রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা শেষে শুরু হয়ে গেল আরেকটি বিশ্বকাপ। জমবে ব্যাটে-বলের লড়াই। শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হবে এক দল, চার বছরের জন্য তাদের সবাই বলবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু এবার কার হাতে উঠবে কাপ?
ক্রিকেট খুব কম দেশ খেলে বলে ফেবারিটদের জায়গাটা তাই সব সময় হাতে গোনা পরাশক্তিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। নিয়মিত ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের অনেকেই এই বৈশ্বিক শিরোপার স্বাদ পেয়ে গেছে। এই বিশ্বকাপে যারা খেলছে, তাদের মধ্যে অবশ্য পাঁচটি দেশের এখনো বিশ্বকাপ পাওয়া হয়নি। নিউজিল্যান্ড গতবার খুব কাছাকাছি গিয়েছিল, কিন্তু অবিশ্বাস্য এক ফাইনালের পর হেরে যায় ইংল্যান্ডের কাছে। দক্ষিণ আফ্রিকা আর বিশ্বকাপ তো সব সময় ট্র্যাজেডিরই গল্প—এত কাছে তারপরও এত দূরের আফসোস। আর বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও নেদারল্যান্ডস এখনো বিশ্বকাপ জেতার কাছাকাছি যেতে পারেনি। মজার ব্যাপার, ক্রিকেটের আঁতুড়ঘর ইংল্যান্ডই বিশ্বকাপ জিতেছে মাত্র ২০১৯ সালে।
বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড এবার আগেরবারের মতোই শক্তিশালী। সেবারের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক এউইন মরগান নেই এবার, তবে জস বাটলারের এর মধ্যেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতার রেকর্ড আছে ইংল্যান্ডের হয়ে। সাদা বলের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের সেরাদের একজন তিনি। ইংল্যান্ড দলটা বেশি চাঙা থাকবে বেন স্টোকসের ফেরায়। গত বছর ওয়ানডে থেকে অবসরের ঘোষণা দিলেও বিশ্বকাপের আগে অবসর ভেঙে ফিরে আসেন স্টোকস। আগের বিশ্বকাপের ফাইনালে জয়ের নায়ক ছিলেন, বড় ম্যাচে স্টোকস কী করতে পারেন, সেটা জানেন সবাই। ইংল্যান্ড দলটার মূল শক্তি দুর্দান্ত কিছু অলরাউন্ডার আর বিস্ফোরক সব ব্যাটসম্যান। স্টোকস তো আছেনই, সঙ্গে মঈন আলী, লিয়াম লিভিংস্টোন, স্যাম কারান, ক্রিস ওকসরা সবাই ভালো অলরাউন্ডার। আর বাটলারের সঙ্গে জনি বেয়ারস্টো, জো রুটরাও নিজেদের দিনে যে কেউ পার্থক্য গড়ে দিতে পারেন।
ফেবারিটদের দৌড়ে ইংল্যান্ডের সঙ্গে অনেকে এগিয়ে রাখছেন ভারতকে। অবাক হওয়ার কিছু নেই অবশ্য, ভারত স্বাগতিক এবং এই মুহূর্তে সম্ভবত সবচেয়ে ইনফর্ম টিম। মাত্রই শ্রীলঙ্কাকে একরকম উড়িয়ে দিয়ে এশিয়া কাপের শিরোপা জিতে এসেছে। ইতিহাস তাদের পক্ষে। কারণ, ভারতের মাঠে হওয়া সর্বশেষ বিশ্বকাপ তারাই জিতেছিল। শচীন টেন্ডুলকারের ক্যারিয়ারের একমাত্র অতৃপ্তিটা ঘুচেছিল সেবারই। সেই বিশ্বকাপের পর থেকে অবশ্য আইসিসি টুর্নামেন্টে ভারতের পারফরম্যান্স ভালো নয়। তবে কাগজে–কলমে ভারত এবার অন্যতম শক্তিশালী দল। রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিরা চাইবেন এবার দেশের হয়ে বড় কিছু করার। তবে ভারতকে আশা দেখাবে পরবর্তী টেন্ডুলকার হিসেবে বিবেচিত শুবমান গিলের অসাধারণ ফর্ম। এর সঙ্গে আছে রবীন্দ্র জাদেজা, কুলদীপ যাদবদের স্পিন। আর অবশ্যই এশিয়া কাপ ফাইনালে মোহাম্মদ সিরাজের সেই আগুনে স্পেল তো অনেকেরই মনে থাকার কথা। চোট থেকে ফিরে জসপ্রিত বুমরাও ফিরছেন ছন্দে। সবকিছু ঠিক থাকলে ভারতের অন্তত ফাইনাল পর্যন্ত না ওঠা হবে বিস্ময়ের।
চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে বিশ্বকাপ নিয়ে সবচেয়ে তৃপ্ত থাকতে পারে অস্ট্রেলিয়া। এই টুর্নামেন্টে সর্বকালের সেরা দল তারা, হলুদ–সবুজদের বিশ্বকাপ মানেই অসাধারণ সব সুখস্মৃতি। ওয়াহ, পন্টিং, ক্লার্কদের পর এবারের বিশ্বকাপে অজিদের অধিনায়ক একজন বোলার, প্যাট কামিন্স। অনেকেরই হয়তো জানা নেই, উপমহাদেশের মাঠে প্রথম বিশ্বকাপ জেতার কীর্তি কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার। ১৯৮৭ সালে অ্যালান বোর্ডারের সেই জয়টা ছিল অস্ট্রেলিয়ারই প্রথম বিশ্বকাপ জয়। এরপর এই শতাব্দীতে সেটাকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলা অজিদের সাম্প্রতিক ফর্ম অবশ্য ভালো নয়। দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতের কাছে টানা হেরে কিছুটা বেকায়দায় আছে। তার চেয়েও বেশি অস্বস্তিতে থাকবে গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, মিচেল স্টার্ক, স্টিভ স্মিথদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটারদের চোট নিয়ে। বিশ্বকাপের আগে এই তারাদের ম্যাচ ফিটনেস নিয়ে তাই কিছুটা প্রশ্ন থাকতে পারে। তারপরও দলটা অস্ট্রেলিয়া, সবাই জানে তারা কী করতে পারে। দুই বছর আগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের সময়ই তারা দেখিয়েছে, জেতার জন্য তাদের ফেবারিট হওয়া লাগে না। কামিন্স, স্টার্ক যদি ফর্মে থাকেন আর টপ অর্ডারে ওয়ার্নার, স্মিথ ও পরে ম্যাক্সওয়েল জ্বলে উঠলে অস্ট্রেলিয়া শেষ পর্যন্ত যেতেই পারে।
নিউজিল্যান্ড গতবারের ফাইনালিস্ট, আইসিসি টুর্নামেন্টে তাদের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সও দারুণ। উপমহাদেশের বিশ্বকাপে তাদের রেকর্ড খুব ভালো না হলেও ব্যালান্সড একটা দল তাদের। কেন উইলিয়ামসন এখনো পুরো ফিট নন, এটা তাদের বড় দুশ্চিন্তা। দীর্ঘ চোট থেকে সেরে এখনো মাঠে নামেননি, তবে বিশ্বকাপে খেলার কথা অধিনায়ক হয়েই। ট্রেন্ট বোল্ট, টিম সাউদিরা পেস বোলিং সামলাচ্ছেন দীর্ঘদিন। ডেভন কনওয়ে, টম ল্যাথামরা আছেন টপ অর্ডারে। আইপিএলের সুবাদে কিউই ক্রিকেটারদের অনেকেই ভারতের সঙ্গে অভ্যস্ত। এটাও কাজে দিতে পারে তাদের।
পাকিস্তানকে নিয়ে চট করে কিছু বলা মুশকিল। যেবার তাদের কেউ গোনায় ধরে না, সেবারই তারা ভালো করে। এই বিশ্বকাপের আগে তাদের অবস্থা টালমাটাল। খেলোয়াড়েরা বেতন পাচ্ছেন না কয়েক মাস ধরে, ওদিকে পেসার নাসিম শাহ ছিটকে গেছেন বিশ্বকাপের আগে। এশিয়া কাপের পারফরম্যান্সও প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে অনেক। কিন্তু এমন কোণঠাসা অবস্থা থেকে ভালো করার রেকর্ড অনেক আছে পাকিস্তানের। এবারও বাবর আজমের দল সে রকম কিছু করে ফেললে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সে জন্য শাহীন শাহ, হারিস রউফদের ওপর অনেকটা নির্ভর করতে হবে বাবরকে।
দক্ষিণ আফ্রিকা সব সময়ই বিশ্বকাপে ফেবারিট হিসেবে আসে, কিন্তু নকআউটে গিয়েই তাদের সবকিছু পণ্ড হয়ে যায়। এবার ঠিক সেই অর্থে ফেবারিট নয় তারা। তবে হেনরিক ক্লাসেন, ডেভিড মিলারের দুর্দান্ত ফর্ম তাদের আশা দেখাতে পারে। টেন্ডা বাভুমার দলটা কদিন আগেই সিরিজে হারিয়েছে অস্ট্রেলিয়াকে। তবে উপমহাদেশের কন্ডিশনে তাদের ভালো করা বড় চ্যালেঞ্জ। চোটের জন্য আইনরিখ নরকিয়াকে হারানো বড় একটা ধাক্কা প্রোটিয়াদের। বিশ্বকাপ শুরুর আগে কুইন্টন ডি কক বলেছেন, এই আসর খেলেই ওয়ানডে ক্যারিয়ার শেষ করবেন। ডি ককের জন্য এবার স্মরণীয় কিছু করতে পারবে, তাহলে ‘দিস টাইম ফর আফ্রিকা?’
শ্রীলঙ্কাও বিপদে আছে গুরুত্বপূর্ণ দুজন ক্রিকেটারকে হারিয়ে। টুর্নামেন্টের আগে ফিট হয়ে উঠতে পারেননি অলরাউন্ডার ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা ও পেসার দুষ্মন্ত চামিরা। এশিয়া কাপে ভালো করলেও ফাইনালে ওভাবে হেরে যাওয়াটা ভুলে যেতে চাইবেন লঙ্কানরা। দাসুন শানাকার দলে বেশ কিছু কার্যকরী সাদা বলের ক্রিকেটার আছেন। কুশাল মেন্ডিস, কুশাল পেরেরা, ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা, সাদিরা সামারাভিক্রামারা কেউ বড় তারকা নন, কিন্তু জ্বলে উঠলে ম্যাচ বের করে নিতে পারেন প্রত্যেকে। হাসারাঙ্গার অভাব পূরণ করতে পারেন তরুণ সেনসেশন দুনিথ ভেল্লাগালে।
আফগানিস্তান দল কাগজে–কলমে বেশ ভালো, কিন্তু কেন যেন বিশ্বকাপ এলে তারা গুটিয়ে যায়। রশিদ খান, মুজিব উর রেহমান, মোহাম্মদ নবীদের স্পিন সম্ভবত বিশ্বসেরা, তবে তাদের মূল দুশ্চিন্তা ব্যাটিং। রহমানউল্লাহ গুরবাজ ছাড়া পার্থক্য গড়ে দেওয়ার মতো ব্যাটসম্যান খুব বেশি নেই তাদের। একই সঙ্গে বলতে হবে নেদারল্যান্ডসের নামও। সবাইকে চমকে আইসিসি কোয়ালিফায়ারে জিম্বাবুয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজদের পেরিয়ে তারা এসেছে বিশ্বকাপে। স্কট এডওয়ার্ডসের দলে আছেন লোগান ফন বিক, বাস ডি লিডদের মতো কিছু ভালো ক্রিকেটার। তবে এক–দুটি ম্যাচ জিতলেই সেটা বড় পাওয়া হবে ডাচদের।
আর সবশেষে বাংলাদেশ নিয়ে কিছু বলা কঠিন। তামিম ইকবালকে ছাড়াই সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে বিশ্বকাপে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগের চার বিশ্বকাপের প্রতিটিতেই তিনটি করে ম্যাচ জিতেছিল বাংলাদেশ। এবার তার চেয়ে ভালো করবে না খারাপ করবে, সেটা বলা কঠিন। তামিম ইকবাল না থাকায় বড় দায়িত্ব লিটন দাস ও তানজিদ তামিমের ওপর। বাংলাদেশের জন্য আশা নাজমুল হোসেন শান্তর ফর্ম। মুশফিকুর রহিম ও তাওহিদ হৃদয়ও মোটামুটি ছন্দে আছেন। আর বিশ্বকাপে সাকিব আল হাসান কী করতে পারেন, ২০১৯–এ তা দেখা গেছে। তবে এবার বাংলাদেশের মূল শক্তি তাসকিন আহমেদ, শরীফুল ইসলাম, হাসান মাহমুদ, মোস্তাফিজুর রহমানের পেস বোলিং। পেস বোলাররা ক্লিক করলে আর ব্যাটাররা জ্বলে উঠলে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে সেরা সাফল্য পেয়েও যেতে পারে।