বাংলাদেশের পুরুষদের ক্রিকেটের সাফল্য নিয়ে গল্প করতে চাইলে দীর্ঘদিন ধরে একই গল্প আসে মাথায়—কবে কোন বড় দলকে হারিয়েছি, সেসব ঘটনা মনে করতে হয়। দ্বিপক্ষীয় সিরিজের বাইরে অন্য কোনো ট্রফিও ছিল অধরা। সেই বৃত্ত ভেঙে প্রথমবারের মতো গর্বে বুক ভরে যাওয়ার মতো সাফল্য এনে দিয়েছিল দেশের জুনিয়র ক্রিকেটাররাই। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ২০২০-এর ফেব্রুয়ারিতে আকবর আলীরা জিতেছিলেন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ। পরাক্রমশালী ভারতকে হারানোর পর দেশের ক্রিকেটে সুদিনের আশায় বুক বেঁধেছিলেন সবাই। কিন্তু বড় টুর্নামেন্টে জাতীয় দলের অসহায় আত্মসমর্পণ যেন এক নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এবারও যখন ওয়ানডে বিশ্বকাপে প্রায় ভুলে যাওয়ার মতো পারফর্ম করল টাইগাররা, আবারও ক্রিকেটপ্রেমী জনতার দুঃখ ভুলিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিলেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের খেলোয়াড়েরা। মাহফুজুর রহমান রাব্বিদের বীরোচিত নৈপুণ্যে জিতে নিল অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপ। কেবিনেটে যুক্ত হলো আরেকটি ট্রফি। টুর্নামেন্টের অপরাজেয় দল হিসেবে হারিয়েছে শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মতো শক্তিশালী দলকে।
শুরুতে জাপান, আরব আমিরাত ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে একই গ্রুপে ছিল বাংলাদেশও। জাপানকে আপাতদৃষ্টে দুর্বল মনে করা গেলেও শ্রীলঙ্কা ও আরব আমিরাত ছিল শক্ত প্রতিপক্ষ। কিন্তু এদের সবাইকেই হেসেখেলে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে ব্যাঘ্রশাবকেরা। সেমিফাইনালে অপর গ্রুপের রানার্সআপ ভারতকে দেখা হচ্ছিল শিরোপার পথে বড় বাধা হিসেবে। তবে এসব সমীকরণ জলের মতো সোজা করে দিল বাংলাদেশের বোলিং লাইনআপ।
সেমিফাইনালে ভারতের মতো পরাক্রমশালী দলকে মাত্র ১৮৮ রানে অলআউট করে দেয় বাংলাদেশ। উইকেট নেওয়ার মিছিলে নেতৃত্ব দেন বাঁহাতি পেসার মারুফ মৃধা। চার উইকেট নিয়ে একাই ধসিয়ে দেন ভারতের ব্যাটিং অর্ডার। স্কোরবোর্ডে টার্গেটটা সহজ দেখালেও মাত্র ৩৪ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে বিপর্যয়ে পড়েছিলেন রাব্বিরাও। কিন্তু আরিফুল ইসলামের দৃঢ় ব্যাটিংয়ে ৪৩ বল হাতে রেখেই চার উইকেটের জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ।
ফাইনালে শেষ বাধা হয়ে দাঁড়ায় গ্রুপ পর্বের সঙ্গী আরব আমিরাত। অন্য সেমিফাইনালে টুর্নামেন্টের অন্যতম হট ফেবারিট পাকিস্তানের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই জিতে শিরোপার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। তা ছাড়া ঘরের মাঠেই ফাইনাল, স্বাগতিক হিসেবে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল তারা। তবে গ্রুপ পর্বে এই আরব আমিরাতকে ৬১ রানে হারানোর স্মৃতি নিশ্চয়ই আত্মবিশ্বাসের টোটকা হিসেবে কাজ করেছিল টাইগারদের ভেতর। এর প্রতিচ্ছবি দেখা যায় ইনিংসের শুরুতেই।
আশিকুর রহমান শিবলীর দুর্দান্ত শতকে আমিরাতের সামনে টার্গেট হিসেবে দাঁড়ায় ২৮২ রানের পাহাড়। একে তো ফাইনাল, তার ওপরে দারুণ ছন্দে থাকা বাংলাদেশের বোলারদের সামলানো—এই দুটি চাপের কোনোটাই নিতে পারেননি আমিরাতের ব্যাটাররা। এক প্রান্তে মারুফ মৃধা, অন্য প্রান্তে বর্ষণ—দুজন মিলে উইকেট তুলে নিতে থাকেন মুড়িমুড়কির মতো। ঘুণে খাওয়া কাঠের মতো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে আমিরাতের ব্যাটিং লাইনআপ। শেষ পর্যন্ত মাত্র ৮৭ রানে গুটিয়ে যায় তারা। ১৯৫ রানের ব্যবধানে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বড় জয় তুলে নিয়ে শিরোপার আনন্দে মেতে ওঠেন মারুফ-শিবলী-রাব্বিরা।
এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি আশিকুর রহমান শিবলী। ৩৭৮ রান করে এবারের এশিয়া কাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের গৌরব তাঁর। ওপেন করতে নেমে উইকেটকিপার এই ব্যাটার বেশির ভাগ ম্যাচেই এনে দিয়েছিলেন দারুণ শুরু। পাঁচ ম্যাচের মধ্যে দুটি সেঞ্চুরি আর দুটি হাফসেঞ্চুরি করেন তিনি। ১২৬ গড়ে ধারাবাহিকভাবে রান করেছেন।
মিডলঅর্ডারে আরিফুল হকও বেশ ভালো করেছেন। সেমিফাইনাল ও ফাইনালে দুটি হাফসেঞ্চুরিতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন। এর মধ্যে সেমিফাইনালের ৯৪ রান তো ছিল ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ জয়ের অন্যতম কারণ।
বল হাতে বাঁহাতি পেসে নজর কেড়েছেন মারুফ মৃধা। গুড লেন্থে বল করা, দুই দিকেই সুইং করতে পারা এই তরুণকে নিয়ে বেশ মাতামাতিও হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। নতুন বলে তাঁর সঙ্গী পারভেজ জীবনও দারুণ করেছেন। ১০টি করে উইকেট নিয়ে দুজনেই মনে রাখার মতো এক টুর্নামেন্ট কাটিয়েছেন।
এশিয়া কাপে বাজিমাত করা এই ক্রিকেটারদের নিয়ে দেশের কোটি কোটি ক্রিকেট–ভক্তের এখন আরও উচ্চাশা। বিশ্বমঞ্চে দেশের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ সাফল্যের স্বপ্ন হয়তো তাঁরাই পূরণ করবেন।