তবু ভীষণ একা ঋতুপর্ণা
সেদিন কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে সাফজয়ের উৎসবের মধ্যে বাবার মুখটা নিশ্চয়ই মনে হয়েছিল ঋতুপর্ণা চাকমার। কত স্বপ্ন ছিল বরজ বাঁশি চাকমার। মেয়েটা ফুটবলার হবে। সারা দেশ তাঁকে চিনবে। মেয়ের ফুটবল আনন্দ দেবে দেশের ফুটবলপ্রেমীদের। গ্যালারিতে জয়ধ্বনি উঠবে আদরের মেয়েটার নামে। বরজ বাঁশির সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। শুধু দেশ নয়, তাঁর আদরের মেয়েটাকে এখন চেনে গোটা দক্ষিণ এশিয়াই। উপমহাদেশের অন্যতম সেরা নারী ফুটবলার তাঁর মেয়ে। কিন্তু এত সাফল্য, এত অর্জনের কিছুই যে তিনি দেখে যেতে পারেননি। ২০১৫ সালে ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে বরজ বাঁশি ছেড়েছেন এই দুনিয়া।
জীবনের সেরা সময়টা কাটাচ্ছেন ঋতুপর্ণা। কত জশ, কত খ্যাতি, কত প্রশংসা। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে তাঁর বাঁ পায়ের দুর্দান্ত এক গোলে কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়াম স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর সেই গোল বাংলাদেশকে এনে দিয়েছিল টানা দ্বিতীয়বারের মতো সাফ জেতার গৌরব। সাফের সেরা ফুটবলার হয়েছেন। সবার চোখেই ঋতু ধন্য ধন্য। কিন্তু কোথায় যেন একধরনের শূন্যতা অনুভব করেন দেশের নারী ফুটবলের অন্যতম এই তারকা ফুটবলার। ভিড়ের মধ্যে খুব করেই খুঁজে ফেরেন বাবা বরজ বাঁশি চাকমাকে। মনে হয়, এই বুঝি বাবা সেই স্নেহমাখা হাসিটা হেসে বলবেন, ‘মা! খুব ভালো খেলেছিস। এভাবেই খেলে যা।’
সদা হাসিখুশি মানুষগুলো যে বুকের মধ্যে কান্নার সমুদ্র নিয়ে ঘোরেন, সেই খবর আমরা কয়জন রাখি? সব সময় হাসতে দেখা ঋতুপর্ণা একই অবস্থা। বুকের মধ্যে উথালপাতাল করা হাহাকারটাই যেন মিষ্টি হাসি দিয়ে লুকিয়ে রাখেন তিনি। ২০১৫ সালে বাবার ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে চলে যাওয়ার কষ্টটা ভুলতে না ভুলতেই আদরের ছোট ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যু তাঁর পরিবারটাকে তছনছ করে দিয়েছিল। ভাই পার্বণ চাকমার মৃত্যু হয় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। ২০২২ সালে নেপালেই প্রথমবারের মতো সাফ জিতেছিল বাংলাদেশের মেয়েরা। সাফে খেলতে যাওয়ার মাত্র দুই মাস আগে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনা সব সময়ই তাড়িয়ে বেড়ায় ঋতুকে। নিজেকে বড় একা লাগে।
ঋতু নিজেই বললেন সেই কথা, ‘আমি আসলে অনেক একা। আমার তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, বাবা মারা গেছেন সেই ১১ বছর বয়সে। ভাইটাকে হারিয়েছি ২০২২ সালের জুন মাসে। এই যে সাফের সাফল্য, সবার ভালোবাসা, প্রশংসা, কিন্তু এত কিছুর পরও আমি একা। সব সময়ই বাবা আর ভাইয়ের কথা মনে হয়।’
আর্থিক দুরবস্থার মধ্যেই বড় হওয়া ঋতুপর্ণা। মা ভূজোপতি চাকমা স্বামীহীন সংসারটা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন কোনোমতে। রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের দুর্গম মগাছড়ি গ্রামে তাঁদের বাড়ি। ঋতুরা চার বোন, এক ভাই। তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন ঋতুর ফুটবলের টাকাটাই সংসারে কিছুটা সচ্ছলতার মুখ দেখিয়েছে। কিন্তু মা ভূজোপতি চাকমার সংগ্রাম এখনো ফুরিয়ে যায়নি। সাফ জিতে আসার পর নিজের সাংসারিক অবস্থার কি কোনো পরিবর্তন দেখছেন ঋতু? তাঁর নিজের মুখেই শোনা যাক, ‘খুব যে পরিবর্তন হয়েছে, তা নয়, তবে কিছুটা আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে, এটা ঠিক। পরিবারকে এখন আরও বেশি করে আর্থিক সহায়তা করতে পারছি। মায়ের পর পরিবারের উপার্জনকারী আমিই। আমার আয়ে মায়ের হয়তো কিছুটা আরাম হয়।’
ভবিষ্যৎটাকে আরও শক্ত তাঁকেই করতেই হবে। ফুটবল তো বটেই, পড়াশোনাতেও অনেক দূর যাওয়ার লক্ষ্য ঋতুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্রী ঋতু এ মুহূর্তে ভাবছেন পড়াশোনা নিয়েই। তবে কাজটা যে খুব কঠিন, সেটা স্বীকার করেছেন তিনি, ‘খেলাধুলার পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা অনেক কঠিন। তবে আমি অনার্স, মাস্টার্স সবই করতে চাই। পড়াশোনাটা নিজের ভবিষ্যতের জন্যই দরকার।’
২০১০ সালে মেয়েদের বঙ্গমাতা আন্তপ্রাথমিক ফুটবল দিয়ে তাঁর এই জগতে আসা। ২০১২ সালে টুর্নামেন্টের প্রথম আসরে খেলেন। ২০১৪ সালে সর্বশেষ খেলেছেন প্রাথমিকে। ২০১৬ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়া। একই সঙ্গে বাফুফে ছায়াতলে আসেন সেই সময়। ৮-৯ বছরের মধ্যেই দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ফুটবলার তিনি। প্রতিভার দীপ্তিতে আলাদাভাবেই নজর কাড়েন তিনি। গতি আর স্কিলের ঝলকে তাবৎ ফুটবলপ্রেমীরা হয়ে যান তাঁর ভক্ত। তবে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ফুটবলার এর মধ্যেই খুব করেই মিস করেন তাঁর ফুটবলপ্রেমী বাবা আর ভাইকে। অর্থ, খ্যাতির মধ্যেও ঋতুপর্ণা চাকমা ভুলতে পারেন না রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ঘেরা মগাছড়ি গ্রামের শেকড়। জীবন সংগ্রামটা যে সেখানেই করতে শেখা। আর সেই সংগ্রামের ফসলই ঋতুর আজকের এই অবস্থান।