অ্যাশেজ: লড়াই হলো সমানে সমান
শেষ ম্যাচ হেরেও বীরের বেশে দেশে ফিরছে অস্ট্রেলিয়া। সিরিজের চতুর্থ টেস্টেই অ্যাশেজের ছোট্ট শিরোপা নিশ্চিত করে প্যাট কামিন্সের দল। টেস্ট ক্রিকেটকে বদলে ফেলা ‘বাজবল’ তত্ত্ব সামনে এনেও নিজেদের মাটিতে অ্যাশেজ রক্ষা করতে ব্যর্থ হলো ইংল্যান্ড। টানা দ্বিতীয়বারের মতো অ্যাশেজ রক্ষা করতে ব্যর্থ ইংলিশদের কাছে এ যেন পরাজয়ের নতুন এক অধ্যায়।
এবারের অ্যাশেজ নিয়ে সবার উন্মাদনা একটু বেশিই ছিল। অ্যাশেজ এমন এক সিরিজ, যেখানে নিয়ম রক্ষার ম্যাচেও টিভি পর্দায় চোখ রাখে কোটি মানুষ। কিন্তু এবারের অ্যাশেজটা একটু বেশিই স্পেশাল। ক্রিকেটীয় দর্শনে দুই দলের অবস্থান সম্পূর্ণ দুই মেরুতে। গত দুই বছরে নিজেদের খোলনলচে বদলে ফেলেছে ইংল্যান্ড। ব্রেন্ডন ম্যাককালামের মাথা আর বেন স্টোকসের ব্যাট- দুই কিউইর হাত ধরে বদলে গিয়েছে টেস্ট ক্রিকেট। ২০২২ সালের মে মাসে ইংল্যান্ড টেস্ট দলের দায়িত্ব বুঝে পান ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, সেদিন থেকেই ‘বাজবল’ যুগে পা দিয়েছে ইংলিশ ক্রিকেট।
টেস্ট ক্রিকেটে নতুন আশার নাম ‘বাজবল’। দিন দিন যেখানে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট, সেখানে বাজবল টেস্টে এনেছিল ‘টি-টোয়েন্টি’র ছোঁয়া। আক্রমণাত্মক ক্রিকেট, প্রতিপক্ষের ওপর চড়াও হয়ে শুরুতেই তাদের দমিয়ে দেওয়া। বাজবল মানেই অন্য কিছু।
অন্যদিকে অজিদের স্টাইল ইংলিশদের তুলনায় বড্ড সেকেলে। প্রথাগত টেস্ট ক্রিকেট বলতে যা বোঝায় আরকি; মাঠে আসব, খেলা দেখে-শুনে-বুঝে এরপর ম্যাচে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করব। যেমনটা টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালেই দেখা মিলেছে। ভারতকে হারিয়ে উঁচিয়ে ধরেছে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের গদা। কিন্তু ইংল্যান্ডের মাটিতে ইংলিশ ট্যাকটিসের কাছে কতটা মুখ তুলে দাঁড়াতে পারবে বাজবল, তা নিয়ে প্রশ্ন ছিলই। সব মিলিয়ে এবারের অ্যাশেজ তাই দুই পরাশক্তির লড়াই নয়, ছিল দুই আদি টেস্ট ক্রিকেট বনাম নতুন টেস্ট ক্রিকেট। কাগজে-কলমে লড়াইয়ে শেষ হাসি আদি টেস্ট ক্রিকেট হাসলেও যুদ্ধের শেষ হাসিটা নতুন টেস্ট ক্রিকেটের দর্শনই হেসেছে।
প্রথম দুই টেস্টে অস্ট্রেলিয়ায় যে জয়, তাকে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের থেকে ইংল্যান্ডের পরাজয় হিসেবে আখ্যা দিলেই বরং ভালো হবে। কেন নয়? প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার জয় মাত্র ২ উইকেটে। শেষ ইনিংসে অধিনায়ক প্যাট কামিন্স ৪৪ রানের অনবদ্য এক ইনিংস না খেললে ধুলায় মিলিয়ে যেত উসমান খাজার রেকর্ড। অজি অধিনায়কের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ায় ইংলিশদের দোষ নেই বটে, কিন্তু দুটো ক্যাচ ফেলার মধ্যে নিশ্চয়ই আছে। আর সেই ক্যাচ যখন মিস করেন স্বয়ং অধিনায়ক বেন স্টোকস, তখন আর নতুন করে কীই-বা বলার থাকে? তাই তো পুরো টেস্টে আধিপত্য বিস্তার করেও শেষমেশ পরাজয়ের গ্লানি নিয়েই ম্যাচ ছাড়তে হয় স্বাগতিকদের।
এজবাস্টনের পুনরাবৃত্তি হয়েছিল লর্ডসে। বাজবলের দর্শনে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে আসে ইংল্যান্ড। অতঃপর গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ক্যাচ মিস, পরবর্তী সময় ম্যাচ মিস। প্রথম ম্যাচটাই যেন নতুন করে দেখছিল বিশ্ববাসী। শেষের চিত্রনাট্যটাও তেমনভাবে তৈরি। দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটসম্যানরা ফিরেছেন প্যাভিলিয়নে, শেষ ভরসা অধিনায়ক। জয়ের যে কিঞ্চিৎ আশা রয়েছে, সেটাও এখন তারই হাতে। সবটাই ঠিক আগের মতো, কামিন্সের জায়গায় শুধু বেন স্টোকস। আর ফলাফলটা এবারও কামিন্সের পক্ষে। অস্ট্রেলিয়ার ছুড়ে দেওয়া ৩৭১ প্রায় ছুঁয়েই ফেলেছিলেন স্টোকস। একাই করেছেন ১৫৫। চতুর্থ ইনিংসে অধিনায়ক হিসেবে যা রেকর্ড। কিন্তু রেকর্ড গড়েও ম্যাচ বাঁচাতে পারেননি তিনি। আটকে গেছেন অস্ট্রেলিয়ান বোলিং লাইনআপের কাছে। জয়ের আশা জাগিয়েও হেরেছেন মাত্র ৪৮ রানে। তত দিনে ইংল্যান্ডের অ্যাশেজ পরাজয় অনেকের কাছে সময়ের অপেক্ষামাত্র।
কিন্তু তৃতীয় ম্যাচেই বাজবলে বাজিমাত করল ইংল্যান্ড। দুই ম্যাচ ধরে যে চক্রব্যূহে বারবার আটকা পড়ছিল ইংল্যান্ড, এই ব্যূহ ভেঙে দিলেন মার্ক উড। অ্যান্ডারসনকে সরিয়ে উডকে ভেড়াতেই বদলে গেল অ্যাশেজের চিত্রনাট্য। জয়, ম্যান অব দ্য ম্যাচ—সবটাই উডের একান্ত নিজের। উডময় তৃতীয় টেস্টে তাই জয়টাও ইংলিশদের। পাক্কা চার বছর পর অ্যাশেজে আরেকটি জয়ের দেখা পেল ইংল্যান্ড। তাদের চোখেমুখে তখন অ্যাশেজ জয়ের স্বপ্ন।
চার নম্বর টেস্টে, সেটা এগোচ্ছিলও ঠিকঠাক। অস্ট্রেলিয়াকে অল্প রানে আটকে দেওয়া, বিশাল লিড, এরপর আবারও অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইনআপকে আঁকড়ে ধরা—সবটাই প্ল্যানমাফিক চলছিল। চলেনি শুধু প্রকৃতি। প্রতি ম্যাচেই অল্পবিস্তর আঘাত হেনেছে বৃষ্টি, কিন্তু ম্যাচের ফলাফলে প্রভাব ফেলতে পারেনি। কিন্তু চতুর্থ টেস্টের এমন সময়ই আঘাত হানল বৃষ্টি, থামার কোনো আভাসই নেই। টানা দুই দিন বৃষ্টি পর যখন বৃষ্টি থামল, ইংল্যান্ডের অ্যাশেজ স্বপ্ন তত দিনে ভেসে গেছে বৃষ্টির জলের সঙ্গে। ড্র হয়ে গেছে টেস্ট।
পঞ্চম টেস্ট ছিল তাই দুই দলের নিয়মরক্ষার ম্যাচ। তাতে অ্যাশেজের আমেজ কিংবা উত্তেজনা, কোনটাতেই ভাটা পড়েনি। বরং নতুন রং পেয়েছে স্টুয়াররাট ব্রডের বিদায়ের ঘোষণায়। শেষ টেস্টটা নিজের মতো করেই স্মরণীয় করে রাখলেন তিনি। বল হাতে ৪ উইকেট নিয়ে প্রবেশ করেছেন ৬০০ উইকেটের ছোট্ট তালিকায়। ব্যাট হাতে নিজের শেষ বলে হাঁকিয়েছেন ৬, আর বল হাতে পেয়েছেন উইকেট। শেষ ম্যাচে ব্রডের বিদায়টা হয়ে রইল ব্রডের মতোই, রোমাঞ্চে ভরপুর।
অ্যাশেজের নিয়ম অনুযায়ী সিরিজ ড্র হলে শিরোপা ভাগাভাগি হয় না। বরং গতবারের অ্যাশেজজয়ীরা নিজেদের বাড়ি নিয়ে যায় ছোট্ট ছাইদানিটা। এবারের অ্যাশেজ তাই ২-২ এ শেষ হলেও ট্রফি বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। অ্যাশেজের জন্য ইংল্যান্ডের ৮ বছর অপেক্ষা আরেকটু বাড়ল। অজিদের বিপক্ষে ‘বাজবল’ ব্যর্থ না সফল সে প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর থাকতে পারে। কিন্তু রোমাঞ্চের দিক দিয়ে এই সিরিজের স্থান যে শীর্ষে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।