বোনের কাছে হাতেখড়ি নেওয়া কিশোর খেলছেন দাবা বিশ্বকাপের ফাইনাল
১৯৮৮ সালে বিশ্বনাথন আনন্দের মাধ্যমে নিজেদের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার পায় ভারত। এরপর কেটে গেছে অনেক দিন। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরও অনেক তুখোড় দাবাড়ু এসেছেন দেশটি থেকে, হয়েছেন গ্র্যান্ডমাস্টার। যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আনন্দের পর কোন ভারতীয় দাবাড়ু চমকে দিয়েছেন বিশ্বের সবাইকে—এর উত্তরটা সম্ভবত হবে রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ।
২০০৫ সালে চেন্নাইয়ের মধ্যবিত্ত এক পরিবারে প্রজ্ঞানন্দের জন্ম। বাবা রমেশবাবু ব্যাংকার, দাবা নিয়ে তেমন কোনো ধারণা রাখেননি কোনো দিন। মূলত মায়ের উৎসাহেই দাবায় আগ্রহটা আরও বাড়ে প্রজ্ঞানন্দের। বড় বোন বৈশালির সঙ্গে খেলতে খেলতে দাবার প্রতি ঝোঁক চলে আসে তাঁর।
বড় বোনের সঙ্গে খেলে দাবায় হাতেখড়ি হলেও বাসার সবাই অল্পতেই বুঝে ফেলে, খেলাটার ওপর দখল প্রজ্ঞানন্দের আরও বেশি। এর প্রমাণও দেন তিনি, ফিদে যুব বিশ্বকাপ জিতে নেন মাত্র সাত বছর বয়সে। পাশাপাশি ওই বছর অর্জন করেন ‘ফিদে মাস্টার’ খেতাবও। তবে আন্তর্জাতিক মহলে প্রজ্ঞানন্দ নিজের জানান দেন এর কিছুদিন পর—২০১৫ সালে। মাত্র ১০ বছর বয়সে ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে পান ‘ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার’ খেতাব। আলোচনা শুরু হয়ে যায় তখন থেকেই, দাবায় আরেকজন প্রডিজি পেয়ে গেছে ভারত!
হতাশ করেননি প্রজ্ঞানন্দও। যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাবটাও অর্জন করে ফেলবেন। অল্পের জন্য সে সুযোগ হারিয়ে ফেললেও ২০১৭ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে বনে যান ভারতের ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার, আর বিশ্বে দ্বিতীয় (তবে ২০১৯ সালে রেকর্ডটি ভেঙে দেন তাঁরই স্বদেশি গ্র্যান্ডমাস্টার গুকেশ দামারাজু।
নর্ম পাওয়ার জন্য অনেক আগে থেকেই দেশ–বিদেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিয়মিত খেলছিলেন প্রজ্ঞানন্দ। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় জয়টি আসে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে, এয়ারথিংস মাস্টার্স কাপে। নরওয়েতে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতাটিতে অংশ নিয়েছিলেন তৎকালীন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেন, ইয়ান নেপোমনিয়াচি, লেভন আরোনিয়ান, বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ডিং লিরেনের মতো সুপার গ্র্যান্ডমাস্টাররা। নিজেকে জানান দিতে প্রজ্ঞানন্দ বেছে নেন এয়ারথিংস মাস্টার্সকে। সবাইকে চমকে দিয়ে প্রথমে হারিয়ে দেন ‘আর্মেনিয়ান লায়ন’ বলে পরিচিত গ্র্যান্ডমাস্টার লেভন আরোনিয়ানকে। প্রাণপণ লড়াই করেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি আরোনিয়ান, হার মানতে বাধ্য হন।
বড় বড় টুর্নামেন্টে এমন অঘটন হয় প্রায়ই। তবে এই জয় যে কোনো অঘটন নয়, সেটা বোঝাতে খুব বেশি দেরি করেন না প্রজ্ঞানন্দ। সবাইকে স্তব্ধ করে হারিয়ে দেন তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের সেরা দাবাড়ু গ্র্যান্ডমাস্টার ম্যাগনাস কার্লসেনকে। মাত্র ৩৯ চালের মাথায় জয় তুলে নেন প্রজ্ঞানন্দ।
এসব তো বেশ আগের কথা। প্রজ্ঞানন্দ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এ বছরও। গত ৩০ জুলাই আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে বসেছে ফিদে দাবা বিশ্বকাপের এবারের আসর। প্রতিযোগিতাটিতে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন দেশের মোট ২০৬ জন গ্র্যান্ডমাস্টার। প্রজ্ঞানন্দের পাশাপাশি বিশ্বকাপে ভারত থেকে আসেন ভিদিত গুজরাঠি, অর্জুন এরিগাইসি, গুকেশ দামারাজুর মতো দাবাড়ুরাও।
এখানেও সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন প্রজ্ঞানন্দ। পৌঁছে গেছেন প্রতিযোগিতাটির ফাইনালে, গড়েছেন ইতিহাস। চেন্নাই থেকে আসা কিশোর এই দাবাড়ুর সঙ্গে পেরে ওঠেননি কেউ। কাকে হারাননি প্রজ্ঞানন্দ? দাবা র্যাঙ্কিংয়ের দুই নম্বর খেলোয়াড় হিকারু নাকামুরা, স্বদেশি অর্জুন এরিগাইসি, মার্কিন দাবাড়ু ফাবিয়ানো কারুয়ানা—জয় তুলে নিয়েছেন সবার বিরুদ্ধেই। উঠে এসেছেন প্রতিযোগিতাটির ফাইনালে।
কিন্তু ফাইনালে তাঁর প্রতিপক্ষ আর কেউ নন, স্বয়ং ম্যাগনাস কার্লসেন!
দাবা বিশ্বকাপে প্রথমে দাবাড়ুরা ক্ল্যাসিক্যাল পদ্ধতিতে খেলেন দুই ম্যাচ। এই দুই ম্যাচে ফলাফল নির্ধারিত না হলে, র্যাপিড সিস্টেমে খেলা হবে চার ম্যাচ। র্যাপিডেও কোনো জয়ী পাওয়া না গেলে, খেলা গড়াবে ব্লিটজে।
ফাইনালের প্রথম রাউন্ড অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে গতকাল। কোনো ফলাফল আসেনি ম্যাচটিতে, ড্রতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে প্রজ্ঞানন্দ আর ম্যাগনাসকে। আজ বিকেলে দ্বিতীয় রাউন্ডে আবার মুখোমুখি হবেন দুই দাবাড়ু। ক্ল্যাসিক্যাল, র্যাপিড বা ব্লিটজ—যেভাবেই হোক, ফলাফল আসবে আজকেই। জানা যাবে, কে জিতছেন এবারের দাবা বিশ্বকাপ।
অনেকবার চ্যাম্পিয়নশিপ জিতলেও বিশ্বকাপ কখনো জেতা হয়নি ম্যাগনাসের। সে জন্য এবার ম্যাগনাসের জয়ের তাড়নাটাও বোধ হয় অনেক বেশি। ‘এই বিশ্বকাপটা ম্যাগনাসের’—টুর্নামেন্টের শুরুতে অনেকের মুখে শোনা গেছে এমনটাও।
রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ একবার তো হারিয়েছেন ম্যাগনাসকে। এবার কি পারবেন, এয়ারথিংস কাপের পুনরাবৃত্তি করতে?
উত্তর জানা যাবে আগামীকাল।