ইপ্সউইচ টাউনের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক হতে যাচ্ছে রুবেন আমোরিমের। মৌসুমের মাঝপথে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের গুরুদায়িত্ব তুলে নিয়েছেন ৩৯ বছর বয়সী পর্তুগিজ কোচ। বরখাস্ত হওয়ার আগে এরিক টেন হাগ দলকে রেখে গিয়েছিলেন টেবিলের ১৪তম অবস্থানে। অন্তর্বর্তীকালীন কোচ রুড ফন নিস্টলরয়ের হাত ধরে জয়ের ধারায় ফিরেছে ইউনাইটেড। রুবেন আমোরিমের অধীনে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে ইউনাইটেড?
১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এলেও রুবেন আমোরিম ইউনাইটেডের দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন ১১ দিন পর। এই ১১ দিনেই ঘটিয়ে ফেলেছেন তুলকালাম কাণ্ড। ইউনাইটেডের দায়িত্ব নেওয়ার আগেই বোঝাপড়া করে নিয়েছেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সিটির সঙ্গে। চ্যাম্পিয়নস লিগে ম্যান সিটিকে ৪-১ গোলে হারিয়ে যেন প্রিমিয়ার লিগের দলগুলোকে আগাম বার্তা দিয়ে রেখেছেন। ম্যাচ শেষে আবার সাংবাদিকদের সঙ্গে রসিকতা করে বলেছেন, ‘আপনারা তো এখন আমাকে নতুন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন বানিয়ে দেবেন!’ রুবেন আমোরিম নতুন স্যার অ্যালেক্স হতে পারবেন কি না, সে প্রশ্ন তোলা থাকবে সময়ের কাছে। কিন্তু ক্যারিংটনে প্রথম ট্রেনিং সেশন শেষেই বোঝা গেছে, ইউনাইটেডে বড়সড় একটা পরিবর্তনের হাওয়া লাগতে চলেছে। কোচ হওয়ার পর দেওয়া আনুষ্ঠানিক দুই সাক্ষাৎকারেও ফুটে উঠেছে সেই সুর। কেমন পরিবর্তন আসতে চলেছে ইউনাইটেড ক্যাম্পে?
ইউনাইটেডে এসে রুবেন আমোরিম কীভাবে দল সাজাবেন, সেটা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা থাকলেও কোন ছকে দল খেলাবেন, সে নিয়ে ধোঁয়াশা নেই কারও। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই থ্রি-ব্যাক ফরমেশনে স্বাচ্ছন্দ্য তাঁর। ইউনাইটেডে এসেও সেটা বদলাচ্ছে না। অন্তত ট্রেনিং সেশন সেটাই বলছে। তিনজন ডিফেন্ডার নিয়ে খেলা ইউনাইটেডের জন্য নতুন কিছু নয়। জোসে মোরিনহো, ওলে গুনার শুলসারের আমলে বেশ কিছু ম্যাচেই তাদের দেখা গেছে তিনজন ডিফেন্ডার নিয়ে খেলতে। মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, মোরিনহো যখন ৩-৪-৩ ফরমেশনে বুঁদ হয়ে ছিলেন, তখন ইউনাইটেডে ইন্টার্ন হিসেবে কিছুদিন কাজ করেছেন আমোরিম।
বিল্ডআপ প্লে
ট্রেনিং সেশনে আমোরিমকে দেখা গেছে ৩-৪-২-১ ফরমেশনে খেলাতে। স্পোর্তিংয়ে শেষ দুই বছর এই ফরমেশনেই দলকে খেলিয়েছেন। আমোরিমের এই ট্যাকটিসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ফরমেশনের ফ্লুয়েডিটি। আক্রমণ কিংবা রক্ষণ, পরিস্থিতি বুঝে দ্রুতই পরিবর্তন হয় তার ফরমেশন; সেই সঙ্গে ট্যাকটিসও। বিল্ডআপের সময় গোলকিপার হয়ে ওঠেন অবিচ্ছেদ্য অংশ। দুই ডিফেন্ডার নেমে এসে সঙ্গ দেন গোলরক্ষককে, আর সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার ওপরে দিয়ে সঙ্গ দেন সেন্টার মিডফিল্ডারদের। দুই উইংব্যাক কিছুটা নেমে এসে সমর্থন দেন ডিফেন্ডারদের। ফলে মুহূর্তেই ৩-৪-২-১ ফরমেশন পরিবর্তিত হয়ে যায় ৪-২-২-২ ফরমেশনে। এতে ডিফেন্স থেকে অনেকগুলো পাসিং অপশন যেমন তৈরি হয়, তেমনই সেন্টার মিডফিল্ডাররা পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেদের ও প্রতিপক্ষের হাফ স্পেসে মুভ করেন।
এই সেটআপে প্রয়োজন হয় একজন খুবই গতিসম্পন্ন ও বুদ্ধিমান বক্স টু বক্স মিডফিল্ডারের। যিনি চষে বেড়াবেন পুরো মাঝমাঠ। প্রতিপক্ষে ছেড়ে দেওয়া সামান্যতম জায়গার সঠিক ব্যবহার করতে পারবেন যিনি। যে কাজটা স্পোর্তিংয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে এসেছেন পেদ্রো গনকালভেস।
ফ্লুইড অ্যাটাক
আক্রমণে যাওয়ামাত্র দল চলে যায় ৩-২-৫ ফরমেশনে। তিনজন ডিফেন্ডার ও দুই সেন্টার মিডফিল্ডার নিজেদের জায়গাতেই থাকবেন। স্ট্রাইকার ও অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারদের সঙ্গে উইংব্যাকরা দ্রুত যোগ দেন আক্রমণে। এতে মুহূর্তেই প্রতিপক্ষের ডিফেন্সকে ওভারলোড করে ফেলা সম্ভব। বিশেষ করে ডিফেন্ডারকে মাঝখানে একটি জটলার সৃষ্টি করে মিডফিল্ডাররা চেষ্টা করেন বল বের করার। স্ট্রাইকার, উইঙ্গার আর সেন্টার মিডফিল্ডাররা বাদে বাকিরা পান ফ্রি রোল। ফলে মাঠে অন্তত তিনজন খেলোয়াড় থাকেন, যাঁরা নিজের মতো করে মুভ করতে পারেন। ফলে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া হয়ে গেলে দ্রুতই নিজেদের পজিশন পরিবর্তন করে ভড়কে দিতে পারেন ডিফেন্ডারদের।
হাইলাইন ডিফেন্সের বিপক্ষে উইংব্যাকদের কাজ থাকে স্ট্রাইকারকে ব্লাইন্ডসাইট রান নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। ডিকয় হিসেবে ডিফেন্ডারদের টেনে নিয়ে জায়গা খালি করে দেন স্ট্রাইকার আর অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারদের জন্য। আর লো-ব্লকের বিপক্ষে স্ট্রাইকারের উদ্দেশে ক্রস। গত মৌসুমে আমোরিমের ভরসার পাত্র ছিলেন ভিক্টর গাইকোরেস। হাইলাইন কিংবা লো-ব্লক, দুই ডিফেন্সেই সমান কার্যকরী ছিলেন ৬ ফুট ২ ইঞ্চির সুইডিশ স্ট্রাইকার।
আমোরিমের নজরে যাঁরা
চোটের কারণে ইউনাইটেডের বেশ কিছু বড় তারকাই মাঠের বাইরে। তিনজন ডিফেন্ডার খেলাতে চাইলে তাই আপাতত জোড়াতালিই ভরসা। তবে হাসপাতাল থেকে ছুটি পেলেই বলা যাবে, কে জায়গা পাচ্ছেন আমোরিমের গুডবুকে। তবে তাঁর ট্যাকটিস থেকে কিছুটা আন্দাজ করাই যায়।
গোলবারের নিচে আন্দ্রে ওনানাই হবেন আমোরিমের বিশ্বস্ত সঙ্গী। বল প্লেয়িং গোলরক্ষক বরাবরই পছন্দ তাঁর। যে কারণে স্পোর্তিংয়ে প্রথম মৌসুমে ভরসার পাত্র ছিলেন ৩৩ বছর বয়সী গোলরক্ষক আন্তোনিও আদান। সেন্টারব্যাকে ম্যাথিয়াস ডি লিখট ও লিসান্দ্রো মার্তিনেজ থাকছেন। চোট থেকে ফিরে লেনি ইয়োরো ফিরে পেতে পারেন নিজের চিরচেনা পজিশন। তত দিন হয়তো দিয়েগো দালোত অথবা ভিক্টর লিন্দেলফকে দিয়ে কাজ চালাতে হবে আমোরিমকে।
সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে দলে জায়গা ফেরত পাবেন ম্যানুয়েল উগার্তে ও কোবি মাইনু। মাঝমাঠে তরুণ তারকাদের বেশি পছন্দ করেন আমোরিম। সেখানে ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন ও কাসেমিরো যে জায়গা হারাতে যাচ্ছেন, তা প্রায় নিশ্চিত। উইংব্যাক হিসেবে বেশ কয়েকটি অপশন আছে আমোরিমের হাতে। ডান পাশে আমাদ দিয়ালো, দিয়েগো দালোত, অ্যান্থনি; বাঁ পাশে নুসাইর মাজরাউই, লুক শ, টায়রেল মালাসিয়া। তবে আমোরিমকে মুগ্ধ করতে হলে ডিফেন্সের পাশাপাশি আক্রমণে যেমন শাণিত হতে হবে, তেমনই প্রয়োজন হবে দুর্দান্ত গতি। সেদিক থেকে এগিয়ে আছেন দিয়ালো ও মাজরাউই।
আক্রমণভাগে দুই স্ট্রাইকারকে নিয়ে খুব একটা অখুশি হবেন না আমোরিম। রাসমাস হয়লুন্দ ও জসুয়া জার্কজি বেশ ভালোই করেছেন এখন পর্যন্ত। ট্যাকটিসের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলে পর্যাপ্ত গেমটাইম পাবেন দুজনেই। তবে আমোরিমকে চিন্তায় ফেলবে অ্যাটাকিং মিডফিল্ড পজিশন। এই দুই পজিশনে কারা জায়গা করে নেবেন, তা নিয়ে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে তাঁকে। অধিনায়ক ব্রুনো ফার্নান্দেজ টেন হাগের আমলে ছিলেন তুরুপের তাস, আমোরিমের আমলেও সে সম্ভাবনা আছে। মার্কাস রাশফোর্ড, আলেহান্দ্রো গারনাচো, মেসন মাউন্ট কেউই ধারাবাহিক নন। ফলে কারও ওপর ভরসা করতে পারবেন, সে সম্ভাবনা কম। দলবদলের মৌসুম আসা পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে কাউকে দিয়েই দল গোছাতে হবে তাঁকে।
তবে আমোরিমের আমলে ভাগ্যের শিকে খুলবে একাডেমি খেলোয়াড়দের। তরুণ খেলোয়াড়দের ওপর ভর করেই নিজের ক্যারিয়ার গড়েছেন, ফলে ইউনাইটেডে তার ব্যতিক্রম হবে না। স্পোর্তিংয়ে তাঁর তুরুপের তাস পেদ্রো গনকালভেসকে তুলে এনেছিলেন যুবদল থেকে। ইউনাইটেডের বিখ্যাত যুবদল থেকে মেওন কাউকে বের করে আনবেন না, এমনটা আশা করা ভুল।