ইউরো ’২৪: গ্রুপ ডি — ফেবারিট ফরাসি জায়ান্ট আর ওলন্দাজ বাহিনী
২০১৬ সালের ইউরো থেকে ফ্রান্সের যে নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল, তা এখনো চলছে। যদিও পর্তুগালের সঙ্গে সেবার ফাইনালটা হেরেছিল ফরাসিরা, কিন্তু ওই ইউরোর পর এ পর্যন্ত মোট চারবার ফাইনাল খেলেছে তারা। এর মধ্যে টানা দুটি ফাইনাল খেলেছে বিশ্বকাপে। সর্বশেষ আর্জেন্টিনার কাছে ৩-৩ গোলে ড্র হওয়ার পর টাইব্রেকারে কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে হেরে যায় ফ্রান্স। তবে এর চার বছর আগে ২০১৮ সালে কিন্তু ঠিকই ওই সোনালি ট্রফি ঘরে তুলেছিল তারা। এরপর জিতেছে নেশনস লিগও। ফ্রান্সের বর্তমান এই দল তৈরি করা এবং প্রতিটি টুর্নামেন্টে এমন আধিপত্যের পেছনে কলকাঠি নেড়ে যাচ্ছেন কোচ দিদিয়ের দেশম। ৫৫ বছর বয়সী এই ফরাসি কোচকে ফ্রান্সের ইতিহাসে তো বটেই, বর্তমান ফুটবলের অন্যতম সেরা কোচ বললেও ভুল হবে না। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে ফ্রান্সকে কোচিং করাচ্ছেন তিনি। এই দলটা তাঁর কাছে একটা পরিবারের মতো।
তবে ইউরোর কথা এলে ফ্রান্সের খানিকটা মনঃক্ষুণ্ন হওয়ারই কথা। পর্তুগালের কাছে ২০১৬ ইউরোর ফাইনালে হার। ২২০২ ইউরোতে রাউন্ড অব সিক্সটিনে টাইব্রেকারে সুইজারল্যান্ডের কাছে হেরে বিদায়। তা ছাড়া ফ্রান্সের ইউরো জয়ের শেষ স্মৃতিও এখন বেশ মলিন। এ জন্য ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী দল হিসেবে ফ্রান্স শুধু ফেবারিট হয়ে ইউরো যাচ্ছে না, তাদের লক্ষ্য ইউরোপিয়ান ফুটবল-শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ঘরে আনা।
এবারের ইউরোর বাছাইপর্ব দারুণ কেটেছে তাদের। ৮ ম্যাচে কোনোটিতে হারেনি দেশমের দল। মোট ২৯ গোল দেওয়ার পাশাপাশি হজম করেছে মাত্র ৩ গোল। এই ছোট্ট পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়, ফ্রান্সের দুর্দান্ত আক্রমণভাগ ও শক্তিশালী রক্ষণের নমুনা। এ ছাড়া বিশ্বকাপ ফাইনালের পর এখন পর্যন্ত মাত্র দুবার হেরেছে তারা। যদিও দুবারই তাদের প্রতিপক্ষ ছিল জার্মানি। তবে ইউরোপের বড় দেশ হিসেবে এর মাঝে দুবার নেদারল্যান্ডসকেও হারিয়েছে ফ্রান্স।
ইউরোর স্কোয়াড পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, এবারের আসরে ফ্রান্সের চেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ দল খুব কমই রয়েছে। বিশ্বসেরা আক্রমণভাগ তাদের। ৪-২-৩-১ ছকে দল সাজালে যেমন প্রতিপক্ষকে সামলাতে হবে এমবাপ্পে, গ্রিজমান, ডেম্বেলে আর কোমানদের আগ্রাসী আক্রমণ। তেমনই সুযোগ থাকবে ৪-৩-৩ ছকে খেলানোর। তবে ফ্রান্সের এই একাদশে গোলরক্ষকের জায়গায় তাকালে প্রথমবারের মতো ফুটবলবিশ্ব নির্দিষ্ট একজনকে অবশ্যই মিস করবে। ফরাসিদের গোলবার সামলানোর দীর্ঘদিনের সৈনিক হুগো লরিস এবার থাকছেন না। তাই গোলরক্ষক হিসেবে এবারের ভরসা এসি মিলানের মাইক মাইগনান।
বরাবরই চারজন ডিফেন্ডার নিয়ে দল সাজাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে ফ্রান্স। লেফটব্যাকে তাই জুলস কুন্দের থাকার কথা। এই পজিশনে খেলতে পারেন বেঞ্জামিন পাভারও। আর রাইটব্যাকের জন্য রয়েছে রিয়াল মাদ্রিদের ফেরল্যান্ড মেন্ডি এবং থিও হার্নান্দেজ। তবে প্রধান দুই ডিফেন্ডার বাছাই করতে গিয়ে কিছুটা হলেও হিমশিম খেতে হবে দেশমকে। আর্সেনালের হয়ে দারুণ একটা মৌসুম খেলা উইলিয়াম সালিবা রয়েছেন। হয়তো শুরু থেকে একাদশে তাঁরই থাকার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু সালিবার সঙ্গী হবেন কে? উপামেকানো নাকি কোনাতে? নাকি সালিবা নন, এঁরা দুজনই হবেন কোচের প্রথম পছন্দের ডিফেন্ডার? তা ছাড়া পাভার ও কুন্দেও কিন্তু খেলতে পারেন সেন্টারব্যাক পজিশনে। ডিফেন্ডার বাছাই করতে গিয়ে তাই এক মধুর সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে দিদিয়ের দেশমকে।
তবে নেদারল্যান্ডসকে নিয়ে নিজের ফুটবল-দর্শন অনেকটা অস্পষ্টই রেখেছেন কোমান। মাঝমাঠে দুজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ের ইনজুরির জন্য তাঁর একাদশ এবং ছক তিনি পাল্টাতে পারেন। খেলার ধরন বদলে যেতে পারে তাদের স্ট্রাইকারদের জন্যও। কারণ, মেমফিস ডিপাই আর ভাউট ভেঘোর্স্ট স্ট্রাইকার পজিশনে খেললেও তাঁদের খেলার ধরন বেশ ভিন্ন।
ফরাসিদের মাঝমাঠ যেন তারকা খেলোয়াড়ের আঁতুড়ঘর। আছেন কামাভিঙ্গা, চুয়ামেনি, রাবিও, কান্তে আর ফোফানা। এবার প্রথমবারের মতো ইউরোর মঞ্চে খেলার সুযোগ হচ্ছে পিএসজির উঠতি তারকা ওয়ারেন জাইরে-এমিরির। আক্রমণভাগে বিশ্বমানের খেলোয়াড়দের কথা আগেই বলেছি। কিন্তু তাদের বদলি হিসেবে যাঁরা আছেন, তাঁদের নামও তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। কোলো মুয়ানি, জিরু, বারকোলা আর মারকাস থুরাম দ্বিতীয়ার্ধে নেমে খেলার দিক পাল্টে দিতে পারেন।
কাগজে-কলমে এই ফ্রান্স দলে বিশেষ কোনো দুর্বলতা নেই। আসলে যে দলে প্রতিটা পজিশনে দুজন করে বিশ্বমানের খেলোয়াড় আর ডাগআউটে দেশমের মতো অভিজ্ঞ কোচ রয়েছেন, সেই দলের দুর্বলতা থাকে কীভাবে! তবে নতুন করে জিরুর সংযোজন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। যদিও এমবাপ্পে, ডেম্বেলে আর গ্রিজমানদের পর বেঞ্চে যখন দুর্দান্ত ফর্মে থাকা থুরাম আর বারকোলা রয়েছেন, সেখানে ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে চলে আসা জিরু কতটুকু সুযোগ পাবেন, সেখানেই বড় ধোঁয়াশা থেকে যায়।
ফ্রান্সের মতোই নিজেদের প্রজন্মের সেরা এক দল নিয়ে ইউরোর মঞ্চে এসেছিল রোনাল্ড কোমানের নেদারল্যান্ডস। ডাচরা মূলত তাদের মাঝমাঠ সাজায় বার্সেলোনার মিডফিল্ডার ফ্রেংকি ডি ইয়ংকে কেন্দ্র করে। তাদের মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠিই থাকে ডি ইয়ংয়ের হাতে। কিন্তু বার্সেলোনার হয়ে খেলায় সময় চোটে পড়ার পর তাঁর ইউরো খেলা নিয়ে বেশ অনিশ্চয়তা ছিল। তবু ডি ইয়ংকে রাখা হয়েছিল ইউরোর দলে। কিন্তু শেষমেশ সেই শঙ্কাই সত্য হলো। ইউরো থেকে একেবারে ছিটকে গেলেন তিনি। তার শূন্যস্থানে যে খেলোয়াড়ের কথা ভাবা হচ্ছিল, চোটে পরে সেই টিউন কুপমেইনার্সও ইউরো শেষ হয়ে গেছে। মূলত ফ্রেংকি ডি ইয়ং যেই ভূমিকায় খেলতেন, তার কাছাকাছি খেলার মতো একমাত্র এই কুপমেইনার্সই ছিলেন। তাই গুরুত্বপূর্ণ এই দুইজনের ছিটকে যাওয়া নিয়ে রোনাল্ড কোমানের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার কথা।
ডাচদের গোলবার সামলানোর দায়িত্ব বর্তাতে পারে ব্রাইটনের বার্ট ভেরব্রুখেনের কাঁধে। রক্ষণে তাদের আছে বিশ্বমানের ডিফেন্ডার। তবে ডি লিখট, ভ্যান ডাইক, ডি ভ্রাই আর মিকি ভ্যান দে বেনের মধ্য থেকে কোমান খুব সম্ভবত ডি ভ্রাই আর ভ্যান ডাইককেই বাছাই করবেন। তবে মাঝমাঠের চোটের কারণে যদি তিনি ৫-৩-২ ছকে খেলাতে আগ্রহী হন, তবে দুজন উইংব্যাকের সঙ্গে তখন ডিফেন্ডার হিসেবে খেলবেন মোট তিনজন। মধ্যমাঠে আছেন তিজানি রেইন্ডার্স, ভাইনালদুম, গ্রাভেনবারখ আর ভ্রেম্যান। আক্রমণে নজর রাখা উচিত গত বিশ্বকাপে দারুণ খেলা কোডি গাকপো আর চলতি মৌসুমে গোলের পসরা সাজিয়ে বসা জাভি সিমন্সের দিকে।
তবে নেদারল্যান্ডসকে নিয়ে নিজের ফুটবল-দর্শন অনেকটা অস্পষ্টই রেখেছেন কোমান। মাঝমাঠে দুজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ের ইনজুরির জন্য তাঁর একাদশ এবং ছক তিনি পাল্টাতে পারেন। খেলার ধরন বদলে যেতে পারে তাদের স্ট্রাইকারদের জন্যও। কারণ, মেমফিস ডিপাই আর ভাউট ভেঘোর্স্ট স্ট্রাইকার পজিশনে খেললেও তাঁদের খেলার ধরন বেশ ভিন্ন।
ইউরোতে নেদারল্যান্ডস সফল দেশই বলা চলে। ১৯৮৮ সালে ইউরো জিতেছিল তারা। খেলেছে চারটা সেমিফাইনাল। এবারের বাছাইপর্বটাও মন্দ কাটেনি তাদের। মোট ৮ ম্যাচে ১৭ গোলের পাশাপাশি ৭ গোল হজম করেছে ডাচরা। কিন্তু বড় দলের মুখোমুখি হলেই তাদের পারফরম্যান্স এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারবার। বিশ্বকাপের পর ফ্রান্স, জার্মানি, ক্রোয়েশিয়া, ইতালির কাছে হেরেছে তারা।
গ্রুপ ডির বাকি দুই দেশ অস্ট্রিয়া ও পোল্যান্ড। এদিকে পোল্যান্ডের জন্যও দুঃসংবাদ রয়েছে। ইউরোর আগে চোটে পড়েছেন তাদের তারকা স্ট্রাইকার রবার্ট লেভানডফস্কি। এটা নিশ্চিত, ইউরোর প্রথম ম্যাচ খেলা হচ্ছে না তাঁর। গত বিশ্বকাপের পর পোল্যান্ড ধারাবাহিকভাবে ভালো পারফরম্যান্স করতে থাকলেও লম্বা একটা সময় ফর্মহীনতায় ভুগতে হয়েছে তাদের। এ জন্য বাছাইপর্বে তৃতীয় হয়ে প্লে-অফ খেলে মূল পর্বে আসতে হয়েছে লেভানডফস্কিদের।
লেভানডফস্কি অবশ্যই পোলিশদের মূল ভরসা। তবে মাঝমাঠে পিতর জিলেনেস্কি আর গোলবারে শেজনির মতো বিশ্বমানের ফুটবলার আছে তাদের।
এই গ্রুপের বাকি সবার থেকে তুলনামূলক দুর্বল মনে হলেও চমক দেখাতে পারে অস্ট্রিয়া। গত ১৫ ম্যাচে তারা হেরেছে মাত্র ১টি ম্যাচে। এমনকি প্রীতি ম্যাচে হারিয়েছে জার্মানিকেও। বাছাইপর্বেও তাদের পারফরম্যান্স বেশ দুর্দান্ত। ৮ ম্যাচে মাত্র ৭ গোল খাওয়ার পাশাপাশি প্রতিপক্ষের জালে মোট ১৭ বার গোল করেছে তারা। অস্ট্রিয়া মূলত খেলে হাই প্রেসিং অ্যান্ড কাউন্টার অ্যাটাকের মন্ত্রে। আর দলের মধ্যে এই মন্ত্রের বীজ স্থাপন করেছেন মাস্টারমাইন্ড টেকটিশিয়ান রালফ রায়নিক। দলে তারকা খেলোয়াড় বলতে তেমন কেউ নেই। কিন্তু বিশেষভাবে বলতে হয়, বায়ার্ন মিউনিখের মিডফিল্ডার কনরাদ লাইমার আর বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের মারসেল স্যাবিতজারকে। এ ছাড়া দলের বাকি সবাই কমবেশি ইউরোপিয়ান ফুটবলের নিয়মিত মুখ। দলের অবিচ্ছেদ্য সৈনিক ডেভিড আলাবার না থাকা বড় একটা দুর্বল পয়েন্ট হলেও এবারের অস্ট্রিয়া চমকে দিতে পারে সবাইকে। তাই সুপার ফেবারিট ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডস থাকলেও বিশেষভাবে চোখ রাখবে অস্ট্রিয়ার প্রতি।
হেড টু হেডে নেদারল্যান্ডস অনেকটাই ফ্রান্সের কাছে পিছিয়ে। গত বাছাইপর্বে দুবারের দেখায় দুবারই হেরেছে তারা। তবে সব মিলিয়ে ডাচরা জিতেছে মাত্র চারবার, আর ফ্রান্সের জন্য এই সংখ্যাটা দ্বিগুণ। অস্ট্রিয়ার বিপক্ষেও এগিয়ে থাকবে ফ্রান্স। সম্প্রতি নেশনস লিগেও অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে জিতেছে ফরাসিরা। তবে বিশ্বকাপে কিন্তু একবার অস্ট্রিয়া হারিয়ে দিয়েছিল ফ্রান্সকে। যদিও সেসব অনেক আগের ঘটনা। আর তিনবারের দেখায় পোল্যান্ডের বিপক্ষে দুবার জয় পেয়েছে ফ্রান্স। ওদিকে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ছয়বার আর পোল্যান্ডের সঙ্গে চারবারের দেখায় প্রতিবার জয়ের দেখা পেয়েছে নেদারল্যান্ডস। বিপরীতে অস্ট্রিয়াও কখনো পোল্যান্ডের সঙ্গে জিততে পারেনি।
গ্রুপ ডির ম্যাচগুলো:
রাউন্ড এক:
পোল্যান্ড বনাম নেদারল্যান্ডস — ১৬ জুন (সন্ধ্যা ৭টা)
অস্ট্রিয়া বনাম ফ্রান্স — ১৮ জুন (রাত ১টা)
রাউন্ড দুই:
পোল্যান্ড বনাম অস্ট্রিয়া — ২১ জুন (রাত ১০টা)
নেদারল্যান্ডস বনাম ফ্রান্স — ২২ জুন (রাত ১টা)
রাউন্ড তিন:
ফ্রান্স বনাম পোল্যান্ড — ২৫ জুন (রাত ১০টা)
নেদারল্যান্ডস বনাম অস্ট্রিয়া — ২৫ জুন (রাত ১০টা)