কার মাথায় ইউরোপের মুকুট

দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ যদি হয় বিশ্বকাপ, তাহলে দ্য গ্রেটেস্ট শো অন ইউরোপ কী? ইউরো বা ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপকে এই তকমা দেওয়াই যায়। যে টুর্নামেন্টে জার্মানি, ইতালি, ইংল্যান্ড, স্পেন, ফ্রান্স, পর্তুগালের মতো দল খেলে, সেটিকে বিশ্বকাপের পর অন্যতম আকর্ষণীয় টুর্নামেন্টও বলবেন অনেকে। ২০২১ সালের পর সেই টুর্নামেন্ট এই বছর শুরু হচ্ছে জুনের মাঝামাঝি। মুখোমুখি হবে ২৪টি দল, জার্মানিতে ঠিক হবে এবার কে হবে ইউরোপের রাজা, ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইতালি নাকি অন্য কেউ?

কীভাবে এল ইউরো

ইউরো বা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হওয়ার ঘটনাও বেশ মজার। বিশ্বকাপ বা কোপা আমেরিকার মতো পুরোনো আসর নয় ইউরো, শুরু হয়েছে মাত্র ১৯৬০ সাল থেকে। যেখানে বিশ্বকাপের বয়স ইউরোর চেয়ে ৩০ বছর বেশি, আর কোপা আমেরিকা তো ১০০ বছরের বেশি পুরোনো আসর। কিন্তু ইংল্যান্ড যেখানে ফুটবলের আঁতুড়ঘর, সেই ইউরোপের মহাদেশীয় আসর শুরু হতে এত দেরি হলো কেন?

আসলে ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের মধ্যে টুর্নামেন্ট খেলত অনেক আগে থেকেই। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও আয়ারল্যান্ড মিলে ‘ব্রিটিশ হোম চ্যাম্পিয়নশিপ’ নামে টুর্নামেন্ট খেলত সেই ১৮৮৩ সাল থেকে। বিশ্বকাপ শুরুর আগে এটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। ওদিকে মধ্য ইউরোপের অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ইতালি, চেকস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া, সুইজারল্যান্ড নিজেদের মধ্যে ‘সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কাপ’ নামে একটা টুর্নামেন্ট শুরু করল। ১৯২৭ সাল থেকে সেটা শুরু হয়ে সেটা চলেছিল ইউরো শুরুর আগপর্যন্ত।

ইউরোর পরের আসরে অংশ নেওয়া দেশের সংখ্যা বেড়ে ২৯ হলো, কিন্তু জার্মানি সেবারও অংশ নেয়নি। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ইউরো এভাবে বাছাইপর্ব ও চূড়ান্তপর্ব—এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে প্রথম ৮ দলের গ্রুপ পর্ব শুরু হয় আর ১৯৯৬ সাল থেকে ১৬টি দেশ অংশ নিতে শুরু করে। যেটা ২০১৬ ইউরোতে বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ দলে। এবারও ২৪টি দল ছয়টি গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলবে শুরুতে।

ইউরোপের সব দেশ মিলে একটা টুর্নামেন্ট হওয়া উচিত, সেটা প্রথম মাথায় এল ফ্রান্স ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হেনরি দেলানুইয়ের। ১৯২৭ সালে প্রথম এই ধারণা দেন তিনি। কিন্তু তাঁর অনেক চেষ্টার পরও নানান প্রতিবন্ধকতায় জীবিত অবস্থায় এই টুর্নামেন্ট শুরু দেখে যেতে পারেননি। ১৯৫৭ সালে দেলানুই মারা যাওয়ার তিন বছর পর ১৯৬০ সালে শুরু হয় ইউরো। দেলানুইয়ের সম্মানে ইউরো ট্রফির নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নামে।

তবে ১৯৬০ সালে প্রথম ইউরো শুরুর আসরেও হয়েছে অনেক নাটক। ১৯৫৮ সালে গোড়াপত্তনের পর সদস্যসংখ্যা ছিল ৩৩। কিন্তু প্রথম আসরে খেলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বসল এই ৩৩টি দেশের ১৬টিই। এর মধ্যে আছে পশ্চিম জার্মানি, ইংল্যান্ড, ইতালি, নেদারল্যান্ডসের মতো দল। তাই ১৭টি দল নিয়েই শুরু হয় ইউরো।

ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম চ্যাম্পিয়ন সোভিয়েত ইউনিয়ন
ছবি: সংগৃহীত

এখনকার মতো গ্রুপ পর্ব ছিল না প্রথমবারের ইউরোতে। দলগুলো নিজেদের মধ্যে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়েতে মুখোমুখি হলো প্রথম তিন রাউন্ডে—বাছাইপর্ব, রাউন্ড অব সিক্সটিন এবং কোয়ার্টার ফাইনালে। সেখান থেকে চারটি দল উঠল সেমিফাইনালে। সেমিফাইনাল থেকে ধরা হতো ইউরোর মূল পর্ব, টেকনিক্যালি তাই মাত্র চারটি দল অংশ নিয়েছিল প্রথম ইউরোতে। সেমি হলো এক লেগেরই, এরপর ফাইনাল। সেমিফাইনাল ও ফাইনালের ম্যাচগুলো হয়েছিল ফ্রান্সে।

আরও পড়ুন

প্রথম আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন, তবে অনেক নাটকের পর। সে সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ইউরোপের অন্যতম পরাশক্তি। সর্বকালের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক লেভ ইয়াশিন খেলতেন সেই দলে। কোয়ার্টার ফাইনালে সোভিয়েতের প্রতিপক্ষ স্পেন, কিন্তু স্পেন ম্যাচটা খেলতে অস্বীকৃতি জানায়। তখনকার স্পেনের রাষ্ট্রনায়ক ফ্রাঙ্কো ভয় পাচ্ছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের বড় ব্যবধানে হারিয়ে দেবে। সোভিয়েতরা তাই ওয়াকওভার পেয়ে কোয়ার্টার না খেলেই সেমিতে চলে যায়। সেখানে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় চেকস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া ও ফ্রান্স। মজার ব্যাপার, ফ্রান্স ছাড়া বাকি দলগুলো ছিল পূর্ব ইউরোপের। ফাইনালে ওঠে যুগোস্লাভিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়ন, আর লেভ ইয়াশিনের সোভিয়েতই হাসল শেষ হাসি।

ইউরোর পরের আসরে অংশ নেওয়া দেশের সংখ্যা বেড়ে ২৯ হলো, কিন্তু জার্মানি সেবারও অংশ নেয়নি। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ইউরো এভাবে বাছাইপর্ব ও চূড়ান্তপর্ব—এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে প্রথম ৮ দলের গ্রুপ পর্ব শুরু হয় আর ১৯৯৬ সাল থেকে ১৬টি দেশ অংশ নিতে শুরু করে। যেটা ২০১৬ ইউরোতে বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ দলে। এবারও ২৪টি দল ছয়টি গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলবে শুরুতে। এরপর শেষ ১৬, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল শেষে ফাইনালে ঠিক হবে কে নেবে ইউরো। এবার জর্জিয়াই একমাত্র দল, যারা প্রথমবারের মতো খেলছে এই টুর্নামেন্ট।

বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইতালি
ছবি: সংগৃহীত

ইউরোর একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানে অঘটন বা আপসেট অন্য মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট বা বিশ্বকাপের তুলনায় বেশিই হয়েছে। ১৯৯২ সালের ডেনমার্কের ইউরো জেতা ফুটবলের রূপকথার অংশই। ডেনমার্কের আদতে সেবার ইউরোতে অংশ নেওয়ারই যোগ্যতা হয়নি। শেষ মুহূর্তে রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় যুগোস্লাভিয়া বাদ পড়ায় ডেনমার্কের কপাল খুলে যায় আর তারা টুর্নামেন্টই জিতে বসে। ২০০৪ ইউরোতে গ্রিসের জেতা তেমনি আরেক ফুটবল রূপকথা। জার্মানি, পর্তুগাল, ফ্রান্সের মতো ফেবারিটদের টপকে সেবার ইউরো জিতে নেয় গ্রিকরা। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে তাদের কেউ গোনাতেই ধরেনি। অথচ ২০১২ সালে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার পর আর ইউরোই খেলতে পারেনি গ্রিস।

এবার তাহলে ফেবারিট কে

এবার কি তাহলে ইউরোতে গ্রিস বা ডেনমার্কের মতো কোনো রূপকথা দেখা যাবে? বলা খুব কঠিন। তবে টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ঐতিহ্যবাহী পরাশক্তিদের দিকেই এবার পাল্লাটা ভারী। ফ্রান্সের কথাই ধরো, গত ১০ বছরে তারা তিনটি বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলেছে, এর মধ্যে আছে দুটি বিশ্বকাপ ও একটি ইউরো। ২০২২ বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠা দলটি এবারও বেশ শক্তিশালী আর তাদের কোচ দিদিয়ের দেশম বহুদিন ধরে এই দলকে আগলে আছেন। প্রতিটা পজিশনেই বিশ্বসেরা একাধিক খেলোয়াড় আছে তাদের।

টানা দুবার ইউরো জেতার কীর্তি আছে স্পেনের
ছবি: সংগৃহীত

তবে কাগজে–কলমে এই ইউরোর আগে সবচেয়ে বেশি মাতামাতি এখন ইংল্যান্ডকে নিয়ে। এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার জুড বেলিংহামকে নিয়ে ইংল্যান্ডের এবারের দলটা বেশ শক্তিশালী। গত ইউরোতে তারা ফাইনালে গিয়েও টাইব্রেকারে হেরে যায়, কোচ গ্যারেথ সাউথগেট এবার চাইবেন যেকোনো মূল্যে ট্রফিটা ঘরে আনতে। ১৯৬৬ বিশ্বকাপের পর যে আর কোনো বড় শিরোপা জেতা হয়নি ইংলিশদের!

আরও পড়ুন

জার্মানির কথা ভুলে গেলে চলবে কীভাবে? এবারের ইউরোর স্বাগতিক তারা আর বড় টুর্নামেন্টে তারা কতটা অদম্য, সবাই জানে। স্পেনের সঙ্গে ইউরোর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি শিরোপাও তাদের। জুলিয়ান নাগেলসমানের দলে তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার বেশ ভালো ভারসাম্য আছে, আর নিজেদের চেনা পরিবেশে খেলার সুবিধা তো তাদের আছেই।

রোনালদো
ছবি: সংগৃহীত

ইতালি ইউরোর ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন, যদিও গত বিশ্বকাপেই তারা কোয়ালিফাই করতে পারেনি। বড় কোনো তারকা না থাকাটা ইতালির জন্য একটা চিন্তার জায়গা, তবে ফুটবল তো শেষ পর্যন্ত দলীয় খেলা। স্পেনের দিকেও চোখ রাখতে হবে, টানা দুবার ইউরো জেতার কীর্তি একমাত্র তাদেরই আছে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল ২০১৬ সালে ইউরো জিতেছিল, এবার নতুন কোচ রবার্তো মার্টিনেজের অধীনে শক্তিশালী একটা দল নিয়েই যাচ্ছে তারা। এর বাইরে চমকে দিতে পারে নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়া বা অন্য কোনো দল। ইউরোর ইতিহাসই তো কালো ঘোড়াদের পক্ষে!

মাঠ মাতাবেন কারা

২০২২ বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা ফুটবলার কিলিয়ান এমবাপ্পের ওপর এখন চোখ থাকবে সবার। এই ট্রফিটা এখনো পাওয়া হয়নি তাঁর, পিএসজি ছাড়তে চলা এই ফরোয়ার্ড বড় টুর্নামেন্টে ফ্রান্সের হয়ে সব সময়েই দুর্দান্ত। এমবাপ্পে ছাড়াও ফ্রান্সের তুরুপের তাস হতে পারেন আঁতোয়ান গ্রিজমান। বড় আসর মানেই গ্রিজমানের জ্বলে ওঠা। জুড বেলিংহামের কথা আগেই বলা হয়েছে, রিয়াল মাদ্রিদের এই মিডফিল্ডার ইংল্যান্ডের বড় ভরসা। এ ছাড়া ইংল্যান্ডে আরও একঝাঁক প্রতিভাবান ফুটবলার আছেন। এবারের প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়া ম্যান সিটির ফিল ফোডেন আছেন ইংল্যান্ডে। আছেন সদ্যসমাপ্ত প্রিমিয়ার লিগের সেরা তরুণ খেলোয়াড় চেলসির ফরোয়ার্ড কোল পালমার। আর আক্রমণে হ্যারি কেইন তো সব সময়েই বড় ভরসার জায়গা, তাঁর ক্লাব বায়ার্ন এবার খুব ভালো না করলেও কেইন গোল করেই যাচ্ছেন।

লুকা মদ্রিচ
ছবি: সংগৃহীত

জার্মানির দুই তরুণ প্লেমেকার লেভারকুসেনের ফ্লোরিয়ান ভির্টজ এবং বায়ার্নের জামাল মুসিয়ালার দিকে এবার চোখ থাকবে অনেকের। এই দুই তরুণকে মনে করা হচ্ছে এবারের ইউরোর দুই ‘ব্রেকআউট স্টার’। টনি ক্রুস এবারের ইউরো দিয়েই ইতি টানছেন ফুটবল ক্যারিয়ারের, নিজের বিদায়ী টুর্নামেন্ট তিনি রাঙাতে নিশ্চয় চাইবেন। স্পেনের বড় ভরসা হতে পারেন ম্যান সিটির মিডফিল্ডার রদ্রি। এ ছাড়া বার্সেলোনার তরুণ স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড লামিন ইয়ামাল কেমন করেন, সেটা নিয়েও আগ্রহ থাকবে অনেকের। ইতালির সেই অর্থে বড় তারকা নেই, পিএসজি গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি দোন্নারুম্মার দিকেই চোখ থাকবে অনেকের। পর্তুগালে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো তো আছেনই, সঙ্গে চোখ রাখতে হবে ব্রুনো ফার্নান্দেজ ও বের্নার্দো সিলভার ওপর। দল হিসেবে বেলজিয়াম তাদের সেরা সময় পেছনে ফেলে এলেও কেভিন ডি ব্রুইনা সিটির হয়ে এখনো দারুণ, এই ইউরোতে তাঁর ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে বেলজিয়ামের ভাগ্য। ক্রোয়েশিয়া ইউরোতে খুব ভালো না করলেও তাদের অধিনায়ক লুকা মদরিচের এটাই হয়তো শেষ বড় আসর। ক্লাব সতীর্থ ক্রুসের মতো ব্যালন ডি’অরজয়ী মদরিচও চাইবেন ইউরোতে নিজের জাতটা আরেকবার চেনাতে।

তবে এত তারার মধ্যেও ইউরোতে নেই ম্যান সিটি স্ট্রাইকার আর্লিং হলান্ড, তাঁর দল নরওয়ে যে ইউরোর বাছাইপর্বই পার হতে পারেনি। আর চোটের থাবা তো যে কাউকেই ছিটকে দিতে পারে যেকোনো সময়।

তবে ফুটবলপ্রেমীরা আশায় থাকবেন প্রিয় তারকাদের সবাইকে ফিট হয়ে মাঠে দেখার। প্রায় এক মাসের দুর্দান্ত এই ফুটবলযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কে জেতে, সেটা নিয়েই চলবে জল্পনাকল্পনা।

আরও পড়ুন