জমজমাট এক জুন মাস
খুব বেশি দিন আগের কথা না, জুন মাস এলেই আমরা বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা সংগ্রহ করতাম। এর একটা বড় কারণ ছিল, ফুটবলের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টগুলো সাধারণত জুন-জুলাই মাসজুড়ে হয়। বিশ্বকাপ, ইউরো বা কোপা আমেরিকার সময়ে পত্রিকাগুলোয় থাকত বাড়তি পাতা, ফিক্সচার, অ্যানালাইসিস, কখনো–বা পোস্টারও! এমনকি ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময়েও কোন পত্রিকা কবে কী দিচ্ছে, নিয়মিত এগুলোর খোঁজখবর রাখতে হতো। সেই হিসাবে খেলাপাগলদের জন্য এবারের জুন মাস রীতিমতো উৎসবের উপলক্ষ। একদিকে ক্রিকেটের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ডামাডোল, অন্যদিকে ফুটবলের দুই মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট, কোপা আমেরিকা এবং ইউরোর উন্মাদনা।
প্রথমবারের মতো আমেরিকার মাটিতে হতে যাচ্ছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ, সঙ্গে যৌথ আয়োজক হিসেবে আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্রিকেট বিশ্বের বড় দলগুলোর সামনে এটা একেবারে সিলেবাসের বাইরে থেকে আসা প্রশ্নের মতো। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পিচ, কন্ডিশন নিয়ে কারোরই তেমন গভীর ধারণা নেই। অন্য কোনো খেলায় এসব ততটা প্রভাব না ফেললেও ক্রিকেটে যে পিচ এবং কন্ডিশনের গুরুত্ব অনেক, সেটা তো সবাই জানি। বড় দলগুলোর সামনে এবার তাই কঠিন পরীক্ষা থাকবে। ছোট দল আর বড় দলের ব্যবধান কিছুটা কমবে এ জন্য।
এবারের বিশ্বকাপ আরও একটা কারণে স্মরণীয় হতে যাচ্ছে। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের মূল পর্বে অংশ নিচ্ছে ২০টি দল! এর আগে সর্বোচ্চ ১৬টি দল অংশ নেওয়ার রেকর্ড আছে। চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে নিজেদের মধ্যে ম্যাচ খেলবে দলগুলো। প্রতি গ্রুপের সেরা দুই দল নিয়ে পরবর্তী সময়ে হবে সুপার এইটের খেলা।
বাংলাদেশ আছে গ্রুপ ডি-তে। প্রতিপক্ষ হিসেবে ম্যাচ খেলতে হবে শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নেদারল্যান্ডস ও নেপালের বিরুদ্ধে। যদিও বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে খেলা সিরিজ হেরেছে নাজমুল হোসেন শান্তর দল। প্রথম দুই ম্যাচে আশানুরূপ খেলতে না পারলেও শেষ ম্যাচে বড় জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে টাইগাররা।
গ্রুপ এ-তে, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-পাকিস্তান ছাড়াও রয়েছে কানাডা, আয়ারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে টুর্নামেন্টের দুই ফেবারিট অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড রয়েছে গ্রুপ বি-তে। তাদের চমকে দিতে চাইবে নামিবিয়া, ওমান ও স্কটল্যান্ড। গ্রুপ সি-তে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করবে নিউজিল্যান্ড, আফগানিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাপুয়া নিউগিনি ও উগান্ডা।
জুনের ২ তারিখে শুরু হতে যাওয়া এবারের বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে অনেক খেলোয়াড়েরই শেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়ার ডেভিড ওয়ার্নার, ভারতের রোহিত শর্মা, ইংল্যান্ডের মঈন আলীরা আছেন এই সম্ভাব্য তালিকায়। শেষ বিশ্বকাপ হতে পারে আমাদের সাকিব আল হাসান এবং মাহমুদউল্লাহ রিয়াদেরও! নিজেদের শেষটা রঙিন করতে সর্বস্ব উজাড় করে দিতে চাইবেন এই তারকারা।
ক্রিকেট ছেড়ে এবার ফুটবলে আসা যাক। ব্রাজিল নাকি আর্জেন্টিনা—চিরায়ত সেই তর্কে আবারও জমে উঠতে চলেছে ফেসবুকের ওয়াল, বন্ধুদের আড্ডা, এলাকার চায়ের দোকান, বিকেলের খেলার মাঠ কিংবা বাসার ড্রয়িংরুম। যদিও ২০ জুন থেকে শুরু হওয়া এবারের কোপা আমেরিকা মিস করবেন ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমার। মারাত্মক এসিএল ইনজুরিতে পড়েছেন তিনি। ইনজুরির কারণে নেই রিচারলিসনও! এ ছাড়া এবারের দলে জায়গা পাননি এন্টোনি, ক্যাসেমিরো, এডারসন, গ্যাব্রিয়েল জেসুসের মতো তারকারা। তবুও ভিনিসিয়াস, এনদ্রিক, রদ্রিগোদের ব্রাজিল বাজিমাত করার মতোই শক্তিশালী। ২০২১–এর কোপা আমেরিকার ফাইনাল হার এবং ২০২২ বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেওয়ার দুঃসহ স্মৃতি মুছে ফেলতে চাইবেন নতুন প্রজন্মের ব্রাজিলিয়ানরা। তাদের পথ দেখাতে কোচের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে দারিভাল জুনিয়রের ওপর। ফরোয়ার্ড থেকে ডিফেন্স প্রায় সব জায়গায় তারুণ্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন এই কোচ। প্রীতি ম্যাচগুলোয় দারিভালের সেই তরুণ শিষ্যরা আস্থার বেশ ভালো প্রতিদানও দিয়েছেন। তাই নেইমার না থাকলেও ব্রাজিল–ভক্তরা কোপা জয়ের স্বপ্ন বিভোর।
সেই তুলনায় আর্জেন্টিনা প্রায় পূর্ণ শক্তির স্কোয়াড পেতে যাচ্ছে। ব্রাজিলের সঙ্গে অভিজ্ঞতার তুলনাতেও তারা যোজন এগিয়ে। অ্যানহেল ডি মারিয়া, লওতারো মার্তিনেজ, জুলিয়ান আলভারেজদের নেতৃত্ব দিতে মাঠে থাকবেন লিওনেল মেসি। অ্যালেক্সিস ম্যাকালিস্টার, রদ্রিগো দি পল, এনজো ফার্নান্দেজকে নিয়ে গড়া মিডফিল্ডকে ওয়ার্লক্লাস বললে ভুল হয় না। এমিলিয়ানো মার্টিনেজ, ওতামেন্দি, ক্রিশ্চিয়ান রোমেরোদের নিয়ে গড়া রক্ষণভাগও বেশ আঁটসাঁট। তাদের সঙ্গে ডাগআউটে থাকবেন আলবিসেলেস্তেদের ইতিহাসের সফলতম কোচ—লিওনেল স্কালোনি। আর্জেন্টিনার ভক্তদের চোখেমুখে তাই হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ের নেশা।
ক্রিকেট বিশ্বকাপের মতো এবারের কোপা আমেরিকার আয়োজনও হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। দুই আমেরিকার মহাদেশীয় ফুটবল সংস্থা—কনমেবল ও কনকাকাফের মধ্যস্থতায় এই সিদ্ধান্ত আনা হয়। এবারের আসরে দক্ষিণ আমেরিকার ১০টি দলের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আমেরিকার ৬টি দল অংশ নিচ্ছে। মোট ৪টি গ্রুপে ভাগ হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে ১৬টি দল।
ফুটবলের আরেক জমজমাট আয়োজন—ইউরো শুরু হবে ১৪ জুন থেকে। ইউরোপের ২৪টি দল ৬টি গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলবে। জার্মানির মাটিতে এবারই শেষ ইউরো খেলবেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। পর্তুগালকে নেতৃত্ব দেবেন তিনি। শেষ ইউরো খেলবেন মাদ্রিদের তারকা মিডফিল্ডার লুকা মদ্রিচও। জার্মানির টনি ক্রুস তো অবসরের ঘোষণাই দিয়েছেন, এবারের ইউরোর পর বুট জোড়া তুলে রাখবেন তিনি।
ইউরোতে অবশ্য এবার এককভাবে ফেবারিট বলার মতো কোনো দল নেই। এমবাপ্পের ফ্রান্স, হ্যারি কেনের ইংল্যান্ড অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও স্পেন, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই মাঠে নামবে। ছেড়ে কথা বলবে না ইউরোর বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইতালি এবং স্বাগতিক জার্মানিও। অবশ্য এই দুই দলের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স তেমন আশাজাগানিয়া নয়। কিন্তু বড় টুর্নামেন্টে এই দুই দল যে কত ভয়ংকর হতে পারে, তার সাক্ষ্য দেবে ইতিহাস। আন্ডারডগ হিসেবে চমক দেখাতে পারে বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়া, ডেনমার্কও।
শুধু যে ক্রিকেট আর ফুটবলে জুন মাস ঠাসা এমন ভাবলে ভুল হবে। টেনিসের গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফ্রেঞ্চ ওপেনের আসরও বসছে মে-জুনজুড়ে। রোঁলা গারোর কোর্টে লড়াইয়ে নামবেন জোকোভিচ, আলকারেজরা। জোকোভিচের সামনে সুযোগ থাকবে পুরুষ-নারীর মধ্যে এককভাবে সর্বোচ্চ গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের রেকর্ড নিজের করে নেওয়ার। নারীদের এককে ফেবারিট হিসেবে লড়াই করবেন ইগা সিওন্তেক, সাবালেঙ্কা, কোকো গফ। শেষ পর্যন্ত কারা উঁচিয়ে ধরবেন ট্রফি, এসব কিছুর ফয়সালা জানা যাবে জুনের ৮ ও ৯ তারিখে অনুষ্ঠিত হওয়া ফাইনালে।
বাস্কেটবলের দুনিয়ায় সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ঘরোয়া আসর যুক্তরাষ্ট্রের এনবিএ-এর ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে জুনের ৬ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত। ওয়েস্টার্ন কনফারেন্সের ফাইনালে মিনেসোটা টিম্বারউলভসের বিপক্ষে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে আছে ডালাস ম্যাভেরিকস। অন্যদিকে ইস্টার্ন কনফারেন্সের ফাইনালে ইন্ডিয়ানা পেসারসের বিপক্ষে ৩-০ ব্যবধানে এগিয়ে আছে বোস্টন সেল্টিকস। বড় ধরনের কোনো অঘটন না ঘটলে এই দুই দলই মুখোমুখি হবে এনবিএ ফাইনালে। সেখানে অন্তত চারটি ম্যাচ খেলা হবে। কোনো দল যদি একটানা চার ম্যাচ জিতে নেয়, তাহলে চ্যাম্পিয়ন হবে তারাই। তা না হলে যতক্ষণ না পর্যন্ত কোনো দল চার ম্যাচ জেতে, ফাইনাল চলবে তত দিন। সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাত ম্যাচের মধ্যেই জানা যাবে কারা হবে চ্যাম্পিয়ন।
এসবের বাইরেও জুনের ১৩-১৬ তারিখে অনুষ্ঠিত হবে গলফের মর্যাদাপূর্ণ টুর্নামেন্ট ইউএস ওপেন। বিশ্বের সব তারকা গলফাররা লড়াই করবেন সেখানে। চারপাশে এত খেলা থাকলে নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে সারা দিন শুধু খেলা দেখতেই ইচ্ছা হয় তখন। তাহলে বুঝতেই পারছ জমজমাট এক জুন মাস কাটাতে কেন তর সইছে না আমাদের মতো খেলাপ্রেমীদের!