তিনেজ পেতে দিয়েছিলেন নিজের বুক। জালে প্রবেশের আগেই থেমে গিয়েছিল সে শট। অতঃপর রোমেরোর শট আর ৩৬ বছর পর আবারও বিশ্বকাপের মালিক আর্জেন্টিনা! লিওনেল মেসির হাত ধরে ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব ফেরত পেল আর্জেন্টিনা। ১৮ ডিসেম্বর হয়ে রইল শত আক্ষেপ পূরণের এক রাত। পৃথিবীর প্রতিটি কোনায় বুকভরা আশা নিয়ে বেঁচে থাকা আর্জেন্টাইন সমর্থকের স্বপ্নপূরণের রাত। যে রাতের কোনো এক তারা হয়ে ম্যারাডোনাও হয়তো মুচকি মুচকি হেসেছেন।
আর এর সবটার সূচনা হয়েছিল তার ঠিক ৯১১ দিন আগে। ফ্রেঞ্চ স্ট্রাইকার নিল মউপের এক ফাউল থেকে। সেদিন নিল মউপের ফাউলে যদি লেনো উঠে না যেতেন, নতুন করে নিজেকে আর খুঁজে পাওয়া হতো না মার্তিনেজের। কোপা আমেরিকার পেনাল্টি সেভ, বিশ্বকাপ ফাইনালের শেষ মিনিটে সেভ; সবটা অধরাই থেকে যেত। কে জানে, হয়তো এখনো একটা আন্তর্জাতিক শিরোপার জন্য আফসোসে পুড়তেন লিওনেল মেসি। কে জানে, কীই–বা হতে পারত?