ইয়ুর্গেন ক্লপ: একজন সাধারণ মানুষ

লিভারপুলের বিদায়ী কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপএএফপি

লিভারপুলের সমর্থকেরা কখনো নিভে যায় না। প্রতিটি মৌসুম আসে, প্রতি সপ্তাহে প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ আর সঙ্গে আসে লালদের জোয়ার। গানে গানে, আনন্দ উদ্‌যাপনে থরথর করে কাঁপতে থাকে এনফিল্ড। একসময় শেষ হয় ম্যাচ। কখনো হার, কখনো জয় আবার কখনো পয়েন্ট ভাগাভাগি। কিন্তু কোনো ঘটনাতেই দমে যান না লিভারপুলের সমর্থকেরা। পরের সপ্তাহেই মাঠে আসেন নতুন উদ্যমে, নতুন শক্তিতে। কিন্তু মাঝেমধ্যেই কোথায় যেন সুর কেটে যায়, বুকের মধ্যে খচখচ করে। প্রিমিয়ার লিগের নামকরণ হওয়ার পর তাদের একটা শিরোপাও নেই। এই কথা মনে হতেই কষ্টটা যেন আরও বেড়ে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে স্টিভেন জেরার্ডের হোঁচট। সেই কবে রাফায়েল বেনিতেজ এনে দিয়েছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগের স্বাদ। এরপর তো প্রিমিয়ার লিগের তালিকায় সেরা চারে শেষ করতে ধুঁকতে হয় তাদের, ইউরোপিয়ান মঞ্চকে ছুঁয়ে দেখা তো বহু দূরের কথা।

২০০৯–১০ মৌসুমে লিভারপুলকে লিগের তালিকায় সাতে রেখে বিদায় নিলেন ম্যানেজার রাফায়েল বেনিতেজ। নতুন ম্যানেজারের আসনে এলেন স্যার কেনি ডালগ্লিশ; যাঁর হাত ধরেই ৮৯–৯০ মৌসুমে শেষবার প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতেছিল লিভারপুল। তাঁর অধীনে পর পর দুই মৌসুম লিগে ষষ্ঠ আর অষ্টম স্থান খুঁজে নিল দলটা। দুই মৌসুম কোচিং করিয়ে ডালগ্লিশ তাঁর জায়গা ছেড়ে দিলেন, দায়িত্ব গেল ব্রেন্ডন রজারসের হাতে। তাঁর অধীনেও বদলাল না ক্লাবের ভাগ্য। আবারও সপ্তম হয়ে লিগ শেষ করল লিভারপুল। টানা চার মৌসুম দলটা চ্যাম্পিয়নস লিগের মঞ্চে নেই।

এক প্রজন্ম বৃদ্ধ হয়, নতুন প্রজন্ম আসে; ফুটবলকে বুঝতে চেষ্টা করে। দিন শেষে তাঁদেরও একই প্রশ্ন! এই ক্লাব কি কখনো শিরোপা জেতে না? ক্লাবের অ্যান্থেম ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন।’ কিন্তু দিন শেষে তো তাদের একাই হাঁটতে হয়, শূন্য হাতে।

ইয়ুর্গেন ক্লপ
ছবি: মেট্রো

ব্রেন্ডন রজার্সের ওপর আর ভরসা করতে না পেরে ২০১৫ সালের ৮ অক্টোবর বরুশিয়া ডর্টমুন্ড থেকে একজন ম্যানেজার নিয়োগ দেয় লিভারপুল। ব্লন্ড চুল আর মোটা ফ্রেমের চশমা পরা এক জার্মান আসেন এনফিল্ডে। সাদা ঝকঝকে দাঁতে চওড়া হাসি লেগে থাকা এই জার্মান কোচকে ইউরোপের সবাই চেনে। ইয়ুর্গেন ক্লপ—এই নামটাই তো বুন্দেসলিগায় বায়ার্ন মিউনিখে রাজত্বতে কামড় দিয়ে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে নিয়ে গিয়েছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের মঞ্চে।

আরও পড়ুন

ক্লপ বড় হয়েছেন জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্টগাছ আর পর্বত দিয়ে ঘেরা এক গ্রামে। গ্রামীণ সবুজ পরিবেশে বেড়ে ওঠা বলেই ব্যক্তিগত জীবনে ক্লাব বেশ বিনয়ী একজন মানুষ। ম্যানেজার হিসেবে প্রথম যেদিন এনফিল্ডে এসেছিলেন, ক্লাবের ‘দিস ইজ এনফিল্ড’ লেখা প্রবেশদ্বার ছুঁয়ে সংবাদ সম্মেলনে ঢুকে জানিয়েছিলেন সেই কথাই। হাসিমাখা মুখে বলেছিলেন, ‘আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ।’ তবে নিজের সাবেক ক্লাবের কথা টেনে সেদিন আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনিয়েছিলেন ক্লপ। ‘আপনি যখন কোচ হয়ে আসেন, তখন সবাই কী ভাবে, সেটা মুখ্য নয়। কিন্তু যখন আপনি বিদায় নেবেন, তখন সবাই কী ভাবছে ওই ব্যাপারটা মুখ্য।’ ডর্টমুন্ডে থাকা সময়েও ক্লপ হয়তো এই কথাকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাই এনফিল্ডে এসেও শুনিয়েছিলেন একই কথা। আজ আট বছর পর লিভারপুলের অধ্যায় শেষ করে ক্লপ যখন বিদায় নিলেন, তখন এই কথার মর্ম বড্ড বেশি টের পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা ক্লপ সব সময় চান বিদায়বেলায় তাঁর কর্ম, তিতিক্ষাগুলোকে যেন প্রত্যেকে মনে রাখে।

বিশ্ববাসী তাই করেছে, এমনকি লিভারপুলের কট্টর সমর্থকরাও। দূরদর্শী কৌশলগত ফুটবল, চৌকস বুদ্ধি, প্রেসিং, শিরোপা, সাফল্য—এসবের পাশাপাশি ব্যক্তি ক্লপ, তাঁর স্বভাব, চরিত্র আর তাঁর বৈশিষ্ট্য যেন সবার কাছে বেশি আকর্ষণীয়।

কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ
এএফপি

ক্লপ এসে লিভারপুলের যে দলটাকে পেলেন, সেই স্কোয়াড এখন দেখলে অনেকেরই হাসি পাবে। আগের মৌসুমে লিগে ষষ্ঠ হয়ে শেষ করেছিল তারা, এরপর হারিয়েছে অধিনায়ক জেরার্ড আর উইঙ্গার স্টারলিংকে। টটেনহ্যাম হটস্পারের বিপক্ষে তিনি প্রথম যে একাদশটা নামিয়েছিলেন, সেখানে বলার মতো খেলোয়াড় ছিলেন হাতে গোনা কয়কজন। প্রথম মৌসুমে খেলোয়াড় কেনার জন্য খুব একটা বাজেটও দেয়া হয়নি তাঁকে। বলার মধ্যে ফ্রি ট্রান্সফারে ডিফেন্ডার মাতিপ এবং সাদিও মানেকে কিনেছিল লিভারপুল। মোটামুটি মধ্যম সারির একটা দল নিয়েই এনফিল্ডে যাত্রা শুরু হয়েছিল ক্লপের। এরপর তাঁর দল পাল্টেছে, নিজের ফুটবল দর্শন অনুযায়ী খেলোয়াড় এসেছেন, তাঁদের দিয়ে নিজের পছন্দের ফুটবল খেলিয়েছেন—সাদা চোখে দেখলে ক্লপের যুগের সময়ে এই ব্যাপারগুলোই বেশি দৃষ্টিগোচর হবে। কিন্তু জার্মান এই ভদ্রলোক তো এই সবকিছুরও ওপরে।

আরেকটা ঘটনা এই কিছুদিন আগের। কোচ হিসেবে তাঁর লিভারপুলের অধ্যায় শেষ হয়েছে। মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে গ্যালারিভর্তি দর্শকে সামনে কথা বলছিলেন তিনি। কিন্তু ক্লপ এক পর্যায়ে কী করলেন! লিভারপুলের আসন্ন কোচ আরনে স্লটকে নিয়ে গান শুরু করে দিলেন। সমর্থকদের বলে গেলেন, তাঁরা যেভাবে ক্লপকে এই ক্লাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, নতুন কোচের সময়ও যেন তার ব্যতিক্রম না হয়। এমন কিছু শুনেছ কখনো? কাউকে দেখেছ এমন কাণ্ড করতে?

ক্লপের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর ম্যান ম্যানেজমেন্ট এবং ক্লাবের সবকিছুকে একটা নির্দিষ্ট কাঠামোর ভেতরে নিয়ে আসা। ক্লাব যেন একটা পরিবারের মতো বসবাস করে। মাঠে যে তারা জয় পাচ্ছে, মৌসুম শেষে ট্রফি আসছে —এই সাফল্যে যেন সমানভাবে ক্লাবের রান্নাঘরে কাজ করা ওই রাঁধুনিও ভাগ করে নিতে পারে। মাঠের পাশে থাকা বলবয়, প্রত্যেক খেলোয়াড়ের ডায়েট ঠিক করে দেওয়া ডায়েটিশিয়ান, জিম ইন্সট্রাকটর—প্রত্যেকে ক্লাবের অংশ, প্রত্যেকে পরিবারের মতো পাশে থেকে ক্লাবকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। দীর্ঘ আট বছরে লিভারপুলের এই মানসিকতা তৈরি করেছেন ক্লপ। পরিবার গড়ে তুলে সবাই মিলে কাজ করার মন্ত্র মিশিয়ে দিয়েছেন রক্তের ভেতর। এমনকি বিদায়বেলাতেও আট বছরে অর্জিত প্রতিটা ট্রফি সামনে রেখে ক্লাবের সব স্টাফের সঙ্গে ছবি তুলেছেন। শেষবেলায় জানিয়ে গেছেন, এরা আমার পরিবার। আমরা সবাই মিলে এই শিরোপা জিতেছি।

আরও পড়ুন

মাঠের ফুটবলের বাইরে ক্লপকে চিনতে হলে দুটি ঘটনা বলাই যায়। মাঠের ওই গেগেনপ্রেসিং ফুটবল দিয়ে লিভারপুলকে জিতিয়েছেন সবকিছু। এমনকি পেপ গার্দিওলার একছত্র আধিপত্যে একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে নাক গলিয়েছেন একমাত্র তিনি। শুধু নাক গলানো নয়, ক্লপের ফুটবল দর্শনের কবলে পড়ে গার্দিওলা বাধ্য হয়েছেন তাঁর কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন আনতে। তবে থাকুক এসব প্রসঙ্গ, কৌশলের খেরোখাতা খুলে না বসে আমরা চলে যাই ২০১৯–২০ মৌসুমে। এই মৌসুম প্রত্যেক ফুটবল সমর্থকদের মনে থাকার কথা। যদিও লিভারপুল সমর্থকরা অবশ্যই বিশেষভাবে মনে রাখবেন। কারণ, তখন পৃথিবীতে চলছে কোভিড মহামারি। ফাঁকা গ্যালারিতে খেলা হচ্ছে ফুটবলের প্রতিটি ম্যাচ। দীর্ঘ ত্রিশ বছর পর লিভারপুল সেই মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জিতেছিল। ক্লপকে তখন একটি লাইভ স্ট্রিমিংয়ে আনা হয়েছিল। লিভারপুলের হোম জার্সি গায়ে ক্লপ সেদিন আবেগের বশে কেঁদেই দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

আরেকটা ঘটনা এই কিছুদিন আগের। কোচ হিসেবে তাঁর লিভারপুলের অধ্যায় শেষ হয়েছে। মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে গ্যালারিভর্তি দর্শকে সামনে কথা বলছিলেন তিনি। কিন্তু ক্লপ এক পর্যায়ে কী করলেন! লিভারপুলের আসন্ন কোচ আরনে স্লটকে নিয়ে গান শুরু করে দিলেন। সমর্থকদের বলে গেলেন, তাঁরা যেভাবে ক্লপকে এই ক্লাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, নতুন কোচের সময়ও যেন তার ব্যতিক্রম না হয়। এমন কিছু শুনেছ কখনো? কাউকে দেখেছ এমন কাণ্ড করতে?

জার্মানির পাট চুকিয়ে ক্লপ ইংল্যান্ডে এসেছিলেন তাঁর ভিন্নধর্মী ‘হেভিমেটাল ফুটবল’ দর্শন নিয়ে। এরপর লিভারপুলের হয়ে সবকিছু জিতে ক্লপ যখন ইংল্যান্ড ছাড়লেন, তখন তিনি রীতিমতো একটা ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছেন। ইংল্যান্ডের ফুটবলের ধরন ছাড়াও লিভারপুল ক্লাবটাও ক্লপের নিজস্ব ভঙ্গিমার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। কারণ, তাদের ফুটবল খেলার ধরন, মানসিকতা, কৌশল আর ব্যক্তিত্ব; সবকিছুর ওপর ক্লপের ছাপ জড়িয়ে গেছে অষ্টেপৃষ্ঠে।

এনফিল্ডে দীর্ঘ একটা অধ্যায়ের শেষ করে ক্লপ খুব সম্ভবত বিরতি নেবেন ফুটবল থেকে। হয়তো একদিন মোটা ফ্রেমের চশমার সঙ্গে ঝকঝকে সাদা দাঁতের হাসিওয়ালা ভদ্রলোককে দেখা যাবে নতুন কোনো ক্লাবের ডাগআউটে। কিন্তু লিভারপুলের ক্লপ আলাদা এক স্মৃতি হয়ে গেঁথে থাকবে প্রত্যেকের মস্তিষ্কে। তাঁর চলে যাওয়া নিয়ে গার্দিওলা যেমন ছলছলে চোখে ধরা গলায় বলেছিলেন, ‘আই উইল মিস হিম আ লট।’ অন্য ক্লাবের ডাগআউটে এই সাধারণ গোছের অসাধারণ মানুষকে দেখে সেদিন লিভারপুলের কট্টর সমর্থক হয়তো বলে উঠবে, ‘উই আর মিসিং ইউ আ লট। ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন…’

আরও পড়ুন