শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজ জয়ের লড়াইয়ে ম্যাচ জেতানো এক ইনিংস খেলেন তানজিদ হাসান তামিম। ৯টি চার ও ৪টি ছক্কায় সাজানো ৮১ বলে ৮৪ রানের এক অসাধারণ ইনিংস। অথচ গতকালের ম্যাচে মাঠে নামারই কথা ছিল না তাঁর। প্রথম ইনিংস শেষ হওয়ার দুই বল আগে ব্যথা পাওয়া সৌম্য সরকারের জায়গায় একাদশে জায়গা পান তামিম। কীভাবে সৌম্যর বদলে একাদশে সুযোগ পেলেন তানজিদ হাসান তামিম?
খেলাধুলায় ‘বদলি’ শব্দটার সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। ফুটবল, হকি, বাস্কেটবলে প্রতি ম্যাচেই নিয়ম করে খেলোয়াড়েরা বদলি হন। ক্রিকেটেও ‘বদলি’ শব্দটার প্রচলন ছিল, কিন্তু সেটা শুধু ফিল্ডিংয়ের সময়। ফিল্ডিং দলের কোনো খেলোয়াড় যদি চোট কিংবা অসুস্থতার কারণে মাঠ থেকে উঠে যান, তবে তাঁর বদলি হিসেবে মাঠে নামতে পারেন সেই দলের বেঞ্চে থাকা যেকোনো খেলোয়াড়। ক্রিকেট ইতিহাসের শুরু থেকেই আছে এই নিয়ম। কিন্তু বদলি হয়ে নামা ক্রিকেটার সমানতালে ব্যাট–বল করে চলেছেন, কিছুদিন আগে পর্যন্তও এটি ছিল অভাবনীয় একটি ব্যাপার।
সবটা বদলে যায় ২০১৪ সালে ফিল হিউজের মৃত্যুর পর। অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটের এক ম্যাচে ব্যাটিং করার সময় ঘাড়ে আঘাত পান হিউজ। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। দুই দিন হাসপাতালে থাকার পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন তিনি। গোটা ক্রিকেট–বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল সেই ঘটনা। সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাটসম্যানদের সুরক্ষা নিয়ে তোড়জোড় শুরু করে আইসিসি। সঠিক হেলমেট, সঠিক গার্ড না থাকলে ম্যাচ পর্যন্ত শুরু করতে দিতেন না আম্পায়াররা। আর তখনই সামনে কনকাশন বদলির নিয়ম। বেশ কয়েক দফা পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর প্রথমবারের মতো কনকাশন বদলি চালু হয় নিউজিল্যান্ডে।
২০০৬ সালের দিকে দ্বাদশ খেলোয়াড়ের নিয়ম চালু করা হয়েছিল, যখন ব্যর্থ কোনো ব্যাটসম্যানের বদলে নতুন কোনো বোলার নামানোর সুযোগ পেত দল। বা ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়লে একজন বোলারের বদলে ব্যাটসম্যানও নামাত অনেকে। আগে ব্যাট করে পড়ে বোলার নামানোর সুযোগ অনেকেই নিয়েছে সে সময়ে। প্রবল সমালোচনার মুখে সেই নিয়ম বাতিল করে আইসিসি। কিন্তু ‘কনকাশন বদলি’ সেরকম কোনো বদলি না।
‘কনকাশন বদলি’ বা মাথায় চোটজনিত কারণে বদলির নিয়ম সাধারণ বদলির নিয়ম থেকে আলাদা। সাধারণ বদলির ক্ষেত্রে একজন খেলোয়াড়ের বদলে আরেকজন খেলোয়াড় মাঠে নেমে শুধু ফিল্ডিং করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে চোট যেকোনো ধরনের হতে পারে, এতে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এমনকি ফিল্ডিং করতে কে নামবেন, সে ব্যাপারেও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু ‘কনকাশন বদলি’ হতে পারবে যদি ম্যাচ চলাকালীন সময়ে কোনো খেলোয়াড় মাথায় কিংবা ঘাড়ে চোট পান। মাথায় অথবা ঘাড়ের চোটকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় কনকাশন।
কনকাশন মূলত ব্রেইনের চোট। জোরে আঘাত লাগার ফলে কঙ্কালের সঙ্গে ব্রেইনের আঘাত লাগলে সেখান থেকে কনকাশন হতে পারে। কনকাশনের ফলে সাময়িক ঝাপসা দেখা, মাথাব্যথা, আড়ষ্টতাও দেখা যায়। যে কারণে বর্তমানে কোনো খেলোয়াড়ের মাথায় আঘাত লাগার সঙ্গে সঙ্গে ফিজিও এসে তাঁর পরীক্ষা করেন। তার দৃষ্টিশক্তি ঠিক আছে কি না, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখেন। যদি কোনো খেলোয়াড়ের বিন্দুমাত্র সমস্যাও দেখা দেয়, তবে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে মাঠ থেকে উঠিয়ে নেয় টিম ম্যানেজমেন্ট।
‘কনকাশন বদলি’র সঙ্গে সাধারণ বদলির একটি অমিল রয়েছে। ‘কনকাশন বদলি’ হতে হবে লাইক ফর লাইক। অর্থাৎ একজন ব্যাটসম্যানের পরিবর্তে ব্যাটসম্যান, বোলারের পরিবর্তে বোলার, অলরাউন্ডারের পরিবর্তে অলরাউন্ডার নামতে পারবেন। যে খেলোয়াড়কে বদল করা হচ্ছে, ঠিক একই ধরনের ক্রিকেটারকে বদলি হিসেবে নামতে হবে। গতকালের খেলার কথাই ধরা যাক, সৌম্য সরকারের চোটের কারণে খেলার সুযোগ পেয়েছেন তানজিদ হাসান তামিম। সৌম্য সরকার ওপেনার হওয়ায় তাঁর পরিবর্তে ওপেনার নামানোর সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ দল। ধরো যদি সৌম্য সরকারের পরিবর্তে মুস্তাফিজুর রহমান চোট পেতেন, তাহলে কিন্তু এই সুযোগ পেত না বাংলাদেশ। তখন মুস্তাফিজুরের পরিবর্তে একজন বোলারকে মাঠে নামাতে হতো বাংলাদেশকে। তখনো যদি বাংলাদেশের বোলিং বাকি থাকত, তবে সেই বদলি খেলোয়াড় বোলিংয়ের সুযোগ পেতেন। আবার যদি মুশফিকুর রহিমের বদলি হিসেবে মাহেদি হাসান নামতেন, তবে মাহেদি শুধু ব্যাটিং করতে পারতেন, বোলিং নয়। কারণ, মুশফিকুর রহিম শুধু উইকেটকিপার, তিনি বল করেন না।
ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো এই নিয়মের দেখা মেলে ২০১৬ সালে। নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া লিগে প্রথমবারের মতো দেখা যায় কনকাশন বদলি। ২০১৮ সালে কাউন্টি ক্রিকেটেও যোগ করা হয় এই নিয়ম। বেশ কয়েক জায়গায় সাফল্যের পর ২০১৯ সালের ১ আগস্ট আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যুক্ত হয় ‘কনকাশন বদলি’। ক্রিকেটের প্রথম ‘কনকাশন বদলি’ ছিলেন মার্নাস লাবুশেন। ২০১৯ অ্যাশেজের দ্বিতিয় টেস্টে জোফরা আর্চারের বাউন্সারে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন স্টিভ স্মিথ। তার বদলে সুযোগ পেয়েই ৫৯ রানের এক ম্যাচ বাঁচানো ইনিংস খেলেন লাবুশেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। এমনকি বিশ্বকাপের আগেও ‘কনকাশন বদলি’ হিসেবে মাঠে নেমে বিশ্বকাপ দলে নিজের জায়গা নিশ্চিত করেন লাবুশেন।
বাংলাদেশে প্রথম কনকাশন সাব হিসেবে মাঠে নামেন মেহেদি হাসান মিরাজ। ইডেন গার্ডেনসে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে লিটন দাসের বদলি হিসেবে মাঠে নামেন তিনি। যেহেতু লিটন দাস উইকেটকিপার, তাই তাঁর বদলে নামায় পুরো ম্যাচে বোলিংয়ের সুযোগ পাননি তিনি। একই দিনে নাঈম হাসানের পরিবর্তে মাঠে নামতে হয় তাইজুল ইসলামকে। এক দিনে দুই ‘কনকাশন বদলি’ নিয়ে খেলতে হয় বাংলাদেশকে।
যদিও গতকাল সৌম্য সরকারের কনকাশন বদলি হিসেবে তানজিদ হাসানের নামা নিয়ে কিছুটা বিস্মিত হয়েছে শ্রীলঙ্কা দল। কারণ, প্রথমত ফুটেজ দেখে মনে হচ্ছিল, শুধু হাঁটুতেই চোট পেয়েছেন সৌম্য। কিন্তু পরে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ঘাড়ে ব্যথার কথাও উল্লেখ করেন তিনি। পরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিসিবি ফিজিও বায়েজিদ ইসলামের বরাত দিয়ে জানায়, সৌম্যর মাথা আঘাত লেগেছে মাটিতে। ঘাড়ে জড়তা অনুভব করাসহ মাথাব্যথা এবং দৃষ্টির সমস্যার কথাও বলেছেন। এ অবস্থায় কনকাশন বদলির আবেদন করলে সেটি অনুমোদন করেন ম্যাচ রেফারি অ্যান্ডি পাইক্রফট।