২০০৬ বিশ্বকাপ: জিদানের ঢুস ও ইতালিয়ান রূপকথা
‘হিরো থেকে জিরো’—এই কথা কতবার কতভাবেই না শুনেছি আমরা। কিন্তু মুহূর্তের ব্যবধানে এমন ঘটনার সাক্ষী হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল ২০০৬ বিশ্বকাপে। প্রত্যেক মানুষ দেখেছিল, জ্বলতে থাকা নক্ষত্রের খসে পড়া। কীভাবে একজন মুহূর্তেই হয়ে গেলেন হিরো থেকে জিরো।
জিনেদিন জিদানের হিরো হওয়ার গল্প জানতে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। ২০০৪ সালের ইউরো। কোয়ার্টার ফাইনালে স্বাগতিক গ্রিসের কাছে হারার পর জাতীয় দলের জার্সি তুলে রাখার ঘোষণা দিলেন জিদান। তাঁর পথ ধরে আস্তে আস্তে ফ্রান্সের জার্সি তুলে রাখলেন লিলিয়াম থুরাম, ক্লদিও ম্যাকেলেলেও। বড় বড় তারকাদের হারিয়ে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব পার করতে হিমশিম খাচ্ছিল ফ্রান্স। স্বয়ং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জিদানকে অনুরোধ করলেন দলে ফেরার। অনুরোধ করলেন দেশকে বিশ্বকাপে নেওয়ার শেষ চেষ্টা করতে। জিদান সে কথা ফেলতে পারেননি, ফিরলেন অবসর ভেঙে। এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। কোনোমতে শেষ স্থান থেকে দলকে টেনে নিশ্চিত করলেন জার্মানি বিশ্বকাপের টিকিট।
২০০৬-এ জার্মানি বিশ্বকাপ থেকে বদলে যায় ফিফার ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন নিয়ম। দ্বিতীয় বিশ্বকাপ থেকে আসা ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন সরাসরি বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়ে আসছিল। নিয়মটা বাতিল করে ফিফা। অর্থাৎ বিশ্বকাপ জিতলেও খেলতে হবে বাছাইপর্ব। পার না হতে পারলে বিশ্বজয়ীদের ছাড়াই শুরু হবে বিশ্বকাপ মিশন। ২০০৬ বিশ্বকাপ আয়োজনের শেষ দুই প্রার্থী ছিল জার্মানি আর দক্ষিণ আফ্রিকা। সেখানে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে বিশ্বকাপ নিজেদের দেশে নিয়ে আসে জার্মানি। বিশ্বকাপ আয়োজনের ৯ বছর পর ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় এই খবর। তখন বেশ সমালোচনার মুখে পড়ে তারা।
বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে তথৈবচ অবস্থা, অথচ বিশ্বকাপ আসতে না আসতেই জিদান নামক পরশপাথরের ছোঁয়ায় বদলে গেল ফ্রান্সের চিত্র। যদিও গ্রুপ পর্বের প্রথম দুই ম্যাচ ড্র করে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল বসিয়ে দেয় ফ্রান্স। কিন্তু টোগোর বিপক্ষে শেষ ম্যাচ জিতে কোনোমতে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে ফ্রেঞ্চরা।
এর পর থেকে শুরু হয় জিদান–জাদু। রাউল, পুয়োল, ক্যাসিয়াসের স্পেনকে ৩-১ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টারের পথে পাড়ি জমায় ফ্রান্স। সেদিন ফ্রান্সের তিন গোলের একটি ছিল জিদানের। আরেকটি ছিল তাঁর বানিয়ে দেওয়া। কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি পরাক্রমশালী ব্রাজিল। বিশ্বজয়ী ব্রাজিল, যাদের স্কোয়াডে ফর্মের তুঙ্গে থাকা রোনালদো, রোনালদিনহো, কাকা। ফুটবল বিশ্ব অপেক্ষায় ছিল ১৯৯৮ বিশ্বকাপ ফাইনালের পুনরাবৃত্তি দেখার জন্য। কিন্তু সাদা জার্সিতে জিদান যেন ফিরিয়ে আনলেন ১৯৯৮ বিশ্বকাপকেই। জিদান–জাদুতে মুগ্ধ বিশ্ব দেখল কীভাবে পরাক্রমশালী ব্রাজিল লুটিয়ে পড়ল তাঁর পায়ের কাছে। জিদানের বানানো বল থেকে গোল করে সেমি নিশ্চিত করলেন থিয়েরি অঁরি। সেমিতেই সেই একই গল্প। ফিগো-রোনালদোর পর্তুগালকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন জিদান। তাঁর একমাত্র গোলে ফাইনালে ফ্রান্স।
অন্যদিকে মার্সেলো লিপ্পির অধীনে ইতালির উত্থান অনেকটা অবাক করার মতোই ছিল। দলে কিংবদন্তির অভাব নেই বটে, কিন্তু গত কয়েক বিশ্বকাপ ধরেই তীরে এসে তরি ডুবছিল ইতালির। তাই মার্সেলো লিপ্পি গতানুগতিক ইতালিয়ান ডিফেন্সিভ ধরন থেকে বেরিয়ে নজর দিলেন আক্রমণে। ফলাফল মিলল হাতেনাতে। টট্টি, লুকা টনি, দেল পিয়েরোর মতো আক্রমণাত্মক লাইনআপকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন লিপ্পি। ফলাফল—প্রতি ম্যাচেই গোলের দেখা পেয়েছে ইতালি। অস্ট্রেলিয়া, ইউক্রেন, জার্মানিকে হারিয়ে পথ খুঁজে নিয়েছে ফাইনালের। বিপত্তিটা বাধল সেখানেই।
ইতালিয়ান ডিফেন্সের কাছে বাকি সবাইকে আটকানোর টোটকা আগে থেকেই ছিল। বাধা ছিলেন একজন—জিনেদিন জিদান। অথচ জিদানের ইউরোপিয়ান ফুটবলে রাজত্বের সূচনা হয়েছিল এই লিপ্পির অধীনেই। সেখান থেকে বহুদূর পাড়ি দিয়েছেন জিদান, ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে স্বপ্ন শুধু আরেকবার বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেখার। আর লিপ্পির লক্ষ্য যেকোনো মূল্যে সেটাকে আটকানো।
ম্যাচের ৭ মিনিটেই পেনাল্টি থেকে লিড নিয়ে নিলেন জিদান। তা–ও যে–সে পেনাল্টি নয়, বিশ্বের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক বুফনের বিপক্ষে বিশ্বকাপ ফাইনালে ‘পানেনকা’ মারার দুঃসাহস দেখালেন জিদান। ১৯ মিনিটে ইতালিকে সমতায় ফেরালেন ইতালিয়ান ডিফেন্ডার মার্কো মাতারাজ্জি। কিন্তু কে জানত, বহু বছর পরও এই দুজনের কীর্তি থাকবে লোকের মুখে মুখে?
ম্যাচের ১১০ মিনিট চলছে। অনেকক্ষণ ধরেই জিদানকে খেপিয়ে তুলছিলেন ইতালিয়ান ডিফেন্ডাররা। এমনই এক সময় মাতারাজ্জি জিদানের পরিবারকে জড়িয়ে কটু কথা বলে ওঠেন। নিজের মেজাজ সামলাতে না পেরে মাতারাজ্জির বুকে ঢুস মেরে বসেন জিদান। লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন তিনি। হাতছোঁয়া দূরত্বে বিশ্বকাপ রেখে ফেরত আসেন জিদান। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের শেষটা হয়ে রয়েছে বিতর্ক দিয়ে।
অতিরিক্ত সময়েও নিজেদের স্নায়ু ধরে রাখতে পেরেছিল ফ্রান্স, কিন্তু টাইব্রেকারে গিয়ে আর সম্ভব হয়নি তা। ডেভিড ত্রেজেগের মিসে ৫-৩ গোলে হেরে বিশ্বকাপ না নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয় ফ্রান্সকে।
২০১০ বিশ্বকাপ: টিকিটাকার জয়
বিশ্বকাপ শুরুর ৮০ বছরের মাথায় এসে নিজের নামের সার্থকতা যেন প্রমাণ করতে পারল ফিফা। বিশ্বকাপের সূচনা হয়েছিল লাতিন আমেরিকা আর ইউরোপকে অংশীদার করে। আস্তে আস্তে তা ডানা মেলেছে উত্তর আমেরিকা, এশিয়াতেও। কিন্তু ভেন্যু হিসেবে কখনো আফ্রিকা ভ্রমণের স্বাদ পায়নি বিশ্বকাপ। সেটাই সম্ভব করেছিল ২০১০ বিশ্বকাপ।
২০১০ বিশ্বকাপের ভেন্যু হতে চলেছে আফ্রিকা, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। আফ্রিকার পাঁচ দেশ থেকে বেছে নেওয়া হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। কিন্তু এর পেছনেও ছিল প্রচুর জল্পনা-কল্পনা। প্রথমত, ২০০৬ বিশ্বকাপ জার্মানিতে নেওয়ার পেছনে অনেক বড় হাত ছিল ফিফা সভাপতি স্লেপ ব্লাটারের। ২০১০ বিশ্বকাপেও অর্থের বিনিময়ে বিশ্বকাপ দক্ষিণ আফ্রিকায় নেওয়ার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিপক্ষে। যে অভিযোগে ২০১৫ সালে শাস্তিও পেতে হয় তাঁকে।
বিশ্বকাপের ভেন্যু নিয়ে যত দুর্নীতিই হোক না কেন, আয়োজনে বিন্দুমাত্র কমতি রাখেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। বিশ্বকাপের আগেই পৃথিবীজুড়ে সাড়া ফেলে ভুভুজেলা। আফ্রিকান ঐতিহ্যের সঙ্গে ফুটবল, সব মিলিয়ে যে বিশাল আয়োজনের অপেক্ষায় ছিল বিশ্ব, ঠিক সেটাই করে দেখিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
বিশ্বকাপে ভুভুজেলার পাশাপাশি আর কিছুর যদি উত্থান হয়, তবে সেটা ছিল টিকিটাকা। ইয়োহান ক্রুইফের যোগ্য উত্তরসূরি পেপ গার্দিওলার হাত ধরে ক্লাব ফুটবলে চালু হয়েছিল টিকিটাকা। আর স্পেনের হাত ধরে তা পৌঁছে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক ফুটবলেও। টোটাল ফুটবলের পর এই প্রথম কোনো ট্যাকটিস গ্রাস করে নিয়েছিল পুরো বিশ্বকে। ছোট ছোট পাসে বল নিজেদের কাছে রেখে পুরো মাঠকে নিজেদের অধীনে নিয়ে আসা—সফলভাবে এর আগে এমনটা করতে পারেনি কেউই। কিন্তু স্পেন সেটাই করে দেখিয়েছিল।
ভিসেন্তে দেল বস্কের অধীনে স্প্যানিশ দল ছিল আগাগোড়া প্রতিভায় ভরপুর। ডিফেন্সে রামোস-পিকে-পুয়োল, মাঝমাঠে জাভি-ইনিয়েস্তা-বুসকেটস-জাবি আলান্সো আর আক্রমণে ডেভিড ভিয়া আর ফার্নান্দো তোরেস। কিন্তু এত কিছুর মাঝেও বিশ্বকাপের সব আলো কেড়ে নিয়েছিলেন গোলবারের নিচে দাঁড়ানো অধিনায়ক ইকার ক্যাসিয়াস। ফেবারিট হিসেবেই বিশ্বকাপে প্রবেশ স্পেনের।
কিন্তু সবকিছু থমকে গেল প্রথম ম্যাচেই এসে। সুইজারল্যান্ডের কাছে প্রথম ম্যাচে হেরে স্পেন হোঁচট খেল প্রথম রাউন্ডেই। কম কথা হয়নি তা নিয়ে। সমালোচনা হয়েছে অধিনায়ক ক্যাসিয়াসকে নিয়েও।
পরের ম্যাচ থেকেই শুরু হয় ক্যাসিয়াসের দুরন্ত ফর্ম। একজন গোলরক্ষক যে পুরো টুর্নামেন্টের চিত্র পাল্টে দিতে পারেন, তার প্রমাণ ছিল ২০১০ বিশ্বকাপ। শেষ ষোলোতে পর্তুগালের বিপক্ষে ম্যাচজয়ী সেভ, কোয়ার্টার-ফাইনালে প্যারাগুয়ের বিপক্ষে পেনাল্টি সেভ আর সেমিতে জার্মানির বিপক্ষে টনি ক্রুসের দূরপাল্লার শট—ক্যাসিয়াস হয়ে ছিলেন বিশ্বকাপের মাসকট।
অন্যদিকে ব্রাজিল-উরুগুয়েকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে এসেছিল নেদারল্যান্ডস। টোটাল ফুটবলের জনক এবার মুখোমুখি টিকিটাকার। ফুটবল বদলে দেওয়া দুই ধরন এবার মুখোমুখি। আর সেই প্রশ্নে উত্তর হয়ে এলেন ইকার ক্যাসিয়াস।
জোহানেসবার্গের সকার সিটি স্টেডিয়ামের ফাইনালে দেখা মেলে নেদারল্যান্ডসের ফিজিক্যাল ফুটবলের। দুইবার ফাইনাল হেরে ডাচরা যেন বুঝে গিয়েছিল, সুন্দর ফুটবলের থেকে বিশ্বকাপ জেতা বেশি জরুরি। হয়তো সে জন্যই সুন্দর ফুটবল ছেড়ে ফিজিক্যাল ফুটবলে মনোযোগ। রেফারি হাওয়ার্ড ওয়েবকে ১৪ বার হলুদ কার্ড বের করতে হয়েছিল সেদিন। বারবার আক্রমণ করেও সেদিন ফল পায়নি নেদারল্যান্ডস।
কারণ একটাই, ইকার ক্যাসিয়াস। রোবেন, স্নাইডার, ভ্যান পার্সিদের একের পর এক শট একাই থামিয়ে দিয়েছিলেন ক্যাসিয়াস। বিশেষ করে ৬৬ মিনিটে রোবেনের থামিয়ে দেওয়া সেভকে বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা সেভ বললেও ভুল হবে না। আর নেদারল্যান্ডসের কফিনে শেষ পেরেকটা ছিল আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার। ১১০ মিনিটে করা সেই গোল প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ এনে দেয় স্পেনের হাতে। অধিনায়ক ক্যাসিয়াসের হাতে ওঠে ট্রফি। ১২ বছর পর নতুন বিশ্বজয়ীর দেখা পায় ফুটবল বিশ্ব।