১২ বছর পর বিশ্বকাপ ফিরেছে এশিয়ায়। কথায় আছে, ক্রিকেটের জন্ম ইংল্যান্ডে হলেও প্রাণ পেয়েছে এশিয়ায়। কেনইবা হবে না। এশিয়ায় ক্রিকেটের জন্য যে উন্মাদনা, তার ছিটেফোঁটাও মেলে না পশ্চিমের দেশগুলোতে। ইংল্যান্ডের লোকজনের কাছে ফুটবলের পর ক্রিকেটের অবস্থান। অস্ট্রেলিয়াতে তো জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে ক্রিকেটের অবস্থান পাঁচে। একমাত্র দক্ষিণ এশিয়াতেই ক্রিকেট টিকে আছে যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে। সাধারণ একটি ম্যাচেও মাঠ থাকে আনাচকানাচে ভর্তি।
ভারতে যখন বিশ্বকাপ আয়োজনের কথা চলছিল, তখন থেকেই সবাই ভেবেছিল এবারের বিশ্বকাপ ছাড়িয়ে যাবে বাকি সব বিশ্বকাপকে। ১৪১ কোটি মানুষের দেশে বিশ্বকাপ নিয়ে আলাদা উন্মাদনা থাকবে না, তা কি সম্ভব? অথচ বিশ্বকাপ শুরুর এক দিন আগেও রয়েছে নানা জটিলতা। বৈশ্বিক একটি আয়োজনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অব্যবস্থাপনা—এমনটা সত্যিই ভারতের কাছ থেকে আশা করেনি কেউ।
বিশ্বকাপের অব্যবস্থাপনার সূচনা অনেক আগেই। বলতে গেলে বিশ্বকাপের ভেন্যু হিসেবে যখন ভারতের নাম প্রস্তাব করা হয়, ঠিক তখন থেকেই। ভারত-পাকিস্তান বৈরিতার কথা নিশ্চয় নতুন করে বলতে হবে না। বিশ্বকাপ আয়োজনের অনেক আগে থেকেই ভারতে খেলতে যাওয়া নিয়ে আপত্তি ছিল পাকিস্তানের। এমনকি নিজেদের ম্যাচগুলো বাংলাদেশে খেলার প্রস্তাবও দিয়েছিল পাকিস্তান। বহু আলোচনার পর অবশেষে সমঝোতায় পৌঁছায় পাকিস্তান। ভারতের অনড় নীতির কাছে হার মানতে হয় তাদের। বিশ্বকাপের জন্য ১৫ বছর পর পাকিস্তান দল পা রেখেছে ভারতের মাটিতে।
পাকিস্তানের এই দোটানায় বিপাকে পড়েছিল আইসিসি। পাকিস্তানের অনিশ্চয়তার জন্য বিশ্বকাপের ফিকশ্চার তৈরি করতে বেশ হযবরল পরিস্থিতিতে পড়তে হয় আইসিসিকে। দেরি করতে করতে শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপের মাত্র চার মাস আগে ফিকশ্চার তৈরি করতে সমর্থ হয় তারা। ৭ জুন নিশ্চিত করা হয় বিশ্বকাপের সূচি। যদিও এর আগেই নিশ্চিত ছিল শুরু ও শেষের তারিখ। কিন্তু ফিকশ্চার নিশ্চিত করতে পারছিল না কেউই।
ফিকশ্চার নিশ্চিত করেই ক্ষান্ত হয়নি ভারত। একের পর এক প্রস্তাবনা আসতে থাকে বিভিন্ন রাজ্য থেকে। ভারতের ১০ রাজ্যের ১০ মাঠে নামতে চলেছে বিশ্বকাপ। সেটাও আবার শারদীয় দুর্গাপূজা ও কালিপূজার মধ্যে। স্বাভাবিকভাবেই বড় পূজার আগে নিজেদের রাজ্যে বড় কোনো ম্যাচ চায় না রাজ্য কর্তৃপক্ষ। যে কারণে বড় ম্যাচগুলো সরিয়ে নেওয়ার আবেদন করে রাজ্যগুলো। ভারতের ক্রিকেট বোর্ডও আদতে রাজ্যগুলোর কাছে একপ্রকার বন্দীই বলা চলে। কারণ, রাজ্যগুলো বেঁকে বসলে ভারতের ক্রিকেট অবকাঠামো ভেঙে পড়তে বিন্দুমাত্র সময় লাগবে না। তাই ভারত মেনে নেয় তাদের কথা। আইসিসিকে জানায় খেলা পরিবর্তনের কথা। আয়োজকদের কোনো সমস্যা না থাকায় আইসিসিও পরিবর্তন করে সময়সূচির। ফলে ফিকশ্চার ঘোষণার পরও বদলে যায় ৯ ম্যাচের সূচি। এর দেখাদেখি অন্য রাজ্যগুলোও সময়সূচি বদলের আবেদন জানায়। কিন্তু তা ধোপে টেকেনি।
অতঃপর আসে টিকিটের গল্প। সে গল্প যত বলা হবে, ততই চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তেই থাকবে। টিকিট ছাড়া হয়েছিল বেশ কয়েকটি ধাপে। ভারতের খেলার টিকিটগুলো পর্যায়ক্রমে, অন্যান্য খেলার টিকিটগুলো একসঙ্গে। কিন্তু টিকিট কিনতে গিয়ে বেগ পোহাতে হয়েছে সবাইকেই। বিশেষ করে বিদেশ থেকে কাটা অনেক টিকিট নিয়েও হয়েছে সমস্যা। সমস্যা সেখানে থেমে থাকলেও হতো, বিদেশি দর্শকদের ভিসা নিয়েও বেশ কড়াকড়ি করছে ভারত সরকার। সামনে নির্বাচন থাকায় ভিসা দেওয়ার ব্যাপারে বেশ সতর্ক তারা।
ভিসা জটিলতার পড়েছে খেলতে আসা দলগুলোও। পাকিস্তান ভিসা পেয়েছে ভারতে প্রবেশের এক দিন আগে। দেরিতে ভিসা দেওয়ায় দুবাইয়ে নিজেদের ট্রেনিং বাতিল করতে হয়েছে তাদের। বাংলাদেশও ভিসা পেয়েছে দুই দিন আগে। ইংল্যান্ডের কানেকটিং ফ্লাইট যথাসময়ে ম্যানেজ করতে না পারায় ৩৮ ঘণ্টা লেগেছে ভারতে পৌঁছাতে।
সবশেষে রয়েছে আয়োজন। সেখানে অবশ্য কমতি রাখেনি ভারত। কিন্তু বিশ্বকাপের থিম সং নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনার সূচনা। প্রীতমের সেই গান নিয়ে হয়েছে তুমুল সমালোচনা। শুধু তা–ই নয়, বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়েও চলছে টালবাহানা। একবার বলা হচ্ছে অনুষ্ঠানের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন, আরেকবার খবর আসছে অনুষ্ঠান ছাড়াই মাঠে গড়াবে বিশ্বকাপ। ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির মিশ্রণে মিশে থাকা একটি দেশ যদি ক্রিকেট বিশ্বকাপের এমন সাদামাটা সূচনা করে, তা কি মানায়?
বিশ্বকাপের মতো বিশাল আয়োজনে ভুলত্রুটি থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশাল কর্মযজ্ঞে ছোটখাটো ভুল হতেই পারে। কিন্তু ক্রমাগত এমন ভুল ও তার পরিপ্রেক্ষিতে দল এবং দর্শকদের ভোগান্তি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং আয়োজকদের অব্যবস্থাপনা। ভারতের এই অব্যবস্থাপনার কারণে হতে পারে আসন্ন নির্বাচন। নির্বাচন নিয়ে এই ব্যস্ততা বিশ্বকাপের ওপর থেকে আগ্রহ ও উদ্যম হয়তো অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। সে কারণেই হয়তো ক্রিকেট বিশ্বকাপের মতো বিশাল আয়োজন থাকা সত্ত্বেও তাতে অব্যবস্থাপনাই চোখে পড়ছে বেশি।
যদিও এত কিছুর পরও বিশ্বকাপের প্রস্তুতিপর্ব বেশ ভালোভাবেই শেষ করেছে দলগুলো। অপেক্ষা এখন বিশ্বকাপের বল মাঠে গড়ানোর, আর সেটি ভালোভাবে গড়ালেই বোঝা যাবে, এই অব্যবস্থাপনার জল ঠিক কত দূর গড়িয়েছে? তার প্রভাব মাঠে পড়ছে কি না?