হামজায় বদলে যাবে বাংলাদেশের ফুটবল
বাংলাদেশের ফুটবলে দারুণ এক ব্যাপারই ঘটে গেছে।
এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের নাম লেখা হচ্ছে দুনিয়ার অন্যতম সেরা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের পর্দায়। বাংলাদেশের লাল–সবুজ পতাকাটা দেখা যাচ্ছে এক ফুটবলারের নামের পাশে। প্রিমিয়ার লিগের সাবেক চ্যাম্পিয়ন লেস্টার সিটির বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফুটবলার হামজা দেওয়ান চৌধুরী আনুষ্ঠানিকভাবে হয়ে গেছেন বাংলাদেশের। এই প্রথমবারের মতো পৃথিবীর সেরা পাঁচ লিগের একটিতে খেলা কোনো ফুটবলার খেলতে যাচ্ছেন বাংলাদেশের লাল–সবুজ জার্সি গায়ে। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই হামজা তো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতই। তাঁর নামের পাশে আবার নতুন করে বাংলাদেশের নামটা কেন লেখা হচ্ছে? এই হামজার ‘বাংলাদেশের’ হয়ে যাওয়াটাই–বা কেন আনুষ্ঠানিকতার। উত্তরটা দিতে হলে এর পটভূমিটা বলতে হবে। আর সেটা দারুণ ইন্টারেস্টিং।
হামজা চৌধুরীর বাবা–মা দুজনই বাংলাদেশি হলেও ছেলের জন্ম ইংল্যান্ডের লেস্টারশায়ারে। জন্মগতভাবেই হামজা এত দিন ছিলেন ইংল্যান্ডের নাগরিক। তাঁর বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, ফুটবলার হয়ে ওঠা—সবই ইংল্যান্ডে। খুব ছোটবেলাতে প্রতিভাবান হামজার সঙ্গে চুক্তি করেছিল ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব লেস্টার সিটি। তাদের একাডেমিতেই হামজা বৃত্তি নিয়ে ফুটবলার হয়েছেন। ফিফা র৵াঙ্কিংয়ে ১৮৫ নম্বর স্থানে থাকা বাংলাদেশের রক্ত তাঁর শরীরে বয়ে চললেও তিনি ৭ বছর বয়স থেকে ফুটবলার হিসেবে বেড়ে উঠেছেন বিশ্বমানের ফুটবলার হিসেবেই। লেস্টার সিটির সিনিয়র দলে পরবর্তী সময়ে অভিষেক ঘটেছে তাঁর। এই ক্লাবের অধিনায়কত্ব করেছেন, জিতেছেন এফএ কাপ। এ ছাড়া খেলেছেন ইউরোপের দ্বিতীয় সেরা ক্লাব টুর্নামেন্ট ইউরোপা লিগ ও এর পরের ধাপ উয়েফা কনফারেন্স লিগে। বাংলাদেশি রক্ত শরীরে নিয়ে এমন একজন ফুটবলার ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলছেন, ব্যাপারটা বাংলাদেশের মানুষের জানা ছিল অনেক আগেই। এই হামজাকে তো একসময় ইংল্যান্ডের সম্ভাবনাময় উদীয়মান ফুটবলারও বলা হতো। ইংল্যান্ড জাতীয় ফুটবল দলে খেলাই তাঁর লক্ষ্য ছিল, খেলেছেন ইংল্যান্ডের অনূর্ধ্ব–২১ দলের জার্সিতেও। বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা স্বপ্ন দেখতেন, ইশ! কোনোভাবে যদি হামজাকে বাংলাদেশের হয়ে খেলার ব্যাপারে রাজি করানো যায়! কিন্তু পরক্ষণেই তাঁরা বাস্তবের জমিনে পা রাখতেন, ইংল্যান্ডের সুযোগ–সুবিধা ছেড়ে হামজাই–বা কেন বাংলাদেশের হয়ে খেলার ব্যাপারে রাজি হবেন? তিনি কি পাগল না অন্য কিছু!
কিন্তু সেই হামজাই এখন বাংলাদেশের। পুরোপুরি নিজের আগ্রহ ও ইচ্ছায়। বাংলাদেশি মা–বাবার ছেলে হিসেবে এই দেশের সঙ্গে তাঁর সব সময়ই যোগাযোগ ছিল। সিলেটের হবিগঞ্জে নিজের পৈতৃক ভিটায় প্রতিবছরই আসা হতো একটা সময়। ছোটবেলায় এই দেশের সহজ–সরল মানুষদের দেখতেন। ইংল্যান্ডের মতো প্রাচুর্য নেই, চাকচিক্যে ভরা জামাকাপড় নেই, কিন্তু কী সুখী তাঁরা। ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে গেলে স্থানীয় ছেলে–মেয়েদের সঙ্গে খেলতে খেলতে অবাক হয়ে দেখতেন, খেলাটাকে কতভাবেই–না উপভোগ করছে তারা। বড়দের আদর, ভালোবাসায় এই দেশটির প্রতি ছোটবেলা থেকেই মমত্ববোধ তৈরি হয় তাঁর মধ্যে। ২০১৪ সালে লেস্টার সিটির বৃত্তি পাওয়ার পর তাদের একাডেমিতে যখন ফুটবলার হিসেবে তৈরি হতে থাকলেন, তখন থেকে আর হবিগঞ্জে আসা হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের কথা তাঁর মনে ছিল। এই দেশ তাঁর হৃদয়ে এমনভাবে থেকে গিয়েছে যে ইংলিশ জাতীয় দলে খেলার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তিনি বাংলাদেশের জার্সিতেই খেলার কথা ভাবতে লাগলেন। হোক না দেশটির ফিফা র৵াঙ্কিং তলানিতে। এই দেশের মাটি, এই দেশের মানুষ ও এই দেশের ফুটবলের প্রতি একধরনের দায়িত্ব থেকেই হামজা একটা সময় সিদ্ধান্ত নিলেন, বাংলাদেশের লাল–সবুজ জার্সিতে আন্তর্জাতিক ফুটবলে পা রাখার ব্যাপারে।
কিন্তু ইচ্ছা করলেই তো আর বাংলাদেশের হয়ে খেলতে পারেন না তিনি। ফিফার নিয়মে সেটি নেই। কোনো দেশের জাতীয় ফুটবল দলে খেলতে হলে একজন ফুটবলারকে সে দেশের পাসপোর্ট পেতে হয়, হামজার ক্ষেত্রে মা–বাবার ঝামেলা ছিল না। আর যেটি থাকতে হয় সেটি হচ্ছে, ওই খেলোয়াড় যে দেশের হয়ে খেলতে চান, সেই দেশের ফুটবল ফেডারেশনের ইচ্ছা। হামজাকে পেতে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। হামজার ভাষায়, ‘প্রায় দুই বছর ধরে।’ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ফিফার কাছে পাঠানো, ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের কাছে পাঠানো; দুই বছর ধরে সবই করেছে বাফুফে। প্রাথমিক কাজ শেষ হওয়ার পর তাঁর জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে হয়েছে সরকারের কাছ থেকে, এরপর পাসপোর্ট। এ বছরের জুন মাসে লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনে নিজে গিয়ে পাসপোর্টের আবেদন করেছিলেন হামজা। সেই পাসপোর্ট আগস্টে পাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মিলে যায় ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এফএ) ছাড়পত্র; অর্থাৎ ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে লেস্টার সিটির হয়ে খেলা হামজা যদি আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের হয়ে খেলতে চান, তাতে ইংল্যান্ডের কোনো আপত্তি নেই। গত সেপ্টেম্বরে এফএর ছাড়পত্র বাফুফের হাতে আসার পর হামজার ‘বাংলাদেশের’ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি ৭০ ভাগই সম্পন্ন হয়ে যায়। তবে বাকি ৩০ ভাগের বিষয়টি ছিল সবচেয়ে কঠিন। সেটি হচ্ছে ফিফার প্লেয়ার্স স্ট্যাটাস কমিটির ছাড়পত্র। ফিফার এই বিভাগ খেলোয়াড়দের এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া, তাঁদের নাগরিকত্ব বদল ইত্যাদি বিষয়ে খুব কড়া। আর সেটি বোধগম্য কারণেই। বিশ্ব ফুটবলে শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থেই তারা কড়া। নয়তো দেশগুলো টাকা দিয়েই তো এক দেশ থেকে অন্য দেশে খেলোয়াড় কিনে নিয়ে জাতীয় দলে খেলিয়ে দিত। হামজার ব্যাপারে এই প্লেয়ার্স স্ট্যাটাস কমিটি আরও কাগজপত্র চাইল বাফুফের কাছে। আমাদের ফেডারেশন সেই কাগজপত্র দেওয়ার পর আরও দুই মাসের অপেক্ষা। অবশেষে ১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ফুরোল দীর্ঘ প্রতীক্ষা। বাফুফের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে নিজেই ভিডিও দিয়ে হামজা জানিয়ে দেন, তিনি এখন থেকে একেবারেই বাংলাদেশের। সেই ভিডিওতে তিনি এটাও বলেন, বাংলাদেশের জার্সিতে খেলতে নামতে তাঁর নাকি তর সইছে না।
হামজাকে বাংলাদেশের হয়ে খেলার ব্যাপারে ফিফার প্লেয়ার্স স্ট্যাটাস কমিটির ছাড়পত্র এ দেশের ফুটবলই শুধু নয়, গোটা ক্রীড়াজগতের জন্যই দারুণ ঐতিহাসিক এক ব্যাপার। বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলা একজন ফুটবলার এখন থেকে বাংলাদেশের হয়ে খেলবেন। ক্রিকেটে বিশ্ব পরিসরের দল বাংলাদেশ। সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমরা দুনিয়ার সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলা ক্রীড়াবিদ, সন্দেহ নেই। কিন্তু ফুটবলকে ক্রিকেটের চেয়ে বড় বিশ্ব পরিসরের খেলা হিসেবে ধরলে ইউরোপের সেরা পাঁচ লিগের একটিতে কিংবা ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলা একজন ফুটবলার যখন বাংলাদেশের হয়ে যান, তখন তিনিই এ দেশের ক্রীড়া ইতিহাসের সবচেয়ে হাইপ্রোফাইল ক্রীড়াবিদ হয়ে যান, এ নিয়ে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।
খুব শিগগির হামজা আসবেন বাংলাদেশে। কিছুদিন আগেই এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের গ্রুপিং হয়ে গেছে। সেখানে বাংলাদেশের গ্রুপসঙ্গী ভারত, হংকং ও সিঙ্গাপুর। এতে প্রতিটি দলের বিপক্ষে হোম ও অ্যাওয়েতে দুটি করে ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। আগামী মার্চের ২৫ তারিখ ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ। সেটি হবে ভারতের মাটিতে। হামজাকে সে ম্যাচ থেকেই পাওয়া যাবে বলে মনে করে বাফুফে। আর সেই ম্যাচ থেকেই যে বাংলাদেশের ফুটবলের নবযাত্রা, সেটি কিন্তু বলে দেওয়াই যায়।
একজন হামজা বাংলাদেশের ফুটবলকে কতটা বদলে দিতে পারবেন? প্রশ্নটা কিন্তু উঠছেই। হামজার বাংলাদেশের হয়ে খেলাটা যখন প্রবল সম্ভাবনা, ফিফার প্লেয়ার্স স্ট্যাটাস কমিটি তখনো তাঁকে ছাড়পত্র দেয়নি। কিন্তু তার মধ্যেই ভারতীয় গণমাধ্যম কিন্তু হামজাকে নিয়ে জল্পনা–কল্পনা শুরু করে দিয়েছিল। বাংলাদেশের জার্সিতে হামজা খেললে বাংলাদেশ কতটা শক্তি অর্জন করবে, প্রতিপক্ষের গণমাধ্যম হিসেবে তাদের ভাবনাটা ছিল এমনই। এটাই হামজার প্রভাব। ট্রান্সফার মার্কেট নামের যে ওয়েবসাইটটি আছে, সেখানে বিশ্বের সব জাতীয় দল ও ক্লাবের অর্থমূল্য নির্ধারণ করা হয়। মূলত ওই জাতীয় দল কিংবা ক্লাবে যেসব খেলোয়াড় আছেন, তাঁদের বাজারদর হিসাব করেই সেই অর্থমূল্য নির্ধারণ করা হয়। হামজা বাংলাদেশের হয়ে যাওয়ার পর এ মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দামি জাতীয় ফুটবল দল বাংলাদেশেরই।
এসব আলোচনা এক পাশে সরিয়ে রেখে হামজার বিপণনমূল্য নিয়ে একবার চিন্তা করা যাক। এ দেশের ফুটবল আন্তর্জাতিক সাফল্যহীনতার কারণে বহু বছর ধরেই পৃষ্ঠপোষকের অভাবে ধুঁকছে। আমাদের জাতীয় ফুটবল দলের পৃষ্ঠপোষক নেই, আমাদের ফুটবল ফেডারেশন অর্থের অভাবে অনেক উন্নয়ন কার্যক্রমই ঠিকমতো চালাতে পারে না। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের যে লিগ, সেই বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগেও অর্থের অভাবেই উন্নত করা যাচ্ছে না, ব্যবসায়িকভাবে সফল করা যাচ্ছে না। এক হামজাই সব বদলে দেবেন, এমনটা বলা ঠিক হবে না, কিন্তু হামজার আগমনে এসব ব্যাপারে বড় পরিবর্তন দেখা দেবে। পৃষ্ঠপোষকেরা আগ্রহী হবেন। শুধু হামজা খেলছেন, এতেই হয়তো জাতীয় দলের জার্সিতে বিশ্বখ্যাত স্পোর্টস ব্র্যান্ড অ্যাডিডাস, নাইকি, পুমার লোগো দেখা যেতে পারে। শুধু দেশের মাটিতে বাংলাদেশের ম্যাচগুলো সম্প্রচার করতেই টাকার থলে নিয়ে হাজির হতে পারে আন্তর্জাতিক সম্প্রচার সংস্থাগুলো। হামজার বাণিজ্যিক মূল্য এ মুহূর্তে আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য অনেক বড় টনিক।
হামজা নিজেও বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে এরই মধ্যে ভাবা শুরু করে দিয়েছেন। ফিফার ছাড়পত্র পেয়েই বিখ্যাত ব্রিটিশ ফুটবল সাময়িকী দ্য অ্যাথলেটিককে একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, তিনি বাংলাদেশের জার্সিতে খেলে আরও বাংলাদেশি ফুটবলারদের ইউরোপে খেলার রাস্তা খুলতে চান। তিনি এ দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রতিভাবান ফুটবলার তৈরিতে কাজ করতে চান বাংলাদেশি ফুটবল ক্লাবগুলোর সঙ্গে। আরও একটা ব্যাপার হামজা বলেননি সেই সাক্ষাৎকারে। তিনি আসার পর সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রতিভাবান ফুটবলাররা বাংলাদেশের জার্সিতে কিংবা বাংলাদেশের লিগে খেলার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। শোনা যাচ্ছে, হামজা নাকি এরই মধ্যে আগ্রহী করে তুলেছেন অনেককেই।
হামজায় বদলে যাবে বাংলাদেশের ফুটবল, কথাটা বোধ হয় বলাই যায়।
*লেখাটি কিশোর আলোর জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত