ক্যারিয়ারজুড়েই সাফল্যের দেখা পেয়েছেন নোভাক জোকোভিচ। প্রতিনিয়ত ছাড়িয়ে গেছেন একেকটা রেকর্ড। সাফল্য পেতে পেতে এমন চূড়ায় এসে পৌঁছেছেন, যেখানে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। ফ্রেঞ্চ ওপেন জয় করে সবচেয়ে বেশি ২৩টি গ্র্যান্ড স্লাম জয়ের রেকর্ড গড়েছেন এই সার্বিয়ান তারকা। ছাড়িয়ে গেছেন টেনিসের দুই কিংবদন্তি রজার ফেদেরার এবং রাফায়েল নাদালকেও। তবে টেনিস ইতিহাসের শীর্ষে উঠেও তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত! বুনো উদ্যাপনে অভ্যস্ত ও সদাচঞ্চল জোকোভিচ সবাইকে ছাড়িয়ে উদ্যাপনটা করলেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল, সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্লাম জেতার স্বপ্ন পূরণ হবে না জোকোভিচের। ফেদেরার-নাদালের খুব কাছাকাছি পৌঁছেও গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু হাতের কাছে থাকা রেকর্ডটাকেও মনে হচ্ছিল অনেক দূরের। রাফায়েল নাদালের বিপক্ষে রোলাঁ গ্যাঁরোর ফাইনালে কোনো প্রতিরোধই গড়তে পারেননি। অস্ট্রেলিয়ায় বিমানবন্দর থেকে তাঁকে ফেরত পাঠানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বলা হয়েছে করোনার ভ্যাক্সিন না নিলে দেশে প্রবেশ মানা। একের পর এক গ্র্যান্ড স্লাম খেলতে না দেওয়া আর পরাজয়ের পর মনেই হচ্ছিল, জোকোভিচের স্বপ্নটা স্বপ্নই রয়ে যাবে। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের জন্য একা যুদ্ধ করা তো তাঁর কাছে নতুন কিছু নয়। বরং খুব ছোটবেলা থেকে একাই লড়ে এসেছেন তিনি।
নোভাকের যুদ্ধটা আজীবন একারই ছিল। বেলগ্রেদের রাস্তায় যখন মৃত্যু দুয়ারে দুয়ারে কড়া নাড়ত, তখন টেনিস র্যাকেটই ছিল নোভাকের একমাত্র বন্ধু। যুদ্ধবিধ্বস্ত সার্বিয়া থেকে উঠে এসেছেন তিনি। জীবন ঠিক কতটা কঠিন হতে পারে, তা একেবারে ছোটবেলাতেই জেনেছেন তিনি। তাই তো বাস্তব জীবনের সঙ্গে টেনিসকে মেলাতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি তাঁকে। শুরুতেই তাঁকে টেনে দুই পা পেছনে ফেলে দেওয়া যেন জীবনের নিয়তি।
টেনিস কোর্টে যখন নিজের আলো ছড়াতে শুরু করলেন, তখন থেকেই তিনি তৃতীয় ব্যক্তি। টেনিসের দুই ঘোড়ার দৌড়ে তিনি ছিলেন ৩ নম্বর। তত দিনে টেনিসের সমার্থক শব্দ হয়ে উঠেছেন রজার ফেদেরার। হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছেন টেনিস–বিশ্বকে। আর তাঁর হাত গলে বেরিয়ে যাওয়া একমাত্র তারকা রাফায়েল নাদাল। একটা সময় ছিল, যখন কোর্টে পা রাখার আগেই নিজের নাম পরাজিত সৈনিকের খাতায় লিখে মাঠে নামত প্রতিপক্ষ। জোকোভিচই প্রথম খেলোয়াড়, যাঁর কাছে ছিল ‘ফেদাল’ প্রশ্নের উত্তর। জোকোভিচই প্রথম এই দুই কিংবদন্তির চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পেরেছেন। নিজেকে গড়ে তুলতে পেরেছেন সমকক্ষ হিসেবে। আর সেটাই কাল হয়েছে এই সার্বিয়ানের জন্য।
সম্পর্কে তৃতীয় ব্যক্তিকে কে কোনকালে ভালো চোখে দেখেছেন? মিডিয়া থেকে শুরু করে দর্শক–সমর্থক সবাই যখন ফেদেরার–নাদালের জোয়ারে ভাসতে ব্যস্ত, তখন কোথাকার এক সার্বিয়ানের টেনিস–বিশ্বে হম্বিতম্বি করা কারই–বা পছন্দ হবে? জোকোভিচের ক্যারিয়ারের উত্থানটাই এমন সময়ে, যখন সবাই মশগুল ফেদেরার ক্ল্যাসিক্যাল টেনিসে নতুবা নাদালের হার না–মানা মানসিকতায়। জোকোভিচের একঘেয়ে, রক্ষণাত্মক টেনিস তখন অনেকেরই অপছন্দ। যে কারণে তাঁর ভক্তকূল যেভাবে উপচে পড়ার কথা ছিল, তার কোনোটাই হয়নি। বরং বিশাল একটা সময় তিনি ছিলেন নাদাল-ফেদেরারের ছায়ায়। গ্র্যান্ড স্লামের পর গ্র্যান্ড স্লাম জিতেও পত্রপত্রিকায় কথা হতো শুধু ‘ফেদাল’ নিয়েই।
জোকোভিচের জন্য গত তিন বছর ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। করোনাকালে ভ্যাক্সিন না নেওয়া, করোনার রেড অ্যালার্ট ভেঙে টুর্নামেন্ট নামানো, এমনকি ভ্যাক্সিন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে দফায় দফায় বিতর্কে জড়িয়েছেন। ভ্যাক্সিন না নেওয়ায় নিষিদ্ধ হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান ও ইউএস ওপেন থেকে। লাইনসম্যানের মুখে বল মেরে নিশ্চিত একটি গ্র্যান্ড স্লাম হারিয়েছেন। বলতে গেলে পথ যতটা না কঠিন ছিল, তার থেকেও হাজার গুণ কঠিন বানিয়েছেন নিজের দোষে।
নিজের দোষ শুধরেছেন, ফিরেছেন নিজের সেরা ফর্মে। এবারের ফ্রেঞ্চ ওপেনেই ছিল সূবর্ণ সুযোগ। ফেদেরার তো নেই কবে থেকেই, নাদালও নিজের নাম উঠিয়ে নিয়েছেন চোটের কারণে। এর ফলে জোকোভিচের সামনে সুযোগ ছিল সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। আর সেটাই করলেন। এবারের ফ্রেঞ্চ ওপেনের গল্পটা বেশ সাধারণ, জোকোভিচ এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। এক আলকারাজ বাদে তাঁর বিপক্ষে প্রতিরোধও দাঁড় করাতে পারেননি কেউ। ক্যাস্পার রুডকে সরাসরি সেটে হারিয়ে রেকর্ডবুকে ছাড়িয়ে গেলেন সবাইকে। কিন্তু এত রেকর্ড গড়েও পাদপ্রদীপের আলোর নিচেই থাকলেন তিনি। ২৩তম গ্র্যান্ড স্লামটাও জিতলেন অনেকটাই চুপিসারে।
কবিগুরু লিখেছিলেন, ‘কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা।’ জোকোভিচকেও ভাগ্য ফেরায়নি। তাই তো তাঁর ফিরে আসাটাও হয়েছে দেখার মতো। ফেদেরারকে ছাড়িয়েছেন ফেদেরারের প্রিয় মঞ্চে। নিজের ২১তম গ্র্যান্ড স্লাম জিতেছেন উইমবল্ডনে। আর নাদালকে ছাড়িয়েছেন নাদালের প্রিয় মঞ্চে, রোলাঁ গ্যাঁরোয়। সবাইকে ছাড়িয়ে জোকোভিচ এখন একা।
নোভাক জোকোভিচ কি তবে সর্বকালের সেরা টেনিস খেলোয়াড়? পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে, অবশ্যই। প্রতিটি কোর্টে তাঁর সাফল্য আকাশছোঁয়া। ক্যারিয়ারে এমন কোনো শিরোপা নেই, যাতে চুমু খাননি তিনি। ফেদেরার-নাদালের জীবনেও আক্ষেপ আছে, কিন্তু জোকোভিচের নেই। দুই ঘোড়ার দৌড়ে তৃতীয় হয়ে শুরু করা ব্যক্তিটাই আজ প্রথম।